চল্লিশের পরে কিভাবে সুস্থ থাকবেনযৌবনে আমরা খাওয়া-দাওয়া, আচার-আচরণে অনেকাংশে অনিয়ম ও উচ্ছৃঙ্খল থাকি। খাওয়া-দাওয়া ও পানাহারে অনেক প্রতিযোগিতা করি। পরিণাম ভাবি না যৌবনের তাড়নায়। ফলে পরবর্তীকালে নানা স্বাস্থ্যসমস্যায় ভুগি। কষ্ট পাই। দুরারোগ্য রোগের সম্মুখীন হই। অথচ একটু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে প্রৌঢ় ও বার্ধক্যে সুস্থ জীবন যাপন করা যায়। আসুন, জেনে নেই চল্লিশের পরে কিভাবে সুস্থ থাকা যায়। সুস্থ ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের প্রথম ও প্রধান কথা হলো নিয়মানুবর্তিতা। জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি আমরা এই নিয়ম মেনে চলি, তাহলে সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করতে পারি। সর্বপ্রথম কথা হলো পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে আমরা বাঁচার জন্য খাই, খাওয়ার জন্য বাঁচি না। তাই দীর্ঘ দিন বাঁচার ইচ্ছা থাকলে আমাদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ অত্যাবশ্যক। আমাদের জন্য ¯্রষ্টা চার দিকে নানা রঙের শাকসবজি, লতাপাতা, ফলমূল সাজিয়ে রেখেছেন। সবুজ, লাল, হলুদ, কালো ইত্যাদি রঙের শাকসবজি ও ফলের মধ্যে রয়েছে অনেক পুষ্টি। অনেক গুণ। আমাদের চার দিকে চতুষ্পদ জীবজন্তু রয়েছে। তারা এসব শাকসবজি, ফলমূল খেয়ে সুস্থ সুন্দর ও নীরোগ জীবন যাপন করছে। অথচ মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কেন? এসব কথা ভাবতে হবে। সুস্বাস্থ্যের জন্য ও রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে রোজ আমাদের টাটকা রঙিন শাকসবজি ও ফল খেতে হবে। খেতে হবে ডিম ও দুধ। আমরা যে যেমন পরিশ্রম করি, তার তেমন শক্তিদায়ক খাবার খাওয়া আবশ্যক। পুষ্টিকর ও সুখাদ্য বলতে অধিক চর্বিযুক্ত ও তেলসমৃদ্ধ, ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার নয়। পোলাও-বিরিয়ানি নয়। অতি সহজলভ্য লালশাক, পুঁইশাক, কলমি ও হেলেঞ্চা শাক, মুলাশাক, ডাঁটাশাক, বেগুন, পটল, ঢেঁড়স, বরবটি, শিম, মুলা, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি। এগুলো যেমন সহজলভ্য তেমনি পুষ্টিকর। এসব শাকসবজিকে গরিবের খাবার বলে যারা তিন বেলা গোশত, বিরিয়ানি, পোলাও-কালিয়া ইত্যাদি খান তাদের পুষ্টির অভাবে বিভিন্ন রোগ হয়। এগুলো চর্বি ও তেলসমৃদ্ধ বলে স্বাস্থ্যসম্মত নয়। সুষমখাদ্য খাওয়া জরুরি।
অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণও ক্ষতিকর। আমাদের প্রিয় মহানবী (সা:) বলেছেন, তোমরা খাদ্য গ্রহণ করার সময় পাকস্থলীর তিন ভাগের এক ভাগ পূর্ণ করো, এক ভাগ পানিতে পূরণ করো এবং এক ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখো। কাজেই অতিভোজনও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এরপর আসে বিশুদ্ধ বায়ুসেবন। আমাদের শহর ও গ্রামের জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। গ্রামের মানুষ সবুজ গাছপালার মধ্যে মুক্ত বাতাসে জীবন যাপন করে। কিন্তু শহরে ইটের ওপর ইট, তার মধ্যে মানুষ নামের কীট। এখানে সহজে আকাশ দেখা যায় না। এখানে ঘরের মধ্যে থাকলে মুক্ত বাতাস পাওয়া যায় না। এ জন্য সকাল-বিকেল লেকের পাড়, পার্ক, খেলার মাঠ, নদীর ঘাটে যেতে হয়। অন্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়তে হয়। তাই দৈনিক এক ঘণ্টার জন্য মুক্ত আলো-বাতাসে যেতে হয়। অন্যথায় অক্সিজেনের অভাবে রক্ত দূষিত হয়। রোগব্যাধি আক্রমণ করে। তাই প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা খোলা বাতাসে অথবা ছাদে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। আমাদের শরীরের বেশির ভাগ পানিতে পূর্ণ। তাই দৈনিক প্রচুর বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। কমপক্ষে দৈনিক দেড় লিটার পানি পান করা দরকার। পানির সাহায্যে শরীরের ভেতরের বর্জ্য বেরিয়ে যায়। তাই পিপাসা না থাকলেও দৈনিক আট-দশ গ্লাস পানি পান করা অত্যাবশ্যক।
সঠিক অঙ্গভঙ্গিতে চলাফেরা করা উচিত। বলা যায়, স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গিতে হাঁটাচলা করতে হবে। কৃত্রিম অঙ্গভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করলে অনেক সময় অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, মাংসপেশি ফুলে যাওয়া, রক্ত চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমাদের যুবসম্প্রদায় সিনেমার নায়ক-নায়িকা, সামরিক বাহিনীর সৈনিক ও অন্য কোনো পছন্দের মানুষকে অনুকরণ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন জিমে যাওয়া জরুরি হয়ে যায়। ধূমপান হলো স্বাস্থ্যের জন্য আরেকটি অত্যন্ত ক্ষতিকর অভ্যাস। পৃথিবীর চিকিৎসাশাস্ত্রের কোথাও ধূমপানের সপক্ষে একটি কথা বা একটি বাক্য লেখা নেই। তামাকের ধোঁয়া হৃৎপি-, চোখ, রক্ত লিভার পাকস্থলী ইত্যাদি ধ্বংস করে। তাই সুস্বাস্থ্যের জন্য ধূমপান অবশ্যই বর্র্জনীয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য হৃদয়মনকে যথাসাধ্য চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠামুক্ত রাখতে হবে। অবিরত এই চাপের ফলে, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, মাইগ্রেন, মাথাধরা ও মাথাঘোরা রোগাক্রান্ত হতে হয়। চাপ, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠামুক্ত থাকতে নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, খেলাধুলা ও শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। শরীরের ক্লান্তি দূর করতে হবে।
শরীরকে বিশ্রাম দেয়া সুস্থ থাকার আরেকটি শর্ত। দিনরাত অবিরত কাজ করলে কর্মক্ষমতা কমে যায়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা থাকে না। তাই দৈনিক ৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করলে কমপক্ষে ৭ ঘন্টা ঘুমানো প্রয়োজন। তাহলে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্রাম পেয়ে আরো সবল ও শক্তিশালী হয়। তাই বিশ্রাম অত্যাবশ্যক। মন-মেজাজ সুস্থ রাখা সুস্থতার আরেকটি লক্ষণ। যারা বেশি আবেগপ্রবণ, বদমেজাজি, রুক্ষ আচরণ করে, কর্কশ কথা বলে; তারা অসুস্থ। এসব আগে শরীর ও মন দুটোকেই অসুস্থ করে। তাই যথাসম্ভব আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে জীবনযাপন করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা সুস্থ থাকার আরেকটি শর্ত। সেই সাথে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে। নিজ নিজ ধর্মানুযায়ী নামাজ পড়লে ও প্রার্থনা করলে হৃদয়মনে এক অনাবিল শান্তি আসে। রক্তচাপ কমে যায়। সুস্থ থাকা যায়। চল্লিশের পরে চিনি, চর্বি ও লবণ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। চোখ ও কানের যতœ নিতে হবে। এ দুটোর মধ্যে আগে কানের ও পরে চক্ষুর যতœ নেয়া দরকার। এ বয়সে চোখ ও কানের কার্যক্ষমতা কমে যায়। চোখে ছানি পড়ে। কানে কম শোনে। তাই নিয়মিত চোখ-কান পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সবশেষে এই বয়সে সৎ চিন্তা, সৎ কাজ, পরোপকার, সমাজসেবা ও ধর্মকর্মের মধ্যে লিপ্ত থাকতে হবে। শিশুসঙ্গ খুবই উপকারী। বিনা কাজে শুয়ে-বসে সময় অতিবাহিত করলে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হয়। তাই লেখা বা পড়াশোনা করা যেতে পারে। ছয় মাস অন্তর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো আবশ্যক। সামান্য স্বাস্থ্যসমস্যাকে অবহেলা করা উচিত হবে না। তাই পরিমিত ও নিয়মিত আহার, শারীরিক ব্যায়াম, বিশ্রাম, নিদ্রা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সুস্বাস্থ্যের পূর্বশর্ত।
চিকিৎসক-কলামিস্ট, মোবা : ০১৭১৬২৭০১২০।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন