উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লব ঘটিয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে বিশ্ব শাসন করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির সুবাদে তৃতীয় বিশ্বে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে। এক সময় বৃহত্তর নোয়াখালীর যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত। এতে করে লাখ লাখ অধিবাসীর সীমাহীন দুর্ভোগ ছিল নিত্যসঙ্গী। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট।
বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের গ্রামাঞ্চল থেকে শুরু করে জেলা শহরে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটছে। যার সুবাদে লাখ লাখ মানুষের সময় ও অর্থ দু’টোর সাশ্রয় হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সাথে দ্রুত ও নিরাপদ যোগাযোগের লক্ষ্যে কুমিল্লা টমচম ব্রীজ-বেগমগঞ্জ ৫৯ কিলোমিটার ফোরলেন সড়কের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। ২১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি নির্মাণকাজ ২০২২ সালে শেষ হবে জানা গেছে। তেমনিভাবে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা-সোনাপুর জিরো পয়েন্ট ১৩ কিলোমিটার ফোরলেন সড়ক নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে। ৯৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফোরলেন সড়কটির নির্মাণ কাজ ২০২২ সালে শেষ হবে।
অপরদিকে ১৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সোনাপুর-জোরালগঞ্জ সড়কের নোয়াখালী-ফেনী অংশের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছর সড়কটি চালু হলে নোয়াখালী থেকে মাত্র দেড়/দুই ঘন্টায় বন্দরনগরী চট্টগ্রামে যাতাযাত সম্ভব হবে।
নোয়াখালী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বিনয় কুমার পাল ইনকিলাবকে জানান, নোয়াখালীর চৌমুহনী-ফেনী ৩০ কিলোমিটার সড়ক ফোরলেনে উন্নীত করা হবে। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৩০ কোটি টাকা। চলতি বছরের নভেম্বর থেকে এর নির্মাণ কাজ শুরু হবে। সোনাপুর- চেয়ারম্যান ঘাট ৫০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণে ১৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের শেষ দিকে দুইটি প্রকল্পের মাধ্যমে উক্ত সড়কের কাজ শুরু হবে। সড়কটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে হাতিয়া ও নিঝুমদ্বীপ ভ্রমণকারীদের জন্য আরো সহজ হবে। ২০২২ সালের মধ্যে কুমিল্লা টমচম ব্রীজ থেকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ- সোনাপুর-সোনাগাজী- জোরালগঞ্জ হয়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে যাতায়াত করা যাবে। সোনাপুর-জোরালগঞ্জ সড়ক চালু হলে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের যানবাহন এ সড়ক পথে চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করবে। এতে করে সময় ও অর্থ দু’টোই সাশ্রয় হবে।
চৌমুহনী-ফেনী ৩০ কিলোমিটার ফোরলেন সড়ক চালু হলে এ পথে সড়কে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে আসবে। ফেনী জেলা সদর থেকে প্রতিটি উপজেলায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর হলেও লক্ষীপুরের ৭টি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের এখন বেহাল দশা। এরমধ্যে লক্ষীপুর-রামগতি ৫৫ কিলোমিটারের গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি অন্যতম। তবে আশার কথা শোনালেন লক্ষীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুব্রত দত্ত। উক্ত ৭টি সড়ক উন্নয়নে অচিরেই বরাদ্দ পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান। এদিকে লক্ষীপুরের রায়পুর-ফরিদগঞ্জ-চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়ক উন্নয়নের দাবী জানিয়েছেন এলাকার সচেতন মহল। লক্ষীপুর জেলা শহর ও রায়পুরের কয়েকজন পেশাজীবী ইনকিলাবকে জানান, রাজধানী ঢাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো দ্রুত ও নিরপদ করার লক্ষ্যে রায়পুর-ফরিদগঞ্জ-চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়ক উন্নয়নের বিকল্প নাই। এতে করে লাখ লাখ অধিবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
লক্ষীপুর-চৌমুহনী-ফেনী রেললাইন স্থাপনের দাবী দীর্ঘদিনের। নোয়াখালী ও ফেনীর জেলার সাথে দেশের অন্যান্য অংশের রেল যোগাযোগ থাকলেও রেলসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে লক্ষীপুরবাসী। তবে আশার কথা হচ্ছে, লক্ষীপুর জেলাকে রেলওয়ের নেটওয়ার্কে আনার চিন্তা ভাবনা চলছে। ফেনী-চৌমুহনী-লক্ষীপুর ৬০ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনে অর্থের উৎস খোঁজা হচ্ছে। লক্ষীপুর-চৌমুহনী-ফেনী রেলপথ চালু হলে এ অঞ্চলের ৬৫/৭০ লাখ মানুষ উপকৃত হবে।
অপরদিকে বৃটিশ আমলে নোয়াখালী রেলওয়ে স্টেশন থেকে পুরাতন জেলা শহরের দক্ষিণে ইছাখালী পর্যন্ত রেল যোগাযোগ ছিল। ১৯৪৬-১৯৪৭ সালের দিকে নোয়াখালী শহর মেঘনার করালগ্রাসে নিমজ্জিত হবার পর ১৯৫০ সালে নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীতে স্থানান্তর হয়। কালের বিবর্তনে মেঘনা নদী ৪৫/৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে চলে গেছে। ফলে নোয়াখালী রেলওয়ে স্টেশন থেকে সূবর্ণচরে রেল লাইন স্থাপনের দাবী জানিয়ে আসছে নোয়াখালীর বিভিন্ন পেশাজীবী।
নোয়াখালী অঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন ঘটছে। লক্ষীপুর থেকে ভোলা-বরিশাল, চাঁদপুর, হাতিয়া ও চট্টগ্রাম রুটে নৌ-যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। এরমধ্যে লক্ষীপুর থেকে ভোলা ও বরিশাল রুটে লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে। মেঘনা বেষ্টিত হাতিয়ার ৬ লক্ষাধিক অধিবাসীর দ্রুত ও নিরাপদ যোগাযোগের লক্ষ্যে ঢাকা-হাতিয়া ও হাতিয়া-ঢাকা সদরঘাট রুটে দৈনিক ৪টি বৃহদাকারের অত্যাধুনিক লঞ্চ চলাচল করছে। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে হাতিয়া রুটে সপ্তাহে ৪ দিন স্টিমার চলাচল করছে।
উল্লেখ্য, আশি নব্বইয়ের দশকে রাজধানী ঢাকা থেকে হাতিয়া যেতে কমপক্ষে দুইদিন সময় লাগতো। বর্তমানে ঢাকা থেকে ৮/১০ ঘন্টায় এবং নোয়াখালী জেলা সদর থেকে ৪/৫ ঘন্টায় হাতিয়ায় অনায়াসেই যাতায়াত করা যায়।
অপরদিকে মেঘনার তীরে গড়ে উঠেছে ’স্বর্ণদ্বীপ’, মেঘনার বুকে ’ভাসানচর’ এবং প্রকৃতির অপরুপ সমাহার ’নিঝুমদ্বীপ’ ঘিরে এ অঞ্চলে সড়ক ও নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থার আরো পরিবর্তন ঘটবে বলে হাতিয়ার সচেতন মহলের অভিমত।
২০২০ সালের মধ্যে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নোয়াখালী অঞ্চল নবযুগে প্রবেশ করবে। নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষীপুরের প্রতিটি উপজেলার সাথে জেলা সদরের দ্রুত ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এছাড়া কুমিল্লা টমচম ব্রীজ থেকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা-সোনাপুর জিরো পয়েন্ট পর্য্যন্ত ৭২ কিলোমিটার ফোরলেন সড়ক চালু হলে যোগাযোগ সেক্টরে এ অঞ্চলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। রাজধানী ঢাকা থেকে সোনাপুর-সোনাগাজি-জোরালগঞ্জ সড়ক চালু হলে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর সাথে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের দ্রুত ও নিরাপদ যোগাযোগ সম্ভব হবে। এতে সময় ও অর্থ দু’টোর সাশ্রয় হবে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন