মোহাম্মদ ইয়ামিন খান
আগামীকাল ২৩ জুন, ২০১৬। পলাশী ট্রাজেডির ২৫৯তম বার্ষিকী। এদেশের ইতিহাস সম্পর্কে যারা সামান্যও পড়েছেন, তারাও নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ও পলাশী যুদ্ধের ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন। পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়, যা পরবর্তী সময়ে উপমহাদেশকে আচ্ছন্ন করে। উপমহাদেশকে সেই গোলামীর গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয়েছে দুই শত বছর। পলাশীর প্রান্তরে বাংলার নবাবের পরাজয় এই জাতির জন্য এক বিরাট শিক্ষা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই ঐতিহাসিক পরাজয় থেকে জাতি ন্যূনতম শিক্ষাও অর্জন করেনি। পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের পেছনে ঐতিহাসিকগণ মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতাকেই দায়ী করলেও সেটাই একমাত্র প্রধান কারণ ছিল না। এর পেছনে ছিল আরো গভীর ও অন্তর্নিহিত কারণ।
ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তি মাত্র জানেন, বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সময়ে নবাবের অধীনে সৈন্যসংখ্যা ছিল ৫০,০০০। আর ইংরেজ কর্নেল রবার্ট ক্লাইভের অধীনে ইংরেজ ও এ দেশীয় মিলে সর্বসাকুল্যে ৩,০০০ সৈন্য। যে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাবের পরাজয় হয় বলে উল্লেখ করা হয়, তার অধীনে ছিল ১৬,০০০ সৈন্য যারা নবাব বাহিনীর সাথে ইংরেজদের যুদ্ধের সময়ে সেনাপতির হুকুমে নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এরপরও নবাবের হাতে যে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ছিল, ইংরেজদের পরাজিত করে এদেশ থেকে বিতাড়িত করা ছিল তার বাম হাতের কাজ। এমনকি মীরজাফর যদি তার অধীনস্ত ১৬,০০০ সৈন্য নিয়ে নবাবের বিপক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো তথাপিও নবাবের বিজয় হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বাংলার নবাব সেদিন পরাজিত হয়ে জীবন দিয়েও প্রিয় জন্মভূমিকে দাসত্বের নির্মম শৃঙ্খলে বন্দি হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারলেন না। কিন্তু কেন? যেখানে সৈন্যসংখ্যা, অস্ত্রসম্ভার, রসদ ও বাহন সবকিছু ছিল বিদেশিদের তুলনায় অনেক বেশি, তাছাড়া আপন প্রকৃতি, পরিবেশ সবই ছিল নিজেদের অনুকূলে, তথাপি এই ঐতিহাসিক পরাজয়ের কারণ ছিল জাতির অনৈক্য, ক্ষমতালোভী, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এবং হিন্দু সরকারি কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্র।
সেদিন শুধু মীরজাফর নয়, ইয়ার লতিফ খান, রাজা রাজবল্লব, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণবল্লভ, মানিক চাঁদ, আমির চাঁদ, আমির বেগ, খাদিম হোসেন ও নবকুমারসহ সিরাজের বেশ কয়েকজন সেনাপতি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। সাম্রাজ্যবাদীদের সামান্য প্রলোভনে নিজ মাতৃভূমির সাথে বড় বিশ্বাসঘাতকতার একমাত্র কারণ ছিল নিজেদের মধ্যেকার অনৈক্য, ক্ষমতার কাড়াকাড়ি ও হানাহানি। আমরা জানি, আল্লাহ তার যেসকল প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা তার বিশাল সৃষ্টিজগৎ পরিচালিত করেন তার মধ্যে অন্যতম অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয় বিধান হচ্ছে ঐক্য অনৈক্যের ওপর বিজয়ী। একশ’ জন ঐক্যহীন লোক তারা যতই শক্তিশালী হোক না কেন তাদের বিরুদ্ধে দশজন ঐক্যবদ্ধ লোক বিজয়ী হবে। এটা হাজার বছর আগেও যেমন সত্য ছিল, তেমনি হাজার বছর পরেও সত্য থাকবে। তাই ঐক্যে বিজয় আর অনৈক্যে পরাজয়। পলাশীর যুদ্ধে জাতির এই অনৈক্য তাদের এতটাই দুর্বল করে দিয়েছিল যে মাত্র ৩,০০০ সৈন্যের কাছে পরাজিত হতে হয়েছিল ৫০,০০০ সৈন্যের অধিপতি নবাবকে।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় আমাদের জন্য এক বিরাট শিক্ষা। আমরা সকলেই জানি, সুলতানী ও মোঘলদের সময়ে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। যার ফলে পরসম্পদলোভী বিদেশি লুটেরা ইংরেজরা এদেশে এসেছিল ভাগ্য পরীক্ষা করতে। তারা বণিকের বেশে তুলোদ-কে রাজদ-ে পরিণত করে ভারত দখল করে ভারতের সম্পদ, শস্য, অর্থ লুট করে নিঙড়ে নিয়ে নিজেদের দেশ তথা ব্রিটেনকে অধিকতর সমৃদ্ধ করেছে। ব্রিটিশদের নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মেরুদ- ভেঙে দিয়ে গেছে। ব্রিটিশরা এদেশের মানুষের মতামতকে উপেক্ষা করে শুধু বন্দুক আর চাবুকের জোরে শাসন করেছে। তারা আমাদের ওপর জাতিবিনাশী দলাদলির অপরাজনীতিক সিস্টেম চাপিয়ে দিয়ে গেছে, যেই সিস্টেম একটা দিনের জন্যও এজাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে দেয়নি। তাদেরই শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণিটি পশ্চিমাদের প্রভুজ্ঞান করে এবং নিজেদের মনে করে বর্বর এবং পশ্চাৎপদ একটি জাতি।
আল্লাহর দেওয়া সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক জীবনব্যবস্থা তাওহীদ প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের তৈরি ভুল সিস্টেম গ্রহণ করার কারণে বাঙালি জাতিকে ব্রিটিশদের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হতে হয়। পলাশী বিপর্যয়ের ২৫৯ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে শুরু হয়েছে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। তারই অংশ হিসেবে জঙ্গিবাদের কড়াল গ্রাসে বিপন্ন হচ্ছে দেশ। একের পর এক গুপ্তহত্যা, চট্টগ্রামের পুলিশের এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা, হিন্দু পুরোহিত, খ্রিস্টান ধর্মযাজক এবং আশ্রমের সেবক হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী শুরু হয় পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান। পক্ষান্তরে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তি এবং আধিপত্যবাদী ভারত জঙ্গিবাদের অজুহাত তুলে সহযোগিতার নামে এদেশের উপর তাদের শ্যেনদৃষ্টি দিয়েছে।
এমনকি আমাদের দেশের কতিপয় নব্য মীরজাফর-জগৎশেঠ গং পীযুষ বন্দোপাধ্যায় এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মতো ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরা প্রকাশ্যে এদেশে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে আহ্বান জানিয়েছে। এটা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। ভুললে চলবে না যে এদেশকে ঘিরে পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে নবাব সিরাজউদ্দৌলা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা।” এমতাবস্থায় আজ ১৬ কোটি বাঙালিকে পলাশীর বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর তাওহীদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই তাওহীদ হচ্ছে কালেমা, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসূল)। তাওহীদের মর্মবাণী হচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আইন-কানুন, অর্থনীতি, দ-বিধি এককথায় জীবনের যেকোনো অঙ্গনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কোনো হুকুম আছে সেখানে আর কারো হুকুম চলবে না। তাওহীদের পতাকাতলে আমরা যদি ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতি হই তাহলে আমরা হবো বিশ্বের পরাশক্তি। তখন পৃথিবীর কোনো পরাশক্তি আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন