শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কৃষি উৎপাদনের সাফল্য কাজে লাগাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩০ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

দেশের শিল্প বিনিয়োগ, রফতানি বাণিজ্য ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানে এক প্রকার মন্দাভাব চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এরপরও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন কর্মকা-ের গতি সন্তোষজনক। এর পেছনের অন্যতম অনুঘটক হচ্ছে দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদি শক্তি কৃষিঅর্থনীতিতে ধারাবাহিক সাফল্য। ধান উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি মৎস্য, পোল্ট্রি, গরু-ছাগল, আলু, গম, ভূট্টা ও নানা রকম সব্জি উৎপাদনে দেশের কৃষি উদ্যোক্তাদের অভাবনীয় সাফল্য জাতিকে নতুন দিশা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। নতুন নতুন উচ্চফলনশীল জাতের কৃষিবীজ উদ্ভাবনে দেশের কৃষি গবেষকদের নিরলস প্রচেষ্টা কৃষিখাতের নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের হাতে সাফল্য হয়ে ধরা দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (এফএও) এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গত চার দশকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়ে তিনগুণ, গম দ্বিগুণ, সবজি ৫ গুণ এবং ভূট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। একই গতিতে বেড়েছে মাছ, পশুপালন এবং হাঁস-মুরগির খামার ও উৎপাদন। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট ও চাহিদার নিরিখে বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার এই ক্রমোন্নতির কোনো বিকল্প ছিল না। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি এবং আভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণেই দেশের প্রতিটি জনপদের মানুষ নিজেদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও কর্মনিষ্ঠার উপর ভর করে খ- খ- উর্বর জমিকে সোনালি শস্যক্ষেত্রে পরিণত করেছেন। কৃষির উপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহ ও তদুনুসারে গৃহীত নীতিমালা ও নির্দেশনার কারণেই কৃষি খাতের এই সাফল্য অব্যাহত রয়েছে।

বিশ্বের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে একই হারে কমছে কৃষিজমি এবং জমির স্বাভাবিক উৎপাদনশীল উর্বরতা। সেই সাথে যোগ হয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে কোটি কোটি হেক্টর ফসলি জমি লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাওয়ার মতো বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এ কারণেই খাদ্য নিরাপত্তা আগামী দিনের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের চরম খাদ্য ঘাটতি ও দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনের সাফল্যকে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে প্রথম সারিতে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। সাড়ে চার কোটি টনের বেশি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে এই মুহূর্তে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। তবে হতাশার বিষয় হলো, দেশের কৃষকদের এই সাফল্যে খাদ্য নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হলেও যে কৃষকরা এই সাফল্য এনে দিচ্ছেন তাদের ভাগ্য পরিবর্তন ও জীবন মানের উন্নয়ন দূরের কথা তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এখন চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ধান , আলু ও সব্জি উৎপাদনে ধারাবাহিকভাবে বাম্পার ফলনও এখন কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে না। কারণ কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ এবং কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার মাঝখানে রয়েছে এক শুভঙ্করের ফাঁক। মধ্যস্বত্বভোগীদের সিন্ডিকেটেড লুণ্ঠনের কারণে ভোক্তারা উচ্চমূল্যে খাদ্যপণ্য কিনতে বাধ্য হলেও দাম পায় না হতভাগ্য কৃষক। এভাবে লোকসান দিতে দিতে কৃষকরা ধান, আলু ও সব্জি উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়লে এক সময় খাদ্য নিরাপত্তার চরম ঝুঁকিতে পড়তে পারে দেশ।

ধান, পাট, আলুর উপযুক্ত দাম না পেয়ে দেশের কৃষকরা অন্যান্য ফসলের দিকে ঝুঁকছে। সবজি ও মৎস্য চাষের পাশাপাশি নতুন ফল চাষেও কৃষকের আগ্রহ বেড়েছে। আম, পেয়ারা, লিচু, কলা, পেঁপে, তরমুজ, আনারসের সাথে সাথে স্ট্রবেরি, কমলা, মাল্টা, ড্রাগন ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনেও সফল আমাদের কৃষকরা। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য, আলু অন্যতম সম্পূরক খাদ্য এবং পাট ঐতিহ্যগতভাবে সোনালি আঁশ ও অর্থকরি ফসল। এসব ফসলের উপর জড়িয়ে আছে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। তবে বিকল্প কৃষি ভাবনায় সব্জি ও মৎস্য উৎপাদনে যে সাফল্য ধরা দিয়েছে তা যেন নস্যাৎ না হয়ে যায় সে বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। অপ্রচলিত পণ্যের তালিকায় সারা বছরই নানা রকম শাক-সব্জি রফতানি হলেও প্রতি বছর উৎপাদিত শীতকালীন সব্জির বাম্পার ফলনের একটি অংশ বিদেশে রফতানির উদ্যোগ নেওয়া হলে তা দেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে কাজে লাগত। সেই সাথে সব্জি, ফল ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাত করে দেশে-বিদেশে বাজারজাত করার সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়ার মধ্য দিয়ে দেশের কৃষি উৎপাদনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলা যায়। উৎপাদিত ধান, আলু, শীতকালীন সব্জি, মাছ ও ফলের উপযুক্ত মূল্য, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করণের অভাবে বাম্পার ফলনের পর প্রতি বছর লাখ লাখ টন সব্জি ও ফল আড়তে পঁচে যায় অথবা ক্ষেতেই নষ্ট হয়। আবার পেঁয়াজ, আদা-রসুনের মতো নিত্য প্রয়োজনীয় মসলা জাতীয় কৃষিপণ্যে বিদেশ নির্ভরতার কারণে দেশের মানুষকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। একদিকে কৃষি পণ্যের চাহিদা ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের পাশাপাশি এর বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন