ইফতেখার আহমেদ টিপু
অর্থমন্ত্রী তার বাজেটকে উচ্চাভিলাষী হিসেবে স্বীকার করেছেন। বাজেট-উত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, বাজেটের অর্থায়নে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করে দেয়া হয়েছে তা আসলেই উচ্চাভিলাষী। এ লক্ষ্য অর্জন যে কষ্টসাধ্য বিষয়টি মেনে নিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন তা অসম্ভব নয়।
বাজেটে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দাবি অনেকাংশে পূরণ করা হলেও তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ কর বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, কর বৃদ্ধির কারণে অনেক গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একই ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে।
বাজেট নিয়ে সংশয়ের কথা বলা হয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পক্ষ থেকেও। ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে প্রস্তাবিত বাজেটের তীর-ধনুকে লক্ষ্যভেদ করা যাবে কিনা সে বিষয়ে সংশয়ের কথা বলেছেন তারা।
অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পরপরই তা নিয়ে শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীরা চান ব্যবসাবান্ধব বাজেট, উদ্যোক্তারা চান দেশীয় শিল্পে সুবিধা আর চাকরিজীবীরা তাদের বেতন-ভাতা সুবিধা বাড়ছে কিনা সে বিষয়ে উদগ্রিব থাকেন। সাধারণ মানুষের চাওয়া থাকে আয়, কর্মসংস্থান বাড়ছে কিনা, জিনিসপত্রের দাম সহনীয় থাকছে কিনা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে কিছু কিছু করে সব খাতের চাওয়া পূরণের চেষ্টা রয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে।
দেশীয় শিল্পে কিছু সুরক্ষা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। দেশের রাসায়নিক শিল্প খাতকে উৎসাহিত করতে কাগজ, সিরামিক ও রাবার শিল্পের কিছু উপকরণে শুল্ক কমানো হয়েছে। নির্মাণ খাত চাঙা রাখতে এ খাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ হোল্ডার স্টোন, ক্রাশ স্টোন, বার, অ্যাঙ্গেল, ফ্লাই অ্যাশসহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার ও বায়োগ্যাস প্লান্টের উপকরণে শুল্ক কমানো হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত উপকরণের শুল্কছাড় অব্যাহত রাখায় বেসরকারি খাতে অবকাঠামো সুবিধা বাড়বে। ফলে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
পরিবহন খাতের সুবিধায় মোটরসাইকেল সংযোজন শিল্প ও হিউম্যানহলার তৈরিতে ব্যবহৃত মূলধনী পণ্যে শুল্কছাড় রয়েছে। বাজেটে কৃষি খাত তথা কৃষককে কিছু দেয়ার চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতে ব্যবহৃত বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ককর অব্যাহতি বহাল রয়েছে। চাল আমদানিতে শুল্কহার ১০ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ প্রস্তাব করায় ধান উৎপাদনে কৃষক নায্যমূল্য পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে এসব পণ্যের শুল্কছাড়ে অব্যাহতি বহাল রাখা হয়েছে। তবে মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করে যেসব সুবিধা পাওয়া যায় তার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৩ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মোবাইল ব্যবহারে ব্যয় বাড়বে।
দেশে ছাত্র, কিশোর ও তরুণদের মধ্যে মোবাইল ফোন ও সিম ব্যবহার করে ইন্টারনেট সেবা নেয়ার প্রবণতা বেশি। ফলে এ নিয়ে তরুণ প্রজন্মের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্যও বাজেটে বিশেষ সুযোগ রয়েছে। নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী এতদিন শুধু বর্ধিত মূল বেতন পেয়ে আসছিলেন জনপ্রশাসনের কর্মচারীরা। নতুন বাজেট কার্যকর হওয়ার দিন অর্থাৎ এ জুলাই থেকে তারা বর্ধিত ভাতাও পেতে থাকবেন। বেসরকারি চাকরিজীবীদের নগদ কিছু না দিলেও ভবিষ্যতে তাদের কিছু দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেটে বেসরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে কাজও করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী বাজেট থেকে পাইলট ভিত্তিতে এর কার্যক্রম শুরু হতে পারে। বাজেট যদি হয় একটি বছরের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এভাবেই সব খাতে কিছু দেয়ার চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অবশ্য এর বিনিময়ে অর্থমন্ত্রীরও কিছু প্রত্যাশা রয়েছে। তার চাওয়া হচ্ছে, বাজেটের প্রস্তাব অনুযায়ী কর ও ভ্যাট দিয়ে সহায়তা করবেন ব্যবসায়ীরা।
এই অল্প অল্প প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কারণ প্রস্তাবিত বাজেটের ব্যয় মেটাতে গিয়ে যে বিশালাকারের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হয়েছে তা অর্জনের জন্য এ ছাড়া আর উপায়ও ছিল না তার। বাজেটে কৃষকদের কল্যাণে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ সীমাবদ্ধতা দুর্ভাগ্যজনক এবং তা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে।
ষ লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন