বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

মনিরুজ্জামান স্যারের কিছু স্মৃতি

প্রকাশের সময় : ২২ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি মনিরুজ্জামান স্যারকে নিয়ে লেখার যোগ্যতা ও ধৃষ্টতা আমার মতো নগণ্য কলেজ শিক্ষকের নেই। তবু স্যারের মৃত্যু সংবাদ শুনে আবেগ তাড়িত হয়ে কিছু লেখার লোভ সামলাতে পারিনি।
আমি যখন প্রাশ্চ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র তখন চিরকুমার মনিরুজ্জামান মিঞা স্যারকে ভিসি হিসেবে পেয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে আমি দু’জন ভিসি পেয়েছিলাম। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম। তখন এ বিভাগের চেয়ারম্যন ছিলেন ডক্টর এমাজউদ্দীন আহমেদ স্যার। মনিরুজ্জামান স্যারের পর এমাজউদ্দীন স্যারকেও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আল্লাহর রহমতে এমাজউদ্দীন স্যার এখনো বেঁচে আছেন।
মনিরুজ্জামান মিঞা স্যার সামরিক শাসক এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের বছর ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে ভিসি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি ভিসি ছিলেন। পরে তিনি আফ্রিকার সেনেগালের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। ১৯৩৫ সালে জন্ম নেওয়া মনিরুজ্জামান স্যার রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তিনি জগন্নাথ কলেজে কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি ফ্রান্সে গিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। মনিরুজ্জামান স্যার তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ^মানের শিক্ষক।
বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজীবনের স্বপ্ন ছিল শিক্ষক হবেন গুরু। তিনি বিশ^ভারতীর শিক্ষকদের গুরুর আসনে বসাতে চেয়েছিলেন। সবাই শিক্ষক কিন্তু সবাই গুরু নন। মনিরুজ্জামান মিঞা হয়েছিলেন সকলের গুরু। অনেকে সারা জীবন শিক্ষকই থেকে যান কিন্তু গুরু হতে পারেন না। মনিরুজ্জামান স্যার ছিলেন একজন আপাদমস্তক শিক্ষাগুরু। একজন আদর্শিক শিক্ষকের যতগুলি বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার ভিসি স্যারের মধ্যে সবগুলি বিদ্যমান ছিল।
গত  ১৩ জুন সোমবার, দুপুরে সকলের প্রিয় মনিরুজ্জামান মিঞা স্যার ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। স্যারের বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। সদা হাসিখুশি অমায়িক ব্যবহারের অধিকারী মনিরুজ্জামান মিঞা স্যার ছিলেন চিরকুমার। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছিল তার পরিবার। বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাই ছিল যেন তার সন্তান। বাংলাদেশের সেরা বুদ্ধিজীবী ছিলেন তিনি। চেহারার মধ্যেই ছিল যেন পা-িত্যের ছাপ। চোখের চাহনিতে ছিল বুদ্ধিদীপ্তের আলোকছটা। টেলিভিশনের টকশোতে স্যারের বক্তব্য শোনতাম ঠিক ক্লাসের ছাত্রের মতো। টকশোতে তিনি যেসব কথা বলতেন তা ছিল সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। স্যারের বক্তব্যে থাকতো সঠিক তত্ত্ব ও যুক্তির সমাহার। সারাদেশে স্যারের ভক্তের সংখ্যা অগণিত।
মনিরুজ্জামান স্যারের সাথে একটি স্মৃতি আজ বারবার মনে পড়ছে। তখন ১৯৯২ সাল। সময়টা ছিল পহেলা বসন্ত, ফাল্গুন মাসের প্রথম দিন। ডাকসুর উদ্যোগে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বসন্তবরণ অনুষ্ঠান। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। বাসন্তি রঙের শাড়ি পরে ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করেছেন। অনুষ্ঠানে ছিল তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন ভিসি মনিরুজ্জামান মিঞা। চির তরুণ মনিরুজ্জামান স্যার তরুণ্যের এ উচ্ছ্বাস বুঝতে পেরেই তার বক্তব্যের শুরুতে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা কেউ বলতে পারবে গোলাপ কখন লাল হয়। গোলাপ ফুল লাল হওয়ার রয়েছে নানা উপাখ্যান। এর একটি উপাখ্যান হলো- এক যুবক একটি মেয়েকে খুবই ভালোবাসত। ভালোবাসাটি ছিল একতরফা। মেয়েটির জন্যে পাগল ছিল ছেলেটি। কিন্তু মেয়েটি ছেলেকে ভালোবাসত না। একবার ছেলেটি মেয়েকে বলল, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। মেয়েটি তখন ছেলেটিকে বলল একটি শর্তে তোমাকে আমি ভালোবাসতে পারি যদি তুমি আমাকে লাল গোলাপ এনে দিতে পার। ছেলেটি লাল গোলাপের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। বন থেকে বনে, দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে কিন্তু কোথাও লাল গোলাপ খুঁজে পেল না।”
অবশেষে লাল গোলাপ না পেয়ে ব্যর্থ-মন রথে ছেলেটি এক গহীন জঙ্গলের মাঝে একটি গাছের নীচে বসে কাঁদতে লাগলেনÑ হায় একটি লাল গোলাপের জন্যে বুঝি আমার প্রেম হলো না। ছেলেটির অঝোর কান্না শুনে গাছের ডালের কোকিলের বড়ই মায়া হলো। কোকিল জিজ্ঞেস করলো ভাই তুমি কাঁদছ কেন? কোকিলের কাছে ছেলেটি সব ঘটনা খুলে বললো। কোকিল বললো দেখি তোমার জন্যে কি করতে পারি। এ কথা বলে গাছের ডালে বসে থাকা কোকিল কুহু কুহু করে ডাকতে লাগলো। দীর্ঘক্ষণ কুহু কুহু বলে ডাক পাড়ার কারণে অবশেষে কোকিলের কণ্ঠ দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। কোকিলের কন্ঠ বেয়ে পড়া রক্তের ফোটা পড়তে লাগল গাছের নীচে থাকা সাদা গোলাপের পাপড়ির উপর। অবশেষে কোকিলের গলা ফাটা রক্ত পড়ে সাদা গোলাপ হয়ে উঠলো লালে লাল। সাদা গোলাপ হয়ে গেল লাল গোলাপ। আর তখন থেকেই জন্ম হলো লাল গোলাপের।   
মনিরুজ্জামান স্যার আরো সুন্দর করে লাল গোলাপের উপাখ্যানটি অনর্গল বলছিলেন। করতালির পর করতালি দিয়ে ছাত্ররা স্যারের বক্তব্যকে বরণ করল। সত্যি কথা বলতে কি, স্যার নিজেই ছিলেন একটি ফুটন্ত গোলাপ। গোলাপের মতোই তিনি দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে সৌরভ ছড়িয়েছেন। লাল গোলাপের সেই প্রিয় স্যার আজ সাদা কাফনের কাপড় পরে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্তবাসী করেন।
ষ লেখক : সাধারণ সম্পাদক, কাপাসিয়া প্রেসক্লাব

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন