শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে থেকে মোহাম্মদ আলী ক্লে

প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোস্তফা আল মুজাহিদ
১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের লুইসভিল কেন্টাকিতে আফ্রিকা-আমেরিকান মধ্যবিত্ত পরিবারে  জন্মগ্রহণ করেছিলেন ক্যাসিয়াস মার্সেলাস ক্লে। ১৯৫৪ সাল বয়স তখন তার ১২। কিশোর ক্লের লাল রঙের একটি সাইকেল ছিল। সেটি এক দিন চুরি হয়ে গেল। ক্লে প্রচ- রেগে গেলেন। স্থানীয় পুলিশ অফিসার মার্টিনের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন এবং মার্টিনকে বলেন, যদি আমি চোরকে পাই তাহলে তাকে একটা ঘুষি মারব। কিশোর ছেলেটাকে মার্টিনের খুব পছন্দ হয়েছিল। মার্টিন আবার একই সাথে বক্সিং কোচও ছিলেন। মার্সেলাস ক্লেকে বললেন ঘুষি মারতে হলে তোমাকে আগে ঘুষি দেয়া শিখতে হবে। মার্টিন স্থানীয় একটি জিমে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে গিয়ে কিশোর ক্যাসিয়াস ঘুষি মারা শিখতে থাকে। শিখতে শিখতে দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন জেদি, স্বাধীনচেতা এই কিশোর হয়ে ওঠেন এক সময়ের কিংবদন্তি বক্সার। জীবনের ৬১টি আন্তর্জাতিক খেলার মধ্যে ৫৬টি জিতে যান, যা রীতিমতো বিস্ময়কর এমনকি তিনবার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের এই বক্সারকে।
১৯৬৪ সালে তিনি খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের ছায়াতলে আসেন। নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন প্রশংসিত নাম মোহাম্মদ আলী। সভ্যতার দেশ বলে পরিচিত আমেরিকায় তিনি দেখতে পান মাত্রাতিরিক্ত অসভ্যতা। বর্ণ বৈষম্যের জঘন্য রূপ। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন যে কারণে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ারে বসতে দেয়া হতো না। একজন কিংবদন্তি খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও তাকে শ্বেতাঙ্গদের হোটেল থেকে খাবার দেয়া হয়নি। হিন্দুধর্মে ‏ব্রাক্ষণরা শুদ্রদের সাথে যেমন কুকুরের মতো আচরণ করে। তাদেরকে একটা জানোয়ারের সমান অধিকারও দিতে চায় না। খ্রিষ্ট্রধর্মের শ্বেতাঙ্গরাও এদিক থেকে হিন্দুধর্মের ব্রাক্ষণদের অনুরূপ তারা কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষ হিসেবে বিচার করতে চায় না। ইসলাম শুধুমাত্র এই অধিকারের ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। ইসলামের নবী জাতি-বর্ণের মারাত্মক বিভেদকে দু’পায়ে দলিত-মথিত করেছিলেন। জাহেলি যুগের ঘৃণীত এই রসম-রেওয়াজকে চিরতরে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, সবাই একই পিতার সন্তান। সবার সৃষ্টি মাটির থেকে, কেউ কারোর চেয়ে সম্মানিত নই তাকওয়া ছাড়া। হুজুর সা: বলেছিলেন ‘হে লোক সকল তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতৃপুরুষও এক। তোমরা সবাই আদম সন্তান। আর আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি সেই যে তোমাদের মধ্যে আল্লাহকে ভয় করে। কোনো অনারবের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই কোনো আরবের কেবল তাকওয়া ছাড়া।’ (কানযুল উম্মাল)

আফ্রিকা-আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের ব্যাপারে কাজ করত। ‘নেশন অফ ইসলাম’ নামের একটি সংগঠনের সাথে তিনি পরিচিত হন। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলেন ইসলাম সাদা-কালোর, কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না, সবাই সমান। বিষয়টি জেনে তিনি খুবই আলোড়িত হন। শেষ পর্যন্ত ইসলাম কবুল করেন।
এ যেন খায়বারের সেই রাখালের ইসলাম কবুলের ইতিহাস। হুজুর সা: যখন খায়বার দুর্গ অবরোধের জন্য গেলেন এবং  কয়েক দিন ধরে দুর্গ অবরোধ করে রাখলেন। একজন রাখাল দুর্গ থেকে তার বকরিসহ বের হলো। মনে চিন্তার উদ্রেক হলো রাখালের। কী কারণে এই লোকগুলো মদিনা থেকে এত কষ্ট করে এখানে এসেছে? এদের চাওয়া-পাওয়া কি? এদের বুনিয়াদি দাওয়াতই বা কি? কেনই বা আমাদের খায়বার দখল করতে এসেছে? একজন সাহাবীর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের বুনিয়াদি দাওয়াত কি? সাহাবী উত্তর না দিয়ে বললেন আমাদের নেতা মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে যাও তিনিই বুঝিয়ে  দেবেন। গরিব রাখাল ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। মনে মনে ভাবল আমার গায়ে দুর্গন্ধ, আমি কালো। কিভাবে আমি মদিনার রাষ্ট্রপতির সাথে কথা বলতে পারি? কিভাবে একজন সেনানায়কের সামনে দাঁড়াতে পারি? সারা জীবন তো এটাই দেখে এসেছে যে, সে একজন রাখাল তাই সম্মানিত, ধনাঢ্য, উচ্চপদস্থ লোকের সঙ্গে তার কথা বলা অবমাননাকর মনে করবে। সাহাবী তাকে নিশ্চয়তা দিলেন। আমাদের নেতা অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। তাঁর কাছে ধনী-গরিব, শাসক-শাসিত, সাদা-কালো কোনো পার্থক্য নেই। রাখাল একবুক বিস্ময় আর ভয় নিয়ে গেলেন প্রিয় নবীজীর কাছে। হৃদয়ে জমে থাকা প্রশ্নগুলো করলেন। হুজুর উত্তর দিলেন। বললেন, তুমি যদি ইসলাম কবুল করো তাহলে আমরা তোমাকে বুকে জড়িয়ে নেবো। তোমার কালোকে আল্লাহ শুভ্রতায় পরিণত করে দেবেন। তোমার শরীরের দুর্গন্ধ সুগন্ধিতে পর্যবসিত হবে। সতিই কি তাই? আমাকে বুকে জড়িয়ে নেবেন? হ্যাঁ তাই। সেই রাখাল ইসলামের এই আদর্শে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করেছিলেন। ইতিহাসে তার নাম আসওয়াদ। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
দেড় হাজার বছর পর হলেও কৃষ্ণাঙ্গ এই আফ্রিকান- আমেরিকান ইসলামের সুমহান এই আদর্শের কাছে পরাজিত হলেন। তার পরিবর্তিত নাম মোহাম্মদকে এত বেশি ভালোবেসেছিলেন যে, একবার তার প্রতিপক্ষ নর্টন তাকে ক্যাসিয়াস বলে সম্বোধন করলে তাকে খেলার ভেতর নক আউট করার পূর্বে একেকটা ঘুষি মারছিলেন আর বলছিলেন  ‘হোয়াট ইজ মাই নেম’ কারণ এই নামের  ভেতরেই যে লুকিয়ে আছে বিপ্লব, বিদ্রোহ, ইসলামের চিরভাস্বর ইনসাফের বাণী।
এ নাম দিয়েই তো এই কিংবদন্তি আমেরিকার সা¤্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রচ- জোরে বক্সিং মেরেছিলেন। সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুষ্টাঘাত করেছিলেন। শুধু মুষ্টিযোদ্ধাই ছিলেন না, একই সাথে যেন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কালোদের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তিনি যখন খেলতেন তখন একাই খেলতেন না, সব কালোরা যেন তার সঙ্গী হয়ে যেত এবং সমর্থন জোগাতো।
১৯৬৬ সালে তিনি আমেরিকান সৈনিকে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালে তাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের জন্য ডাক আসে। তখন আমেরিকা ভিয়েতনামের সাথে যুদ্ধরত ছিল। মানবতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাইতো তিনি সরকারের মুখের ওপর ‘না’ করে দেন। যে কারণে সরকারের রোষানলে পড়েন। ইচ্ছার স্বাধীনতা দিতে ব্যস্ত আমেরিকা তখন তার খেলার লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল করে এবং জরিমানা করে। এমনকি তিন বছর যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাকে জেলে থাকতে হয়েছে। আমেরিকা প্রশাসন তাকে গ্রেফতার করেছিল। সরকারের ভিয়েতনাম আগ্রাসনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘আমার ধর্মজ্ঞান বলছে এ যুদ্ধ ঠিক নয়। কেন আমি আমার এক ভাইয়ের দিকে গুলি ছুড়ব? কিছু দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও অভাবী মানুষের বিরুদ্ধে সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের মানে কি? তাদের সঙ্গে আমার কোনো বিবাদ নেই। তারা আমাকে কালো বলে গালি দেয়নি। তারা আমার ক্ষতি করেনি। তাহলে তারা কেন আমাকে উর্দি পরিয়ে ১০ হাজার মাইল দূরে পাঠিয়ে ভিয়েতনামবাসীর ওপর বুলেট আর বোমা মারতে বলবে? অথচ আমাদের লুইসভিলে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে কুকুরের মতো আচরণ করা হয়। পৃথিবীর বুক থেকে এই অবিচার বন্ধ হওয়া উচিত। আমি এসব অন্যায় কাজের মধ্যে নেই।’  
মোহাম্মদ আলীর মতো প্রতিটি আমেরিকান যদি সহজ এই কথাগুলো বুঝত তাহলে মানবতার বিরুদ্ধে অন্যায়, অস্ত্রধারণ বন্ধ হয়ে যেত। বনি আদমের রক্তের তীব্র ¯্রােতের মুখে লাগাম পরানো যেত। শরণার্থীও আর কাউকে হতে হতো না। অসহায় মানুষের সাগরে সলিল সমাধি দেখতে হতো না আজকের সভ্য পৃথিবীকে। ‘নেশন অফ ইসলাম’ নামের সংগঠনটি ইসলাম ও খ্রিষ্টানদের সমন্বয়ে নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিল। তিনি সেটা বুঝে সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১৯৭৫ সালে সুন্নি মুসলিম হন।
১৯৭৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশের মানুষ তাকে অভূতপূর্ব অভ্যর্থনা জানায়। তিনি বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাকে তাড়িয়ে দিলে কি হয়েছে বাংলাদেশ তো আছে’।
বাংলাদেশ তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেন। বাংলাদেশের রূপ সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘স্বর্গ দেখতে চাইলে বাংলাদেশ ঘুরে আসুন’।
ইসলামের প্রতি এতটাই আকর্ষণ বোধ করেন যে, বলতে বাধ্য হন ‘আমাকে যদি বক্সিং ও ইসলাম এই দুটোর মধ্যে কোনো একটি বেছে নিতে বলা হয় তাহলে অবশ্যই আমি ইসলাম নেবো’। কোরআনের সেই আয়াত, ‘আল্লাহ যার বক্ষ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, অতঃপর সে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত আলোর মাঝে রয়েছে’। (সূরা : যুমার-২২)
৩২ বছর দুরারোগ্য পারকিনসন রোগের সঙ্গে লড়াই করে ২০১৬ সালের ৪ জুন ৭৪ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মোহাম্মদ আলীরা যুগে যুগে জন্মায় না মোহাম্মদ আলীদের জন্য অপেক্ষা করতে হয় শতাব্দীর পর শতাব্দী। আল্লাহ তার ত্রুটিগুলো মার্জনা করে উত্তম জাযা দান করুন।   
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন