মেহেদী হাসান পলাশ
মানবজীবনে বাঁশ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাঁশ মূলত ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। ঘাস জাতীয় উদ্ভিদের মধ্যে বাঁশই বৃহত্তম। বাঁশ বিচ্ছিন্নভাবে জন্মায় না। গুচ্ছভাবে জন্মায়। এই বাঁশগুচ্ছকে প্রচলিত বাংলায় ‘বাঁশঝাড়’ বলে। একটি বাঁশঝাড়ের জীবন চক্রে ৫ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে ফুল আসে। যখন কোনো ঝাড়ে ফুল ধরে তখন ঝাড়ের সবচেয়ে ছোট বাঁশটিতেও ফুল ধরে। ফুল পেকে ফল হয়। ফল হওয়ার পর ওই বাঁশঝাড় মরে যায়। ফল থেকে আবার বাঁশ জন্মে, নতুন ঝাড়ের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সর্বত্রই বাঁশ পাওয়া যায়। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে রয়েছে দেশের বৃহত্তম বাঁশ বন।
বলা হয়ে থাকে, মানুষের দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত বাঁশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জ্ঞানার্জনেও বাঁশ অপরিহার্য। বাঁশের ডাল যা কঞ্চি নামে খ্যাত, তা দিয়ে একসময় কলম তৈরি হতো। সেই কঞ্চির কলমে বিশ্বের সব জ্ঞান লিপিবদ্ধ হতো। বই ও খাতা তৈরিতে ব্যবহৃত কাগজ তৈরির কাঁচামালও বাঁশ থেকেই তৈরি হয়। বাংলাদেশের চন্দ্রঘোনায় পাকিস্তান আমলে স্থাপিত কর্ণফুলী পেপার মিল এশিয়ার সবচেয়ে বড় পেপার মিল ছিল। এই পেপার মিলের একমাত্র কাঁচামাল বাঁশ। পৌরাণিক কাহিনীতেও আমরা বাঁশের ব্যবহার দেখতে পাই। সনাতনী অবতার শ্রী কৃষ্ণের হাতে বাঁশের বাঁশি দেখতে পাই। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, এক হাতে মম বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য। নজরুল নিজেও বাঁশের বাঁশি বাজাতে পছন্দ করতেন। মুসলমানদের নবী হযরত দাউদ (আ.)ও বাঁশি বাজাতেন। তবে তিনি বাঁশের বাঁশি বাজাতেন কিনা তা জানা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বাঁশের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। শহীদ মীর নেসার আলী তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তার বিখ্যাত ‘বাঁশের কেল্লা’ গড়ে তুলেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীনতার সংগ্রামে স্বদেশীদের প্রধান অস্ত্রই ছিল বাঁশের লাঠি। আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঁশ ছিল আন্দোলন ও স্বাধিকার সংগ্রামীদের হাতে। সহিংস পিকেটিং কিংবা মিছিলের মশালের ধারক হিসেবে বাঁশের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরিতেও বাঁশের ব্যবহার দেখতে পাই।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের অপরিহার্য উপাদান বাঁশ। গ্রামীণ ঘর তৈরির প্রধান উপাদান বাঁশ। ঘরের খুঁটি, আড়া, বেড়া তৈরিতে বাঁশ ব্যবহৃত হয়। খাট থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাব ও ব্যবহার্য জিনিস তৈরিতে বাঁশের বহুল ব্যবহার রয়েছে। কৃষিকাজে নানাভাবে বাঁশের ব্যবহার রয়েছে। বাঁশ দিয়ে তৈরি মই কৃষিকাজে ব্যাপক ব্যবহার হলেও বাঙালি ‘মইটান’ দেয়া স্বভাবের জন্য পরিচিত ব্যাপকভাবে। মাছ শিকারের বেশির ভাগ যন্ত্র তৈরিতে বাঁশের প্রয়োজন হয়। বাঁশের চোঙা ফুটো করে একসময় ট্রেডিশনাল ব্যাংকিং চলত। এককথায় বাঁশ ভিন্ন গ্রামীণ জীবন অসম্ভব। আধুনিক শহুরে জীবনেও বাঁশের বহুল ব্যবহার শুরু হয়েছে। বাঁশের তৈরি শোপিসসহ নানা আধুনিক জিনিস এখন শহুরে মানুষের কাছে কদর পেতে শুরু করেছে। গ্রামীণ ঘরবাড়ি তৈরির উপাদানের মতো করে না হলেও শহুরে বহুতল ভবন নির্মাণের সহায়ক সামগ্রী হিসেবে বাঁশের বহুল ব্যবহার রয়েছে। তবে ইদানীং সরকারি ভবন নির্মাণের কংক্রিটের মধ্যে রডের পরিবর্তে যেভাবে বিভিন্ন স্থানে বাঁশের ব্যবহার করা হয়েছে সেভাবে নয়। ফলে সরকারি ভবন নির্মাণে কংক্রিটের মধ্যে বাঁশের ব্যবহার দুর্নীতি হিসেবেই দেখা হয়েছে। যদিও এ কথা সত্যি যে, বাঁশের টান বা টেনশন নেয়ার ক্ষমতা রডের থেকে বেশি। রডের টেনশন নেয়ার ক্ষমতা ২৪ হাজার পিএসআই, সেখানে বাঁশের টেনশন নেয়ার ক্ষমতা ২৮ হাজার পিএসআই। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা বাঁশ পানি শোষণকারী, যা ভবনের জন্য ক্ষতিকর।
জলবায়ু দূষণ রোধ ও পরিবেশ রক্ষায় বাঁশের ভূমিকা রয়েছে। অন্যান্য উদ্ভিদের চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে কার্বন শোষণ করে। মাটির ক্ষয় রোধেও বাঁশের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু দূষণের হুমকির মুখে থাকা দেশের জন্য তাই বাঁশ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ। বর্ষাকালে বাঁশের তৈরি সাঁকো গ্রামবাংলার যোগাযোগ রক্ষার অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে। পা-া নামের অতি বিলুপ্তপ্রায় নিরীহ প্রাণীর একমাত্র খাদ্য বাঁশ। শুধু পা-া নয়, মানুষও কচি বাঁশের ডগা খেয়ে থাকে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ‘বাঁশকরুল’ নামের কচি বাঁশের ডগা দিয়ে সুস্বাদু খাবার তৈরি করে থাকে। তবে বাঙালির জীবনে বাঁশ এত প্রয়োজনীয় হলেও তা কাউকে দিতে গেলে তিনি অপমাণিত বোধ করেন, ক্ষতির আশঙ্কা করেন। তাই কাউকে ‘বাঁশ দেয়া’ বাংলায় অতি গর্হিত কাজ। শুধু বাংলাদেশে নয়, পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার সাথেও এ নিয়ে রসময় চুটকি রয়েছে।
ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ধারাবাহিক টার্গেটেড কিলিং, ইমাম, মুয়াজ্জিন, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান ফাদার, বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যাকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী দেশের বিভিন্ন জেলায় কমিটি গঠন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে বাঁশের লাঠি বিতরণ করছে। বিশেষ করে খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরা জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ এই বাঁশ বিতরণ করেছে। পুলিশের ভাষ্য, ধারাবাহিক গুপ্তহত্যা ও জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনোবল ও সচেতনতা বাড়াতে এ কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। তবে পুলিশের এই ভাষ্যের সাথে দ্বিমত করেছেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের মতে, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের সর্বোত্তম পন্থা এটা নয়, এ দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় বাহিনীর। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া লাঠি হাতে মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভাষ্যে দেখা যায়, গত ২৬ এপ্রিল দুর্বৃত্তের হাতে নিহত ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নানের বাড়িতে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের ঘরে ঘরে পাহারা দিতে পারবে না। নাগরিকদের নিজস্ব নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে এলাকাবাসীর সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক থাকবে, সহযোগিতা থাকবে। পুলিশ প্রধানের এ বক্তব্যের সমালোচনা এসেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। এর মধ্যেই দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের দুটি জেলার পুলিশ নাগরিকদের হাতে লাঠি-বাঁশি তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
গত ১৪ জুন চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সদর উপজেলার সরোজগঞ্জ ও বদরগঞ্জ বাজারে পৃথক ‘সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ’ করে। বেলা ৩টায় সরোজগঞ্জ বাজারের সমাবেশে অন্তত ৪০ জনের হাতে লাঠি ও বাঁশি তুলে দেওয়া হয়। বাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি এম আবদুল্লাহ শেখের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. রশীদুল হাসান। এসপি বলেন, এলাকায় টার্গেট কিলিং, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিকাল ৫টায় বদরগঞ্জ বাজারে একই ধরনের সমাবেশ হয়। একইভাবে গত দুই দিনে মাগুরার চার উপজেলার সাতটি মন্দির এলাকায় সভা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাতে বাঁশি ও লাঠি তুলে দেয় পুলিশ। ১৩ জুন বিকালে মাগুরা সদরের সাতদোহা ল্যাংটা বাবার আশ্রম ও শ্মশানে পুলিশ সভা করে লাঠি-বাঁশি তুলে দেয়। সভায় জেলার এসপি এ কে এম এহসান উল্লাহ, অতিরিক্ত এসপি মো. তারিকুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। সভায় এসপি বলেন, মনোবল বাড়ানোর জন্য মানুষের হাতে লাঠি ও বাঁশ তুলে দেওয়া হচ্ছে মারামারি করার জন্য না। পুলিশ-জনগণ এক হয়ে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করবে। আগের দিন অর্থাৎ ১২ জুন শ্রীপুর উপজেলার গাংনালিয়া, সদরের গোপিনাথপুর, কৃঞ্চবিলা মন্দিরে, সোমবার শ্রীপুরের রামনগর, শালিখার তালখড়ি, গঙ্গারামপুর এবং ল্যাংটা বাবার শ্মশানে সভা করে পুলিশ। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলামের মতে, মূলত গুপ্তহত্যা, জঙ্গি হামলা, সন্ত্রাস দমন, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে অরক্ষিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সচেতনতা বৃদ্ধি ও মনোবল বাড়াতে এ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহা. নুরুল হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, এ রকম লাঠি-বাঁশি কর্মসূচি আগেও নেওয়া হয়েছিল নাটোরে। এসব ক্ষেত্রে মূল বিষয়টা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণের। ঝুঁকি থাকে এদের কেউ সংঘটিত হয়ে অপরাধ না করে বসে। তাই এ রকম উদ্যোগকে সার্বক্ষণিক নজরদারির জন্য একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তার ওপর ভার দিতে হবে। তবে পুলিশের বিদ্যমান আইনের সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক নয়। আইনে আছে, অন্যের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। এ কর্মসূচি প্রয়োগের ভিত্তিতে বোঝা যাবে এর কোনো নেতিবাচক দিক আছে কিনা।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল মনে করেন, এটা নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের সর্বোত্তম পন্থা নয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর। মানুষকে যদি এভাবে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর কাজ কী? একজন মানুষ কি ২৪ ঘণ্টা লাঠি-বাঁশি নিয়ে ঘুরে বেড়াবে? যখন তিনি কাজে যাবেন, স্কুল-কলেজে যাবেন তখনো কি তিনি লাঠি-বাঁশি বহন করবেন? এ ছাড়া কারও হাতে লাঠি দিলেই তো হলো না। এটা ব্যবহারের জন্য তো একটা দক্ষতা লাগে। আবার কার সঙ্গে কার শত্রুতা রয়েছে, সেদিক থেকেও এগুলোর অপব্যবহারের ঝুঁকি রয়েছে। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ কে করবে?
পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এটাকে নিয়মিত কাজেরই একটা বর্ধিতাংশ বলা যায়। সাধারণত সন্ত্রাস বা অপরাধ বেড়ে গেলে পুলিশ বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নেয়। সম্প্রতি ঘটে চলা গুপ্তহত্যার মতো অপরাধ মোকাবিলায় সমাজের লোকজনকে সম্পৃক্ত করতেই এ ধরনের উদ্যোগ। ডিআইজি বলেন, পুলিশ সদর দফতর থেকে কমিউনিটি পুলিশিং জোরদার করার নির্দেশনা রয়েছে। সেখান থেকেই এ ধরনের উদ্যোগের ভাবনা এসেছে।
এ কথা ঠিক যে, জনগণের হাতে এই লাঠি-বাঁশি দেয়ার প্রক্রিয়াটি একেবারে নতুন নয়। নব্বই দশকের শেষ দিকে রাজধানীর বেপরোয়া সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কিছু কিছু এলাকায় মসজিদ কমিটির মাধ্যমে লাঠি ও বাঁশি দিয়ে সন্ত্রাস নির্মূলে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বিশেষ করে রাজধানীর অন্যতম ক্রাইম জোন টিটিপাড়া বস্তির সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে আনতে গোপীবাগ এলাকায় ব্যাপকভাবে লাঠি ও বাঁশি বিতরণ করে। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর মুসল্লিরা লাঠি-বাঁশি নিয়ে মিছিল করত। কিন্তু চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা তো আর সশরীরে গিয়ে কোথাও চাঁদাবাজি করে না। ফলে কুখ্যাত সন্ত্রাসীরা বহাল তবিয়তে থেকে যায়। কিন্তু গোপীবাগ মোড়, মতিঝিল এলাকায় পকেটমার, ছিঁচকে চোরদের প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করতে দেখা গেছে। পরে এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রবল সমালোচনা শুরু হলে দ্রুতই পুলিশ লাঠি-বাঁশি তৎপরতা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকার পরও দীর্ঘ দিন পরে সেই লাঠি-বাঁশি ফিরিয়ে আনল পুলিশ।
মানুষকে বাঁশ চেনানোর জন্য পুলিশের প্রয়োজন নেই। সাধারণ যে কোনো মারামারিতে প্রথমেই তার হাতের পাশে থাকা বাঁশ তুলে প্রতিপক্ষের ওপর আঘাত করার চেষ্টা করে। এ ধরনের ঘটনা অনেক সময় করুণ পরিণতি ডেকে আনে। এক সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের কিছু ঘটনা যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। বিশেষ করে পিটিয়ে মানুষ হত্যার বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর এ নিয়ে দেশে-বিদেশে সরকারের ব্যাপক সমালোচনা হয়। দেশের মানবাধিকার কর্মী ও সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে আইনের শাসন না থাকায় এবং আইনের শাসনের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা না থাকায় মানুষ নিজেই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। সবাই জানেন, আইন হাতে তুলে নেয়া ফৌজদারি অপরাধ। এই অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তির বিধান রয়েছে বিদ্যমান আইনে। পুলিশকে আমরা মাঝেমধ্যেই দেখি আইন হাতে তুলে নেয়ার জন্য অপরাধীদের গ্রেফতার করতে। এখন পুলিশ যদি নিজেই জনগণের হাতে বাঁশ তুলে দিয়ে আইন হাতে তুলে নেয়ার জন্য নির্দেশ দেয় তাহলে আইন হাতে তুলে নেয়া ফৌজদারি অপরাধ বলে আর জনগণের মাঝে বিবেচিত হবে না। ফলে সারা দেশে ব্যাপকভাবে হানাহানি, সংঘাত ছড়িয়ে পড়বে। দেখা দেবে চরম নৈরাজ্য। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, আস্থা ও ভয় হ্রাস পাবে। যদি ধরে নেয়া হয়, পুলিশের বক্তব্য মতে, শুধুমাত্র অপরাধীদেরকেই বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হবে। সেখানে দুটি প্রশ্ন সৃষ্টি হয়। প্রথমত অপরাধীরা কি আইনের আশ্রয় পাবে না? বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সব মানুষই আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে। একটি সভ্য দেশে এ ধরনের পরিস্থিতি কি কল্পনা করা যায়? মানবাধিকারের মানদ-ে সেই দেশের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
দ্বিতীয়ত, অপরাধী নির্বাচনের মানদ- কী হবে এবং কার হাতে থাকবে সেই মানদ-? খোঁজ নিলে দেখা যাবে, যাদের হাতে পুলিশ বাঁশের লাঠি তুলে দিয়েছে তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে সরকার দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত। ফলে এ ধরনের উদ্যোগের ব্যাপক বিস্তারে সারাদেশে বাঁশের লাঠিধারী নতুন পেটোয়া বাহিনীর জন্ম দেবে, যাদের হাতে থাকবে পিটিয়ে মানুষ মারার লাইসেন্স। এই বাঁশের লাঠি ও মানুষ হত্যার লাইসেন্স তারা স্বার্থগত, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর ব্যবহার করবে না সে কথা হলফ করে বলা যায় না। ২৮ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে লগি, বৈঠার নামে বাঁশের লাঠি দিয়ে রাজধানীতে পিটিয়ে নির্মমভাবে মানুষ হত্যার ভয়াবহ ও পৈশাচিক দৃশ্য দেশবাসীর স্মৃতিপট থেকে এখনো ম্লান হয়ে যায়নি। এটা হবে আরেক ধরনের ‘ক্রসফায়ার’Ñ যা পুলিশ করছে বিগত কয়েক বছর ধরে। আর এখন পুলিশ একই কাজ জনগণকে করতে অনুমতি দিচ্ছে। দেশের উত্তরবঙ্গে জেএমবিও এক সময় সর্বহারা সন্ত্রাসীদের এভাবেই পিটিয়ে হত্যা করত। জেএমবি নেতা বাংলা ভাই বাগমারায় সর্বহারার কুখ্যাত সন্ত্রাসী বাদশা মিয়াকে প্রকাশ্যে জনগণের হাতে লাঠি-ঝাড়ু তুলে দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল।
দেশের চলমান সন্ত্রাস ও টার্গেটেড কিলিং বিদ্যমান পুলিশি ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় এটা দেশবাসী মনে করে না। প্রকৃতপক্ষে সরকার পুলিশ বাহিনীকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ করেছে। মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্দেশনায় পরিচালনার ফলে পুলিশ বাহিনীকে বিরোধী দল এখন সরকারের আরেকটি রাজনৈতিক সহযোগী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। নিজস্ব কাজের বাইরে অতিরিক্ত রাজনৈতিক ব্যবহার ও রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত রাখায় পুলিশ বাহিনী এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তার স্বাভাবিক কাজকর্ম সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না। এই সুযোগে পুলিশ বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য সরকারকে রাজনৈতিক সার্ভিস দিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে জনসেবার পরিবর্তে লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কতিপয় ঊর্ধ্বতন পুলিশ সদস্যের বক্তব্য শুনলে, কর্মকা- দেখলে মনে হয় তারা যেন সরকারি রাজনৈতিক দলের নেতার দায়িত্ব পালন করছেন। সরকার জেনেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। দেশবাসী মনে করে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করে, রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত না রেখে স্বাভাবিক কাজ স্বাধীনভাবে করতে দিলে বর্তমান পুলিশি ব্যবস্থা দিয়েই বিরাজমান হত্যাকা-, টার্গেটেড কিলিং বন্ধ এবং আইনশৃঙ্খলার উন্নতি সম্ভব। সরকার কি পুলিশকে সেই সুযোগ দেবে?
Email: palash74@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন