আফতাব চৌধুরী : ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীবরূপে মানবজাতিকে সৃজন করে আল্লাহতা’লা প্রত্যেকের ওপর কোনো না-কোনো দায়-দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। কর্মময় জীবনে মানুষ নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে, এটাই স্বাভাবিক। সাধারণত আগ্রহ ও আন্তরিকতা সহকারে দায়িত্ব সম্পাদন করাই কর্তব্যপরায়ণতা। জীবনের সর্বাবস্থায় ধর্মীয় রীতি-নীতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় পরিম-লে বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে ভূমিকা পালনের চেতনাই হল কর্তব্যপরায়ণতার মূল অঙ্গীকার। আল্লাহতা’লা মানুষকে কর্তব্য পালনের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে।’
কর্তব্যপরায়ণতার পরিধি অনেক বিস্তৃত। মানুষ একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চায়। সে খেয়ালখুশি অনুযায়ী চলতে পারে না। সমাজের সবার সুবিধার্থে ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হয়। শুধু ঘরে বসে অলস জীবনযাপনের কোনও অর্থ হয় না। এমনকি বিরাট অর্থ-বিত্তশালী ব্যক্তিও কাজকর্ম ছাড়া অলসভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পছন্দ করে না। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে সব মানুষের প্রতি পারস্পারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। তাই আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মানুষকে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হতে হবে। ইমানদারের প্রতিটি কর্তব্যই এবাদত, যদি তা কল্যাণকর ও নিঃস্বার্থ হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) যথাযথই বলেছেন, ‘কর্মের ফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (বুখারি)।
একজন মানুষের সার্র্বিক জীবনবোধের অবিচ্ছেদ্য অংশ হল দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যপরায়ণতা। নিজের দায়িত্ব ও শৃঙ্খলার জন্য কর্তব্যপরায়ণতার গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি মানুষের অন্যতম কাজ। তাই নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তোমার নিজের প্রতি কর্তব্য রয়েছে।’(বুখারি)
ইসলামে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, বায়োজ্যেষ্ঠ ও বয়ঃকনিষ্ঠ সবার প্রতি পারস্পারিক দায়িত্ববোধকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সব সময় পিতা-মাতার আদেশ-নিষেধ মান্য করা এবং তাদের সঙ্গে সৌজন্যময় আচরণ করা মানুষের একান্ত কর্তব্য। পিতা-মাতা, সন্তান-পরিজনের প্রতি বিশেষ কর্তব্য রয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি অবহেলা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। তাদের সেবা করার জন্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত রয়েছে, ‘তোমরা পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্বব্যবহার করবে।’
আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালনের বিশেষ দিক নির্দেশনাও ইসলামে রয়েছে। পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের সহায়তা করা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা একান্ত কর্তব্য। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত রয়েছে, সত্যিকার কর্তব্যপরায়ণ তারাই যারা আত্মীয়স্বজনকে তাদের প্রিয় ধন-সম্পদ দান করে।’ পাড়া-প্রতিবেশীর বিপদে-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা করে এবং প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। রাসূলুল্লাহ (সা.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির প্রতিবেশী তার অত্যাচার ও অন্যায় আচরণ থেকে রক্ষা পায় না, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’(মুসলিম)
সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের সঙ্গে কোনো রকম অপ্রীতিকর কর্মকা- ও দ্বন্দ্ব-কলহ করা যাবে না। সর্বদা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হবে। শিক্ষার্থী বন্ধুদের বই, খাতা, কলম, পেনসিল না থাকলে এগুলো দিয়ে তাকে সাহায্য করা কর্তব্য। পিতা-মাতা যেমন সন্তানের লালন-পালন করেন, তেমনি শিক্ষকও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে তোলেন, তাই শিক্ষকদের যথাযথ শ্রদ্ধা করা, তাদের আদেশ-নিষেধ মেনে চলা উচিত।
ধনী লোকরা দরিদ্র-অসহায়দের সাহায্য করবে এবং গরিবরা ধনীদের সহযোগিতা করবে, এটাই ইসলামের বিধান। সুতরাং অনাথ, মিসকিন, দুস্থ ও হতদরিদ্র ব্যক্তিদের সর্বাত্মক সাহায্য-সহায়তা করা অপরিহার্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতা’লা ঘোষণা করেছেন, ‘আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে প্রার্থী ও ধনীদের অধিকার রয়েছে।’ কর্মজীবনে মালিকপক্ষ কর্তব্যরত শ্রমিকদের সঙ্গে অবশ্যই উত্তম ব্যবহার করবে। শ্রমিক-কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানে মালিকের কাজকর্মে কোনো রকম ফাঁকি দেবে না। কর্মচারীরা মন-প্রাণ দিয়ে স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে থাকবে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের নির্ধারিত পারিশ্রমিক ঠিকমতো দিয়ে দেবে। শ্রমিক ও মজুরের উপর কোনো ধরনের জুলুম-নির্যাতন ও শোষণ করবে না। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘শ্রমিককে তার ঘাম শুকানোর আগে পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’
দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার পরিণাম খুবই ভয়াবহ। কর্তব্যে অবহেলা, অমনোযোগিতা প্রভৃতি নানা ধরনের বিপদ, ব্যর্থতা ও বিপর্যয় ডেকে আনে। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় কর্তব্যপরায়ণতা একটি আমানত এবং মনুষ্যত্বের প্রতীক। পরিবারে পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্যে অবহেলার দরুন সুখের সংসার ধ্বংস হয়ে যায়; ছেলেমেয়েরা পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপথগামী ও উদাসীন হয়। তারা ঠিকমতো পড়াশোনা না-করে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়। এভাবে প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন না করলে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমাজ জীবনে নানাবিধ ক্ষতি সাধিত হয়। হাদিস শরিফে কর্তব্যপরায়ণতার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে- শাসক, স্বামী, স্ত্রী, দাস প্রত্যেকেরই জবাবদিহির বিষয় রয়েছে। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকেরই রক্ষক এবং তোমাদের সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সমাজ, দেশ ও জাতির উন্নয়ন এবং অগ্রগতি প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্যপরায়ণতার ওপর নির্ভরশীল। প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে দায়িত্বসচেতন থাকে এবং প্রত্যেকে নিজের কাজটুকু ঠিকমতো সম্পন্ন করে, তা হলে কোনো কাজই অবহেলিত হয় না। তখন সমাজ উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে চলতে থাকে এবং দেশ ও জাতি সমৃদ্ধশালী হয়। মাতৃভূমির উন্নয়ন ও সার্বভৌমিত্ব সংরক্ষণে ভূমিকা পালন একজন মুসলমানের ঈমানি কর্তব্য। তাই মানবজীবনে সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। জাতি-বর্ণ-ধর্ম-সম্প্রদায়-দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে কর্তব্যনিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ, দেশ ও জাতিকে পুনর্গঠন করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
এখন শ্রদ্ধাবোধ বিলুপ্ত প্রায়। মূল্যবোধের অভাব ঘটেছে সামাজিক অবক্ষয়ে। তাই সমাজ তথা দেশ আজ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। চাঁদাবাজি, ডাকাতি, লুটপাট, ছিনতাই, হত্যা, গুম, সন্ত্রাস, অন্যায়-অবিচার, হিংসা, অহংকার এতো অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে যে এ দেশের জনগণ দিগি¦দিক ছুটছে এতটুকু শান্তির আশায়। মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তাই এ অঞ্চলের আকাশে শান্তির শ্বেত কপোত এখন আর ডানা মেলে উড়ছে না। কেন আজ এ অরাজক পরিস্থিতি? কেন মানুষ আজ দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে? কেন এ দেশের অভিধান থেকে শান্তি শব্দটি মুছে যাবার উপক্রম হয়েছে? আমরা যদি এর কারণটা বিশ্লেষণ করতে যাই তাহলে দেখা যাবে, মূলতঃ আদর্শের অভাবের কারণেই জ্বলছে অশান্তির আগুন। সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে আজ আদর্শের অনুপস্থিতি। এটা অবশ্যই বলার অপেক্ষা রাখে না যে আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে চাই আদর্শ মানুষ। যুগে যুগে জগতকে আনন্দ, শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন আদর্শবাদীরাই। যারা বৃহতের চিন্তা করে তারা পৃথিবীতে বৃহৎ কল্যাণ আনয়ন করে। চলার পথে লক্ষ্য করি কিছু কিছু মানুষ আদর্শের জয়গান মিশ্রিত বাক্য বর্ষণ করে, কথা বলে বা বিবৃতি দিয়ে থাকে আদর্শের, কিন্তু তাদের কর্মে, তাদের আচরণে বা তাদের ব্যবহারে আমরা আদর্শের কোন চিহ্ন খুঁজে পাই না। মনীষী জন এফ. ভন বলেছেন সব মানুষই আদর্শবান নয়। কিছু কিছু লোকের মধ্যে আদর্শের ভান রয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে প্রত্যেক ধর্মেই। তাদেরকেই আদর্শ মানব হিসেবে অভিহিত করা হয় তাদের নিজেদের কৃতকর্মের জন্যেই। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের কাছে আদর্শের শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে মহান আল্লাহর প্রিয়তম হাবীব হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)। তাঁর জীবনী পাঠ করলেই আমরা সত্যিকার আদর্শ কি, আদর্শ কাকে বলে, তা অনুধাবন করতে পারি। মনীষী রাসকিন বলেছেন আদর্শ হচ্ছে, এমন এক প্রহরী যা মানুষকে সৎপথে চলতে শেখায়। শেরে বাংলার ভাষায়, ঐক্য, বিশ্বাস, ধৈর্য ও সহনশীলতা আদর্শ ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য। আদর্শকে সমর্থন ও প্রশংসা করতে গিয়ে মনীষী মালিয়ার বলেছেন, তুমি যদি তোমার আদর্শে অবিচল থাক, আইন তোমাকে কুর্নিশ করবে।
আদর্শবান লোকেরাই একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে পারে। সমাজের বিভ্রান্ত লোকরা তাদের জীবনকে সুখময়, শান্তিময় করার জন্যে, তাদের জীবন চলার পথকে সুগম করার জন্যে আদর্শ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে চায়, যেহেতু আদর্শ ব্যক্তির জীবনে থাকে অনেক গুণের সমাহার। মানসিক গুণাবলীর শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, জীবনের সার্বিক কর্মকা-ে সফলতার অনাবিল স^াক্ষর। আমরা আদর্শবান ব্যক্তির অনেক গুণাবলীর একটি গুণ সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করতে চাই আর তা হলো শিষ্টাচার। আরো সহজভাবে বলতে গেলে আচার-আচরণ, আদব বা ব্যবহার। শিষ্টাচার বা সৌজন্যেবোধ হলো মানুষ মানব চরিত্রের অলঙ্কার। যেসব গুণাবলী মানব চরিত্রকে সুন্দর আকর্ষণীয় ও গৌরবান্বিত করে তোলে তার মধ্যে শিষ্টাচার হচ্ছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের কার্যকলাপে, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে যখন ভদ্রতা প্রকাশ পায় তখন তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় শিষ্টাচারের নিদর্শন। জীবন চলার পথে প্রতিটি মানুষ অনেক মানুষের সংস্পর্শে আসে। এর ফলে আচার-আচরণে কথাবার্তায়, ভাব বিনিময়ে, লেনদেনে মানুষ একে অপরের মুখোমুখি হয়। মানুষ নানাভাবে সম্পৃক্ত থাকে তার সংসার জীবনে, সমাজ জীবন বা রাষ্ট্রীয় জীবনে। তাই জীবন চলার পথে শিষ্টাচারের বা সৌজন্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। এটা অতি বাস্তব সত্য, সুন্দর ব্যবহার দিয়ে মানুষের হƒদয় জয় করা যায়। শিষ্টাচার বর্তমান থাকলে সকল প্রকার সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকে। মনের উপর প্রভাব বিস্তার করা যায় ভালো আচরণে। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি না থাকলে বিষাক্ত হয়ে উঠে জীবন। সর্বত্র দেখা দেয় অশান্তি। সুখ পালিয়ে যায় জীবন থেকে। সমাজ জীবনকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয় হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় প্রবল অশান্তি। তাই শিষ্টাচারের অভাব সমাজের জন্য ক্ষতিকর। চমৎকার আচার-আচরণে, বিনম্র ব্যবহারে, সৌজন্যবোধে, ভদ্রতায় উত্তম মানুষের প্রকৃত পরিচয় নিহিত। সামাজিক পরিবেশ শান্তিময় করে, জীবনকে করে সুন্দর। জাতীয় জীবনে সুনাম ও সমৃদ্ধি আনয়ন করে। মনীষী এডিসনের ভাষায়, শিষ্টাচার উপরওয়ালাকে অমায়িক স^ভাবাপন্ন, সমপর্যায়ের লোকদের প্রীতিকর আর অধঃস্তনদের মেনে নিতে বাধ্য করে। তাই ব্যবহারটাই মানুষের মার্জিত এবং শোভন হওয়া উচিৎ অথচ নৈতিক অবক্ষয়ের ক্রান্তিলগ্নে পরস্পর পরস্পরের প্রতি যে ব্যবহার আমাদের দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে তা কখনো আমাদের জন্যে কল্যাণময় হতে পারে না।
রাজনীতিবিদদের প্রথম এবং প্রধান শর্তই হলো দেশপ্রেম। দেশের সদা জাগ্রত প্রহরী হচ্ছেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদরা। কিন্তু আমাদের দেশের কোন কোন রাজনৈতিক নেতা যে ভাষায় বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে থাকেন জনগণ তা শুনে হতবাক হয়ে যায়। একদল অপর দলের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি, একে অপরের প্রতি অশালীন, অমার্জিত ব্যবহার, প্রশাসন দলীয়করণ এখন আমরা প্রতিনিয়তই লক্ষ্য করছি। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকে নিয়েও আমরা কিছু রাজনীতিবিদের অশালীন, অমার্জিত অনেকটা অশ্লীল মন্তব্য শুনে থাকি। সংসদে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়কালে রাজনীতিবিদদের রুঢ়, অশোভন ব্যবহার টেলিভিশনের পর্দায় অনেকবার লক্ষ্য করেছি। মিছিলের মধ্যেও অমার্জিত, অশ্লীল বাক্য আমরা অনেক সময় শ্রবণ করেছি। অনেক সময় এমনও দেখা যায় প্রত্যেক দলের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্ব। একে অপরের সাথে হিংসা-বিদ্বেষ। একে অপরের প্রতি দুর্ব্যবহার সাধারণ জনগণের জানতে বিলম্ব হয় না। ডেল কার্নেগী ভাষায়, আমার জনপ্রিয়তা, আমার সুখ নির্ভর করবে আমি কেমন করে লোকের সঙ্গে ব্যবহার করবো তার উপর। নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা জনগণের সাথে ভালো ব্যবহার করলেও প্রতিদ্বন্দ্বির সাথে খুব একটা ভালো ব্যবহার করে না। নির্বাচনী ভাষণগুলো লক্ষ্য করলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি একে অপরের চরিত্র নিয়ে কথা বলতেও বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করে না। মানুষের সাথে ব্যবহার সম্পর্কে শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর একটি অত্যন্ত মূল্যবান হাদীস রয়েছে। সেটি হলো- ব্যবহারের বিনিময়ে ভালো ব্যবহার এটার নাম ভালো ব্যবহার নয়, মন্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভালো ব্যবহার এটাই ভালো ব্যবহার। মনীষী এন্ডমন্ডবার্গ বলেছেন, শক্রর সঙ্গে সবসময় ভালো ব্যবহার করলে সে একদিন বন্ধুতে পরিণত হবে।
চলার পথে আমরা লক্ষ্য করি, প্রতিদিন আমাদের জীবন থেকে অনেক মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কারো কারো স্মৃতি, কারো কথা আমরা অনেকদিন ভুলতে পারি না। একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যারা চলে গেছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ অনেক গুণেগুণান্বিত না হলেও একমাত্র মধুর বা ভালো ব্যবহারের জন্যে তারা আমাদের হƒদয়ে অমর হয়ে আছেন। একমাত্র সুন্দর ব্যবহারের জন্যেই আমরা তাদের ভুলতে পারি না। মনীষী এডওয়ার্ড জন বলেছেন, মৃত্যুর পরে যে মানুষ সাধারণ মানুষের হƒদয়ে অমøান হয়ে থাকে সেটা হচ্ছে তার ব্যবহার। মনীষী জর্জ মূরও অনেকটা একই রকমভাবে বলেছেন। তার ভাষায়, সুন্দর নির্মল ব্যবহার মৃত্যুর পরেও মানুষকে স্মৃতিতে অমøান করে রাখে।
জীবন চলার পথে আমরা অনেক সময় কারো সাথে অমার্জিত ব্যবহার করি। একটু ব্যতিক্রম হলেই রুঢ় আচরণ করি, অনেক সময় আমাদের উপর কেউ যদি বিরূপ বা অন্যায় ব্যবহার করে তখন আমরা সহ্য করতে পারি না। অন্যের ব্যবহারে নিজে বিরক্ত হয়ে থাকলে ধরে নিতে হবে নিজের ব্যবহারেও অন্যরা আঘাত পায়। অশোভন, অমার্জিত অশালীন ব্যবহারে আমরা ক্রোধ প্রদর্শন করি। মনীষী কনফুসিয়াস বলেছেন, অন্যের প্রতি ভুলেও সেরকম ব্যবহার করতে নেই। আবার এ কথাও সত্য যে, অনেক সময় কেউ এমন ব্যবহার করে যে সহ্য করাটাও অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। মনীষী জেমস হুইট বলেছেন, নির্দয় ব্যবহার সহনশীল লোকেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। অনেক সময় অন্যায় ব্যবহারকে বিভিন্ন কারণে সহ্য করে যেতে হয়। তাতেই অনেক সময় কারো কারো ক্ষতি হয়ে যায়। মনীষী ইমারসন বলেছেন, ভালো ব্যবহার করতে গেলে ছোট ছোট স^ার্থ ত্যাগ করতেই হয়। ধনী এবং গরিবের সাথে আমরা কি ভাবে ব্যবহার করবো তার একটি ইংগিত দিয়েছেন আমাদের বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)। তিনি বলেছেন, ধনীর সঙ্গে আত্মমর্যাদা বজায় রেখে কথা বলবে আর দরিদ্রের সাথে আত্মমর্যাদা ভুলে কথা বলবে। তোমার স^াভাবিক ব্যবহার ও বিনয় অকৃত্রিম হতে হবে। আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) বলেছেন, আল্লাহর সৃষ্ট জীবের সাথে সৎ ব্যবহার করলে যে পরিমাণ খোদার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা আর কোন পন্থায় সম্ভব হয় না।
সংসার জীবন পালন করতে গিয়ে অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের একে অপরের সাথে ভুল বুঝাবুঝি হয়, অনেক সময় ঝগড়াও হয়। তখন এক সদস্য আরেক সদস্যের সাথে খারাপ ব্যবহার করে। শ্রদ্ধাভাজন ও স্নেহভাজনের ব্যবধানও রাগের মাথায় অনেক বেমালুম ভুলে যায়। একজন অন্যজনের সাথে অমার্জিত, অশালীন ব্যবহার করতে কার্পণ্য করে না। সংসার জীবন পালন করতে গিয়ে মনীষী কিমারের একটি মূল্যবান বাণী আমাদের সবসময় স্মরণ রাখা উচিৎ। তিনি বলেছেন, ‘সংসারের প্রত্যেকের সাথে ভালো ব্যবহার করো কারণ কখন কার সাহায্য প্রয়োজন হয়ে পড়বে বলা যায় না।’ সংসার জীবন নিয়ে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে এটিকে একটি চিরন্তন সত্য বাণী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। মানুষের সাথে ব্যবহার সম্পর্কে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন ড. লুৎফর রহমান এভাবে, মানুষের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করে যে খোদার সঙ্গে প্রেম করতে চায় তার বুদ্ধি কম। অন্যায় ও পাপে জীবনকে কলঙ্কিত করো কোন ক্ষতি নেই, আল্লাহকে ডাকলেই সকল পাপ ধুয়ে যাবে এটা যে মিথ্যা এ কথা সকলেই বিশ্বাস করো। আমাদের অনেক বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষী, যেমন রয়েছে তেমনি শত্রুর সংখ্যাও কম নয়। বন্ধু এবং শত্রুর সাথে কিভাবে ব্যবহার করবে সে সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন মনীষী প্লেটো, তার ভাষায়, বন্ধুর সাথে এরূপ ব্যবহার করো যাতে বিচারকের শরণাপন্ন হতে না হয় আর শত্রুর সাথে এরূপ ব্যবহার করো যাতে বিচারকের দ্বারস্থ হলে তুমি জয়ী হও।
জীবন চলার পথে আমরা বাসে, সেলুনে, হোটেল-রেস্তোরাঁয় এবং বিভিন্ন জায়গায় একটি উপদেশ বাণী লক্ষ্য করি, তা হলো- ব্যবহারে বংশের পরিচয়। কেন আমরা এ উপদেশ বাণীটি যত্রতত্র লক্ষ্য করি? নিশ্চয়ই আমাদের ব্যবহারের মধ্যে ত্রুটি রয়েছে। আমার পরিচিতজনদের মধ্যে অনেককেই দেখেছি পিতার বয়সী রিকশা ও টেক্সি ড্রাইভারদের সাথে তুই-তোকারি করে কথা বলতে। অনেককেই দেখেছি ঘরের কাজের ছেলে বা কাজের মেয়ের নামটি বিকৃত করে ডাকতে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারীদের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতে, এভাবে অনেক দৃষ্টান্তই তুলে ধরা যায়। ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং সম্পদশালীদের অনেক দুর্ব্যবহারের ঘটনা পত্রিকায় আমরা নিয়মিত দেখতে পাই। আমাদের মধ্যে হিংসার মাত্রাও কম নয়। অপরের সফলতাকে আমরা অনেক সময় সহ্য করতে পারি না। অপরের উন্নতিতে আমাদের অনেকের গাত্রদাহ হয়। অনেক সময় অপরের আনন্দের নির্মল হাসিটাও সহ্য করা সম্ভব হয় না। অথচ আমরা অনেকেই নিজেদের মহৎ এবং মহান বলে দাবি করি। ডেল কার্নেগী বলেছেন, একজন মহান ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বোঝা যায় ছোটদের সাথে তার ব্যবহারে। আমরা সমাজে বাস করি তাই আমাদের শান্তি বজায় রাখতে হবে। সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আমরা পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। আমাদের উদ্দেশ্য হতে হবে একটি সুখী সমাজ গঠন করা। প্রবোধ কুমার স্যানাল বলেছেন, মানুষের পরিচয় ব্যবহারে, মানুষ আত্মীয় হয়ে উঠে ঘনিষ্ঠতায়। আমরা অর্থ, বিত্ত, সম্পদ নিয়ে অহঙ্কার করি, ক্ষমতা নিয়ে অহঙ্কার করি, বংশ মর্যাদার অহঙ্কার করি, আভিজাত্যের অহঙ্কার করি, আমরা বিদ্যা এবং জ্ঞানের গর্ব করি, আমরা পারিবারিক ঐতিহ্যের অহঙ্কার করি, আমরা প্রতিভার গর্ব করি, আমরা বুদ্ধিজীবী হিসেবে গর্ববোধ করি। এভাবে বলতে গেলে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। অনেক গুণে গুণান্বিত হলেও আমাদের অনেকের মধ্যে ব্যবহারের সৌন্দর্য নেই। আমরা অনেকেই অন্যদের সাথে ভালো ব্যবহার করি না, ভালো ব্যবহার করতে পারি না, ভালো ব্যবহার করতে জানি না। মনীষী ডেমোন্যাক্স বলেছেন, যে ব্যবহার জানে না তার গর্ব করার কিছুই নেই। একমাত্র ভদ্র, বিনয়ী ও অমায়িক ব্যক্তিরাই ভালো ব্যবহার করতে জানে। ভালো ব্যবহার করার গুণ তাদের মাঝেই বিদ্যমান। আমাদের শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যারা বিনয়ী, ভদ্র ও অমায়িক তারাই আমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়। এ ব্যবহারের প্রশংসা করতে গিয়ে মনীষী ক্রোচ বলেছেন, সূর্য যেমন প্রতিদিন উঠবে, বাতাস যেমন বইবে তেমনি মৃত্যুর পরও সুন্দর ও নির্মল ব্যবহারের জন্য মানুষ মানুষের হƒদয়ে চির- জাগরুক থাকবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন