শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

শিশু নির্যাতন রোধ করতে হবে

ইসমাইল মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৩০ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নৃশংস ও বর্বরোচিত কায়দায় শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা। নিজ পরিবার কর্তৃক সম্প্রতি সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে ৫ বছর বয়সী ছোট্ট শিশু তুহিন মিয়ার হত্যাকান্ডটি সারাদেশে আলোচনার সৃষ্টি করেছে। মানুষ কতোটা বর্বর হয়ে ওঠেছে তার প্রমাণ এ হত্যাকান্ড। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা-চাচা আর চাচাত ভাই মিলে হত্যা করেছে অবুঝ শিশু তুহিনকে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে অবুঝ ও নিরপরাধ একটি শিশুকে নিজের পরিবারই ‘বলির পাঁঠা’ বানানোর ঘটনা সারাদেশের বিবেকবান মানুষকে স্তম্ভিত করেছে।

প্রতিদিন দেশের কোথাও-না কোথাও ঘটছে শিশুর প্রতি অমানবিক নিষ্ঠুর নৃশংসতা। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, স¤পত্তির দ্বন্দ্বে খুন হচ্ছে এসব অবুঝ শিশু।

শিশুদের নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব মতে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) দেশে ৩৩২ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। আর গত এক বছর (২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত) হত্যা করা হয়েছে ৫২১ শিশুকে। ওই সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ নয় মাসে দেশে শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৩১২টি। সে হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে ১৪৬টি শিশু সহিংসতার শিকার হয়। দিনের হিসেবে গড়ে দাঁড়ায় ৫টির মতো। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর এ ১২ মাসে এই সহিংসতার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১১টি। সে হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে ৮৪টি শিশু সহিংসতার শিকার হয়। দিনের হিসেবে গড়ে দাঁড়ায় ২.৮ টির মতো। ওই হিসেবে মতে গত বছরের তুলনায় এ বছর শিশুর প্রতি সহিংসতা অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ধারাবাহিতভাবে আনুপাতিক হারে এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর জরিপে দেখা যায়, চলতি বছরের ৯ মাসে ৫ থেকে ১২ বছরের শিশুরাই সবচেয়ে বেশি হত্যা ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটছে নিজের পরিবার ও পরিচিত পরিবেশের মধ্যে। হত্যা ছাড়াও ধর্ষণ, গণধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি, অ্যাসিড সন্ত্রাস ও অপহরণের শিকার হয় অবুঝ শিশুরা। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বিদ্যালয়ে শিক্ষকের হাতেও বাড়ছে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা। গৃহকর্মে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয় শিশু গৃহকর্মীরা। এদিকে এসব হত্যা ও নির্যাতরে ঘটনায় মামলা হয় খুবই কম।

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা, চাচা ও চাচাতো ভাইয়ের হাতে শিশু তুহিন হত্যার ঘটনা আরও একবার সমাজকে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু এটাই প্রথম নয়। তুহিন হত্যার কয়েক দিন আগে সাভারেও একইভাবে শিশু হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়।

অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে সারাদেশে হত্যার শিকার হয়েছে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব হত্যার মধ্যে অধিকাংশ ঘটনায়ই আইনী প্রক্রিয়ার কারণে দ্রুততম সময়ে সাজা না হওয়ায় সময়ের সাথে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা এখন স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিচ্ছে।

একটা সময় নিজের পরিবার একটি শিশুর জন্য সবচেয়ে শক্ত ভিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে এ ভিত অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এখন অনেক বিকৃত মানসিকতার লোক নিজের ক্ষতি হলেও নিজের সন্তানের ক্ষতি করে প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টায় পিছপা হয় না। তারা মনে করে, এটি করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে চাইবে না যে কোনো ব্যক্তি নিজের পরিবারের ক্ষতি করতে পারে। এমন মানসিকতা থেকেই এ ধরনের প্রবণতা তৈরি হয় বলে অভিমত সমাজ বিজ্ঞানীদের।

সমাজ এবং অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব ক্ষেত্রে প্রতিহিংসা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে কেউ-কেউ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তখন প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে নিজের আত্মতুষ্টি পাওয়াটাই তার কাছে প্রধান বা মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রামাঞ্চলে জমিজমা কিংবা আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমানের অভিমত, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে নিজের পরিবারের ক্ষতি করে হলেও প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দেয়ার মনোবৃত্তি কাজ করে। এসবের শিকার শিশুই সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। শিশুরতো রি-অ্যাকশন দেয়ার সুযোগ নেই। তাকে সহজেই ঘায়েল করা যায়। একটা অ্যাডাল্ট মানুষকে হত্যা করতে গেলে হয়তো অনেক বেগ পেতে হবে। কিন্তু একটা শিশুর ক্ষেত্রে সেটা হয় না। তাই অনেক পশুবৃত্তির মানুষ নিজের শিশুকে হত্যা বা নির্যাতন কওে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর প্রানান্তর প্রচেষ্টা চালান।

‘চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৫৩টি শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪৫৭টি শিশু। আগের বছরে প্রতি মাসে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা ছিল ৩৮১টি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৯৭টি শিশু এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১০৪ জন শিশুকে। এছাড়া ১৬১ জন শিশুকে যৌন হয়রানি ও ২৮৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ সময়ে আত্মহত্যা করেছে ১৩৩ জন। অপহরণ করা হয়েছে ১৪৫ শিশুকে। নিখোঁজ হয়েছে ১০৪ জন।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বও এ ৯ মাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২৯ শিশুকে। অপহরণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ২৩ শিশু। এ ছাড়া প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোসহ বিভিন্ন কারণে জš§দাতা বাবা কিংবা জন্মদাত্রী মায়ের হাতেই নির্মম ও বর্বোরচিত কায়দায় হত্যার শিকার হয়েছে ২৮টি শিশু।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৫ বছরে ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই শিশু ও কিশোরী। এ সময়ে ৭ বছর থেকে থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু ও কিশোরীরাই বেশি নির্যাতনের শিকার।
নিজ পরিবারের মধ্যে বা পরিচিত পরিবেশে শিশু হত্যার ঘটনা আমাদের চরম
ভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। আমাদের পারিবারিক বন্ধন ও মূল্যবোধ নিয়ে এখন নিন্মপর্যায়ে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজ পরিবারের হাতে শিশুরা খুন হবে কোন সভ্য সমাজে কোন অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না। আমাদের পারিবারিক বন্ধন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আমাদের দেশে শিশু নির্যাতন বা শিশুদের উপর সহিংসতা বৃদ্ধির মূল কারণ শিশুরা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করতে পারে না। ফলে প্রতিহিংসাসহ নানা বিকৃত আচরণের শিকার হয় আমাদের দেশের ভবিষ্যত কর্ণধার শিশুরা।

সমাজ বিজ্ঞানীদের অভিমত, আমাদের সমাজেই শিশুর প্রতি সহিংসতার নানা উপাদান রয়েছে। শিশু যেহেতু দুর্বল তাই তার ওপরই আঘাত আসে। শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশে কঠিন আইন আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশু নির্যাতন রোধে কঠোর থেকে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু কঠোর আইনই শুধু অপরাধ দমনে যথেষ্ট নয়। সমাজ যদি অপরাধপ্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে তবে যতো কঠোর আইনই থাকুক না কেন শিশুর প্রতি সহিংসতার মতো বড় ধরনের সঙ্কট দূর করা অসম্ভব। আমরা শিশুদের ক্ষেত্রে সঙ্কটময় সময় অতিবাহিত করছি। শিশুর প্রতি সহিংসতা ও শিশু হত্যার মতো ঘটনা জঘন্য, অমানবিক ও স্বার্থপর সমাজের লক্ষণ। এ থেকে উত্তরণ জরুরি।
লেখক: কলামিস্ট

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন