মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

গুপ্তহত্যার সাম্প্রদায়িক লক্ষ্য এবং রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র

প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
এক বা একাধিক সংঘবদ্ধ গুপ্তঘাতকচক্র দেশে সিরিজ টার্গেট কিলিং-এ মেতে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক হত্যাকা-ের ঘটনায়  সর্বশেষ দেশের সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কয়েকজন লোক যুক্ত হয়েছেন। পাবনায় একজন খ্রিস্টান ব্যবসায়ী ও হিন্দু মন্দিরের একজন সেবায়েত সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়ার পর কিছু সংখ্যক হিন্দু নেতার প্রতিক্রিয়া দেশবাসীর মধ্যে বড় ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। পাবনার অনুকূল চন্দ্র ঠাকুর সেবাশ্রমের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পা-ে নিহত হওয়ার পর ভারতীয় হাইকমিশনের কূটনীতিকদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের প্রসিকিউটর রানাদাশ গুপ্ত এবং বিশিষ্ট অভিনেতা পিযুষ বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ভারতের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। গত সপ্তাহে চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। গত শুক্রবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৭ দিনের জন্য এই অভিযান শুরুর কথা থাকলেও মিতু হত্যার পর থেকেই মূলত এই অভিযান শুরু হয়েছে। প্রথম দুইদিনেই অন্তত চারজন সন্দেহভাজন কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে বলে জানা যায়। এই অভিযানের মধ্যেই নিত্যরঞ্জন পা-ে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলেন। যেখানে গত কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-, গুম বা নিখোঁজ হওয়ার পর আর ফিরে না আসার ঘটনা পুরো জাতির জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তখন একজন দু’জন হিন্দু বা খ্রিস্টান আক্রমণের শিকার হওয়ার ঘটনাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। নিজ ফ্লাটে গুপ্তঘাতকদের হাতে সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনী ও সাগর সরওয়ার নিহত হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনীদের ধরতে পারবেন বলে সকলকে আশ্বস্ত করলেও খুনীদের ধরা অনেক দূরের কথা, ঘটনার ২৪ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও সেই হত্যা মামলার কোন ক্লু খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ। এরপর একাধিক পীর, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন এমনকি একাধিক দেশের কূটনীতিকরাও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন। ইতালীয় এবং জাপানী নাগরিকদের মৃত্যু আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও আলোড়ন তুলেছিল। এমনিতেই বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার  কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশ বাংলাদেশে আগমন এবং চলাফেরায় তাদের নাগরিকদের প্রতি বিশেষ সর্তকতা জারি করেছে। বিদেশী কূটনীতিক থেকে শুরু করে সমাজে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি-পেশার মানুষ পর্যন্ত কারোই নিরাপত্তা নেই। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, একের পর এক হত্যাকা- সংঘটিত হলেও প্রকৃত অপরাধিরা ধরা পড়ছে না। ঘটনার সাথে সাথে একদিকে সরকার এবং রাজনৈতিক পক্ষগুলো পারস্পরিক দোষারোপ বা ব্লেইম গেমে লিপ্ত হচ্ছে। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরাও পেশাদারিত্বের কথা ভুলে গিয়ে অনেকটা রাজনৈতিক নেতাদের মতো বক্তব্য ও মন্তব্য করে চলেছেন। বিশ্লেষক ও সমালোচকদের মতে হত্যাকা- নিয়ে সরকার এবং পুলিশ বাহিনীর প্রতিনিধিদের রাজনৈতিক পক্ষপাত ও বিরোধী দলের উপর দায় চাপানোর কারণে প্রকৃত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাচ্ছে। ফলে একের পর এক হত্যাকা- সংঘটিত হলেও বেশিরভাগ চাঞ্চল্যকর মামলা বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা কোন ক্লু খুঁজে বের করতে পারছে না। গত বছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক তাবেল্লা সিজারে এবং রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার আলুটারিতে জাপানী নাগরিক কুনিও হোশি আততায়ির হাতে নিহত হওয়ার পর যেমন এসব হত্যাকা-ের দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস বিবৃতি দিয়েছিল, ঠিক একইভাবে পরবর্তী অধিকাংশ হত্যাকা- নাশকতা এবং সর্বশেষ নিত্যরঞ্জন পা-ে হত্যাকা- পর্যন্ত আইএস’র দায় স্বীকারের তথ্য পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশ পুলিশ এদেশে আইএস নেটওয়ার্ক থাকার কথা বরাবরই অস্বীকার করলেও প্রতিটি হত্যাকা-ের পর সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার অভিযানে শত শত মানুষকে আটকের পর দু’চারজন জেএমবি অথবা হরকাতুল জিহাদ কর্মী আটকের তথ্য প্রকাশ করছে।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অধীনে একজন মানুষও আততায়ি, সন্ত্রাসী বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে বিনা বিচারে নিহত হোক, এটা কোন বিবেকবান মানুষ কামনা করে না। বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমবেশি শতকরা ১০ ভাগ হলেও দেশের পুলিশ বাহিনী বা জনপ্রশাসন ও ব্যাংকিং সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ পদে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হার তাদের জনসংখ্যার হারের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সরল গাণিতিক হিসাবে বিচার করলে এ কথা বলা যায়, গত কয়েক বছরে দেশে যেসব গুম, খুন, নাশকতা ও হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে তার মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা অনেক কম। সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম বা জাতপাত নেই। ওরা শুধুই অপরাধী ও হত্যাকারী। গত সপ্তায়  নাটোরে খ্রিস্টান ব্যবসায়ী সুনীল গোমেজ এবং পাবনায় হিন্দু মন্দিরের সেবায়েত নিত্যরঞ্জন পা-ে নিহত হওয়ার পর এ দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা এবং বাংলাদেশে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদি শক্তির হস্তক্ষেপ চাওয়ার যে দেশি-বিদেশী তৎপরতা চলছে তার পেছনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে দেশবাসীকে কিছুটা সন্দিগ্ধ করে তোলছে। এমনিতেই এ দেশে হিন্দুদের উপর কিছু হলে দেশের হিন্দু সমাজ ছাড়াও একশ্রেণির মানুষ অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখায়। নারায়ণগঞ্জে একজন হিন্দু শিক্ষক শ্যামল ভক্তকে স্থানীয় সংসদ সদস্য কান ধরে উঠবোস করানোর সামাজিক প্রতিক্রিয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রখ্যাত শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিমকে নির্মমভাবে হত্যা করার চেয়েও বেশি ছিল। পাবনায় নিত্যরঞ্জন  পা-ে নিহত হওয়ার পরও একইভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদেরও প্রতিবাদে মানববন্ধনে অংশ নিতে দেখা গেছে। নিজেদের সামাজিক অবস্থানের কথা ভুলে গিয়ে রানাদাশ গুপ্ত এবং পীযুষ বন্দ্যোপধ্যায়ের মতো ব্যক্তিরা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য ভারতের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সেই একই সময়ে দেশের বাইরেও হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের রক্ষা ভারত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালন করছেন। গত শনিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার্সিটি প্লাজায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা এবং কলামিস্ট সীতাংশু গুহের নেতৃত্বে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক হত্যাকা-গুলোর বিরুদ্ধে নিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বিশেষত সংখ্যালঘু হিন্দুদের রক্ষায় জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। এ দাবিকে সামনে রেখে তারা আগামী ২৬ জুন জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে একটি প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কারা একের পর এক এমন হত্যাকা- সংঘটিত করছে যার দায়ভার সরাসরি রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের উপর চাপানো হচ্ছে এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দু’একজন হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার পর সরাসরি ভারতীয় হস্তক্ষেপ কামনা করছে একশ্রেণির মানুষ? তাদের আসল উদ্দেশ্য কি? বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব প্রশ্ন সামনে এনে তোলপাড় করা হচ্ছে। দেশে তথাকথিত জঙ্গিবাদিদের কোন রাজনৈতিক টার্গেট থাকলে থাকতে পারে, তবে এটা কখনো আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতিকে আক্রান্ত করেছে এমনটা দেখা যায়নি। এখন সংখ্যালঘুসহ জনগণের জানমাল রক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনীতি নিরপেক্ষ পেশাদার ভূমিকার প্রত্যাশার বদলে ভারতীয় হস্তক্ষেপ কামনা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একশ্রেণির নেতা দেশে সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার বদলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ ও অনাস্থা বাড়িয়ে তোলার এজেন্ডা গ্রহণ করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
গত শতাব্দীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত শতাব্দীতে সংঘটিত দু’টি মহাযুদ্ধ এমনকি এই শতাব্দীর শুরু থেকে সংঘটিত প্রতিটি আন্তর্জাতিক সংঘাতের পেছনে কিছু রহস্যজনক জাতিগত তৎপরতা মূল ভূমিকা পালন করেছে। নিউইয়র্ক ও পেন্টাগনে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের বিমান হামলার জন্য সরাসরি আল-কায়েদা ও তালিবানদের দায়ী করে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে তছনছ করে বধ্যভূমিতে পরিণত করলেও বিশ্বে সন্ত্রাসের আকৃতি ও বিস্তার আগের চেয়ে বেড়েছে। ব্যাপক বিমান হামলা বা টার্গেটেড কিলিং এর মাধ্যমে একের পর এক জনপদ ধ্বংস বা দখল করা সম্ভব হলেও শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যে মোটেও সম্ভব নয়, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ফল্স ফ্লাগ অপারেশনের মাধ্যমে বিশ্বশক্তিগুলো তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সংঘটিত অপকর্ম প্রতিপক্ষ দেশ বা সম্প্রদায়ের উপর চাপানোর তৎপরতাও ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত বিষয়। বিশেষত নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার ঘটনায় কতিপয় আরব নাগরিকের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হলেও নাইন ইলেভেন বিশেষজ্ঞরা নানা হিসাব-নিকাশ ও তত্ত্ব হাজির করে অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন ওই বিমান হামলার নেপথ্যে ছিল ইসরাইলী জায়নবাদি ইহুদিদের হাত। নিউইয়র্কের ১১০ তলা বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্র এবং পেন্টাগনে ৪ হাজারের বেশি ইহুদি কর্মী ও ব্যবসায়ী অফিস করলেও সন্ত্রাসী হামলার দিন তাদের একজনও সে সব ভবনে কাজ করতে যায়নি। কেন যায়নি সে বিষয়ে এখনো কোন তদন্তও হয়নি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, নিউইর্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার আগেই সেখানে বিস্ফোরক স্থাপন করা হয়েছিল। নাইন-ইলেভেন হামলার পর রিপাবলিকান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জবুশ সরাসরি আল-কায়েদা(প্রকারান্তরে মুসলমান)’র উপর দায় চাপিয়ে সন্ত্রাসী তথা মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি নতুন ক্রুসেড শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে সেই যুদ্ধ এখনো অব্যাহত আছে। এই যুদ্ধের খরচ যোগাতে গিয়ে এক সময় মার্কিন অর্থনীতিতে ধস নামলেও যুদ্ধের জন্য অস্ত্র ব্যবসায় এবং করপোরেট অর্থনীতির লক্ষকোটি ডলারের উদ্ধার তহবিলের পাহাড়সম সম্পদ ইহুদি ব্যাংকারদের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ডি-স্টাবিলাইজেশন ও গৃহযুদ্ধের বিভীষিকায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অথবা পশ্চিম তীরে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মটিও ইতিমধ্যে বহুধা বিভক্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে এসব যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ও ব্লেইম-গেমে লাভ শুধুমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের।
কিছু অবকাঠামোগত মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান হাজির করে আওয়ামী লীগ সরকার যতই উন্নয়নের গালগল্প করুক। গত ৮-১০ বছর ধরে দেশের শিল্পখাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। সেই সাথে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ট্রাডিশনাল বাজারগুলোও বন্ধ হয়ে আছে। তবে ইতিপূর্বে বিদেশে অবস্থানরত অর্ধকোটির বেশি শ্রমিকের পাঠানো রেমিটেন্স এবং ২০ লক্ষাধিক গার্মেন্টস শ্রমিকের ঘাম ঝরানো বৈদেশিক মুদ্রায় দেশের অর্থনীতির চাকা এখনো বেশ ভালাভাবেই সচল রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও জন নিরাপত্তার সমস্যা না থাকলে আরো শত শত কোটি ডলারের বৈদেশিক বিনিয়োগ ও লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হলে দেশের অর্থনীতি এরই মধ্যে মধ্য আয়ের সারিতে উঠে যেত। তবে গত প্রায় এক দশকে বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও গার্মেন্টসসহ বৈদেশিক বাণিজ্য নানাবিধ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করলেও এ সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির উপর ভারতীয় বাণিজ্যিক আধিপত্যের নিয়ন্ত্রণ আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। এ সময়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈষম্য যেমন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে, সেই সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের একটি বড় খাতও চলে গেছে ভারতের হাতে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বিশ্বের সর্বোচ্চ বৈদেশিক রেমিটেন্স আয়ের দেশ ভারতে বাংলাদেশ থেকে বছরে ৪ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। গত দু-তিন বছরে এই অঙ্ক আরো অন্তত ২ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে বলে সাম্প্রতিক রিপোর্টে জানা যায়। বাংলাদেশ থেকে ভারতের রেমিটেন্স আয়ের পরিমাণ গ্রেট বৃটেন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কাতার, ওমান, ইতালী বা বাহরাইনের চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশের গার্মেন্টস, টেক্সটাইল ও এনজিও সেক্টরে কমপক্ষে ৫ লাখ ভারতীয় কাজ করছে বলে রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও এর প্রকৃত সংখ্যা আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশের অর্ধকোটি বৈদেশিক শ্রমিক বছরে যে পরিমাণ রেমিটেন্স দেশে পাঠায় তা দিয়ে সরকার দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কার্যকর উদ্যোগ নিতে না পারলেও এখন এর একটি বড় অংশ ভারতীয়রা দেশে নিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টির অবতারণা এ কারণে যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীলতা, বৈদেশিক বাণিজ্যে সংকট, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান স্থবির ও সঙ্কোচিত হলেও ভারতীয় অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলে এসব প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। আমাদের সরকার বছরের পর বছর ধরে ধর্ণা দিয়েও তিস্তার পানিচুক্তি অথবা যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বসাতে ভারতকে রাজি করাতে না পারলেও একতরফা বন্ধুত্বের নির্দশন স্বরূপ চাহিবামাত্র ভারতকে সবকিছু দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে। শুধু রাজনৈতিক বিরোধীরাই নয় দেশের সাধারণ মানুষও বর্তমান সরকারকে ভারতের কাছে নতজানু বা বশংবদ বলে মনে করছে। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদি বিজেপি নেতারা সংখ্যালঘু নির্যাতনের অবাস্তব অভিযোগ তুলে প্রায়শ বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের হুমকি দিয়ে থাকেন। এখন সন্ত্রাসী হামলায় একজন হিন্দু আশ্রমের সেবায়েতের মৃত্যুর অজুহাত সামনে রেখে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হত্যার ধুয়া তুলে এখানে ভারতীয় হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন এ দেশেরই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক সুবিধাভোগি ব্যক্তি। বিদেশে অবস্থানরত তাদের সহযোগি সম্প্রদায় একই সুরে বাংলাদেশে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের দাবি তোলতে শুরু করেছে।  
হিন্দুত্ববাদি বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আরএসএস’র নেতাদের কেউ কেউ ভারতকে মুসলমানমুক্ত করার নানাবিধ উপায় আবিষ্কার করতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গরুর গোশত খাওয়া অথবা গরুর গোশত রাখার অপরাধে অনেক মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। গতবছর ভারতের দাদরিতে আখলাক নামের এক মুসলমানকে বাড়িতে গরুর গোশত রাখার মিথ্যা অভিযোগ তুলে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। অবশেষে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, আখলাকের ঘরে কোন গুরুর গোশত ছিল না। তবে উত্তর প্রদেশের আজমগড়ে একটি মন্দিরে গরুর গোশতের টুকরো ছুড়তে গিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের হাতে ধরা পড়েছে সারদেশাই রাজদীপ নামের এক যুবক। একটি অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে কালো বোরখা পরিহিত একজন মন্দিরে মাংসের টুকরো ছুড়ে পালানোর সময় স্থানীয় জনসাধারণ তাকে আটক করার পর দেখল সে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের(আরএসএস) কর্মী সারদেশাই রাজদীপ। জনগণের হাতে ধরা না পড়লে হয়তো গরুর মাংস ফেলে হিন্দু মন্দির অপবিত্র করার অভিযোগ তুলে সেখানকার মুসলমান পাড়ায় হামলা করে আরেকটি ভয়াবহ দাঙ্গার সূত্রপাত করতো উগ্র ধর্মান্ধ হিন্দুরা। গত ৭ দশক ধরে ভারতে এভাবেই বছরে শত শত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটিয়ে হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা করেছে হিন্দু উগ্রবাদিরা।
জার্মান জাতিকে অন্ধ জাতিয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে ক্ষমতায় আরোহনের পরই এডলফ হিটলার ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী এবং একনায়কতান্ত্রিক করার নীলনকশা প্রণয়ন করেছিলেন। ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কমিউনিস্ট এবং ইহুদিদের দমনের কৌশল হিসেবে সমাজে সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। এই নীল নকশার অংশ হিসেবে জার্মান পার্লামেন্ট ভবন রাইখস্টাগে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ১৯৩৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত আগুন সন্ত্রাসে জড়িত থাকার অভিযোগে  মারিনাস ভ্যান ডার লুব নামের একজন প্রো-কমিউনিস্ট ডাচ লেবার পার্টির কর্মীকে আটকের পর মৃত্যুদ- দেয়া হয়। এরপর এই অজুহাত সামনে রেখে শুরু হয় জামার্নীতে কমিউনিস্ট ও ইহুদি দমনের রাজনৈতিক প্রশাসনিক তৎপরতা। দেশের অভ্যন্তরে হিটলারের রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং পুরো ইউরোপ জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি রচনা করেছিল। পশ্চিমারা দীর্ঘদিন ধরেই আইএস ও ইসলামি জঙ্গিবাদের জুজু দেখিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ খুঁজছে। প্রকারান্তরে এ অভিযোগ সরকারের শীর্ষ মহল থেকেও করা হয়েছে। সম্ভবত ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকায় বাংলাদেশে একটি অবাধ নির্বাচন ও ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদল নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলগুলো একমত হতে পারছে না। এহেন পরিস্থিতিতে দেশে সংঘটিত জঙ্গিবাদ  ও গুপ্তহত্যার ঘটনাগুলো সকল পক্ষের জন্য নিজস্ব ইস্যু তৈরি করে দিচ্ছে। একেকটি হত্যাকা-ের পর সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধীদলের উপর দায় চাপানোর সুযোগ, বিরোধীদলের পক্ষ থেকেও চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-কে সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা এবং আরেকটি ইস্যুকে ধামাচাপা দেয়ার কৌশল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ এবং আইএস’র দায় শীকারের মধ্য দিয়ে পশ্চিমারা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার চাপ অব্যাহত রেখেছে। কথিত জঙ্গিদের হাতে একের পর এক বিদেশী হত্যা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নাগরিক হত্যা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচার বর্হিভূত হত্যাকা-  পশ্চিমাদের এই দাবির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এখন হিন্দু আশ্রমের সেবায়েত হত্যার পর দেশের হিন্দু কমিউনিটির একটি অংশের ভারতীয় হস্তক্ষেপ কামনা এবং পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশ বিরোধী ক্যাম্পেইন একটি কাউন্টার প্রেক্ষাপট তৈরির চেষ্টা হিসেবে গণ্য হতে পারে। এরপরও বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক এবং স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি বলে দাবিদার রাজনৈতিক দলগুলো যদি দেশে গুপ্তহত্যা ও জঙ্গিবাদি সন্ত্রাস ইস্যুতে রাজনৈতিক হীনস্বার্থের ব্লেইম গেমের ইস্যু হিসেবেই গণ্য করেন তবে জাতির ললাটে চরম দুর্ভোগ আছে। জঙ্গিবাদি সন্ত্রাস ও গুপ্তহত্যাকারী ধরতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, প্রকৃত সন্ত্রাসী ও অপরাধী ধরার বদলে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার করা হলে তা’ জাতির জন্য এক সময় ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। পবিত্র রমজান মাসে পরিচালিত এই অভিযানে ইতিমধ্যে সরকারি হিসেবেই ৬ হাজার মানুষকে আটক করা হয়েছে। এ নিয়ে সারাদেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশের কোটি কোটি মানুষকে আতঙ্কে রেখে দেশে কোন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা আদৌ সম্ভব নয়। সারাবিশ্বেই সন্ত্রাসবাদ রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সন্ত্রাস দমনের নামে একসাথে হাজার হাজার মানুষকে আটক ও হয়রানি করার নজির আর কোথাও নেই।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
M Alam ২১ জুলাই, ২০১৯, ১:১৬ পিএম says : 0
Rana das gupto r Pijush ke India pathiye deya hok they r real conspirator against Bangladesh.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন