জামালউদ্দিন বারী
বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর অন্যতম গ্রিক সভ্যতার অস্তিত্ব এখন শুধু মহাকাব্যে এবং ইতিহাসের পাতায়। তবে গ্রিস নামক রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব এখনো আছে। এখন পশ্চিমা পুঁজিবাদী অর্থনীতির যূপকাষ্টে বলি হচ্ছে গ্রিসের জনগণ। বিশ্বের ৪৫তম বৃহৎ অর্থনীতি, মাথাপিছু আয় প্রায় ২২ হাজার ডলার এবং বার্ষিক মোট ২৪২ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি নিয়ে গ্রিস বিশ্বের অন্যতম দেউলিয়া রাষ্ট্র। ২০১৩ সালে গ্রিস সরকারের বৈদেশিক দেনার পরিমাণ ছিল জিডিপির ১৭৫ ভাগের বেশি। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মহাকবি হোমার তার ইলিয়াড ও ওডেসি মহাকাব্যে প্রাচীন গ্রিসের নগর রাষ্ট্রের রাজা-মহারাজা ও দেবতাদের কীর্তিগাথা বিধৃত করেছেন। গ্রিক দেবতা জিউসের কন্যা ও ম্যানিলাসের স্ত্রী হেলেনকে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস স্পার্টা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর দুই রাজবংশের মধ্যে ১০ বছরব্যাপী যুদ্ধ হয়। সম্ভবত যুদ্ধবাদী নীতির কারণেই গ্রিসের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পতন হয়। তবে তাদের পৌরাণিক যুদ্ধের কাহিনীই গ্রিক মহাকাব্যগুলোর মূল উপজীব্য। এসব কাহিনীর সূত্র থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু সাহিত্যকর্মের উদ্ভব হয়েছে। মহাকবি হোমারের জীবৎকাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী। পৌরানিক রাজত্ব ও দেব-দেবতানির্ভর কাহিনীর ঐতিহাসিক সারবত্তা যাই থাক, এসব কাহিনী মানব জাতির চিন্তা-চেতনায় যে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিংশ শতকের সবচেয়ে আলোচিত ও বহুল পঠিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে জেমস জয়েসের মহাকাব্যিক উপন্যাস ‘ইউলিসিস’ সম্ভবত অন্যতম। হোমারের ইলিয়াডে ওডেসিয়াস চরিত্রের ল্যাটিন রূপান্তরিত নাম ইউলিসিস। ১৮৮৪ সালে জন্মগ্রহণকারী আইরিশ কবি, উপন্যাসিক জেমস জয়েস তার ইউলিসিস উপন্যাসের পর্ব ও কাহিনীবিন্যাস করেছেন ইলিয়াডের সাথে সাজুয্য বজায় রেখে। বিংশ শতকের সাহিত্য বর্ণনায় জেমস জয়েস এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, যা ‘স্ট্রিম অফ কনশাসনেস’ বলে খ্যাত। বিষয়বস্তুর বর্ণনায় লেখক তার চিন্তাজগৎকে একই সাথে অতীত, বর্তমান ও দূরবর্তী অন্য কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার মধ্যে মেলবন্ধন রচনা করেন সাহিত্য রচনার এই আঙ্গিকে। যেখানে ঐতিহাসিক সত্যের কষ্টিপাথর নেই, সেখানে কবি ও সাহিত্য ¯্রষ্টা যা রচনা করবে তা-ই সত্য বলে গ্রহণ করবে মানুষ। এই ধারণা এখন ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা ইতিহাস রচনায়ও প্রয়োগ করতে শুরু করেছেন। ভাষা ও ছন্দ কবিতায় রামায়ণ রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, বাল্মিকীর উদ্দেশে নারদ বলছেন, ‘নারদ কহিল হাসি, সেই সত্য যা রচিবে তুমি, /ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি তব মনোভূমি/রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো’। রামের জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক হয়তো প্রাচীনকালেও ছিল। তা না হলে দ্বান্দ্বিক সত্যের উদাহরণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ রামের জন্মস্থানকে টেনে আনতেন না। অযোদ্ধায় বাবরি মসজিদের স্থানটিকে রামের জন্মস্থান দাবি করে অযোধ্যায় ৬০০ বছরের প্রাচীন বাবরি মসজিদটিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে ভারতের উগ্র, উন্মাদ হিন্দুত্ববাদীরা। তিনশ বছর আগে বিজ্ঞানী আইজাক নিউটন পদার্থ বিদ্যায় ‘থিউরি অব মোশন’র স্বতঃসিদ্ধতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া রয়েছে’। হিন্দুত্ববাদীরা প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ১৯৯২ সালে অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে দেয়ার পর প্রায় সিকি শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও ভাতীয় মুসলমানরা রাষ্ট্রের কাছে সেই বর্বর ঘটনার সুবিচার পায়নি। তবে সম্প্রতি ভারতীয় পুলিশের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং কাশ্মীর, গুজরাট ও মোজাফফর নগরে প্রতিশোধ নিতে ভারতীয় মুসলমান তরুণরা আইএসে যোগ দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইএস ভারতের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত এসব নির্মম রক্তাক্ত ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বলে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়। এ বিষয়ে আইএস ২২ মিনিটের এক ভিডিও বার্তা অনলাইনে প্রকাশ করেছে। ভারতে আইএস হুমকি পশ্চিমাদের বৃহত্তর গেমপ্লানের অংশ হতে পারে। ভারতকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত ডিস্টাবিলাইজেশনের মাধ্যমে এর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা রুখে দেয়া অথবা ভয় দেখিয়ে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী নীলনকশার সাথে ভারতকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করার প্রয়াসও হতে পারে এটি। তবে ভারতীয় তরুণদের আইএসে যোগ দেয়ার প্রেক্ষাপট বা হতাশাজনক পরিস্থিতি তৈরির দায় ভারতীয় রাজনীতিকরা এড়াতে পারবে না।
আইএস, আল কায়েদা পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী হেজিমনির ফল। এসব সংগঠন গড়ে তোলা, সন্ত্রাস দমনের নামে বহুজাতিক সমরসজ্জার পেছনে রয়েছে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বাণিজ্য এবং সস্তায় তেল কেনার দূরভিসন্ধি। সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা ও তৎপরতা এড়িয়ে জায়নবাদি গ্রেটার ইসরাইলকে একটি অখ- অজেয় শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখার অপকৌশল। অস্ত্রের জোরে ফিলিস্তিনি আরবদের জমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই ইহুদিরা পশ্চিমা সমাজে ঘুণপোকার মতো চেপে বসেছিল। জেমস জয়েস তার ইউলিসিস উপন্যাসের দ্বিতীয় এপিসোডে গল্পের নায়ক বলছেন, ‘ইংল্যান্ড ইজ ইন দ্য হ্যান্ডস অব জুইশ ইন অল দ্য প্লেসেস : হার ফিনান্স, হার প্রেস, অ্যান্ড দে আর দ্য সাইনস অব অ্যা নেশানস ডিকে, হয়ারএভার দে গেদার দে ইট আপ দ্য নেশানস ভাইটাল স্ট্রেংথ।... ওল্ড ইংল্যান্ড ইজ ডাইং’। এখানে ইহুদিদের কুপ্রভাব সম্পর্কে একজন ব্রিটিশ নাগরিকের আশঙ্কার অভিব্যক্তি প্রকাশিত হলেও বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিভিন্ন সভ্যতায় ইহুদিরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদী শোষণের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ইউরোপের শিল্পসাহিত্যে ইহুদি সম্প্রদায়ের সেই ভূমিকার প্রতিফলন রয়েছে। ষোড়শ শতকে শেকসপিয়রের নাটকে যেমন ইহুদি সুদখোর মহাজনদের চরিত্র ফুটে উঠেছে, একইভাবে ঊনবিংশ শতকে জেমস জয়েসের লেখায়ও ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যকে গিলে খাওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে। মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে শেকসপিয়র একজন ইহুদি সুদি ব্যবসায়ীর চরিত্র ফুটিয়ে তোলায় ইহুদিরা শেকসপিয়রকেও এন্টি সেমিটিক বলে গাল দিয়েছে, আবার নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার পর নিউ জার্সি পোয়েট লরিয়েট আমিরি বারাকা (লে রয় জোনস) যখন ‘সামবডি ব্লেউআপ আমেরিকা’ শিরোনামের একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে নিউ ইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে বিমান হামলার ঘটনাসহ আধুনিক বিশ্বের প্রায় প্রতিটি যুদ্ধ ও ধ্বংসাত্মক ঘটনায় ইহুদি ও সা¤্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের যোগসূত্র উন্মোচন করেছেন তখন এন্টি ডিফেমেশন লীগের ব্যানারে ইহুদিরা এন্টি-সেমিটিক বলে গাল দিয়ে আমিরি বারাকার সব নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছে। বিশ্বের ইতিহাসে কারা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইহুদিকে হত্যা করেছে আমিরি বারাকার কবিতায় সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে।
গত দুই হাজার বছরের ইতিহাসে ইহুদিরা সবচেয়ে নির্বিঘেœ এবং আত্মমর্যাদার সাথে বসবাস করার পাশাপাশি নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঔৎকর্ষের সুযোগ ও নিরাপত্তা পেয়েছিল শুধু আন্দালুসিয়ায় মুসলমান শাসনামলে। রোমান চার্চ, খ্রিস্টীয় ক্রুসেডার থেকে বিংশ শতকে হিটলারের নাৎসিবাদী শাসন পর্যন্ত লাখ লাখ ইহুদি গণহত্যা ও টার্গেটেড কিলিংয়ের শিকার হয়েছে। তবে ইহুদিরা যখন জায়নবাদি ধারণায় একটি নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিল তখন রাশিয়া, ব্রিটেন-আমেরিকা সব মতপার্থক্য ভুলে দরিদ্র ফিলিস্তিনি আরবদের ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত করে ইহুদিদের সেখানে পুনর্বাসিত করতে একাট্টা হয়েছে। অস্ত্র ও জুলুমবাজির মধ্য দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে গড়ে ওঠা ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলকে টিকিয়ে রাখতেও তাদের মধ্যে এক ধরনের গোপন সমঝোতা লক্ষ্য করা যায়। আজকের দুনিয়ায় বিদ্যমান জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, আল কায়েদা, আইএসসহ মধ্যপ্রাচ্যের রক্তাক্ত পরিস্থিতির জন্য ইহুদিদের অবৈধ রাষ্ট্র এবং তার পৃষ্ঠপোষকরাই দায়ী। সব উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের হারানো বাড়িঘর, জমি ও নদী ফিরিয়ে না দিলে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সমাধান অসম্ভব। তবে ফিলিস্তিনি সমস্যা যখনই বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রধান এজেন্ডা হিসেবে এসেছে ইসরাইলিরা তখনি আরেকটি নতুন ইস্যু তৈরি করে মানুষের মন মগজকে সেই নতুন সংকটের দিকে লেলিয়ে দিতে নেপথ্য ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্ব সম্প্রদায় এই মুহূর্তে ফিলিস্তিন সমস্যার চেয়ে আইএস এবং সিরীয় উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়েই বেশি ব্যস্ত আছে। আইএস জুজুর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি সরকার এবং রয়েল ডায়ন্যাস্টিগুলোকে ব্যস্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত রাখা হচ্ছে। নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হাজার হাজার কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি করে তেল বিক্রয় লব্ধ শত শত বিলিয়ন ডলার বাগিয়ে নিয়ে পেট্টো ডলারের দেশগুলোকে দেউলিয়া ও দুর্বল করার সাথে সাথে ইসরাইলি দখলদারিত্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এসব হেজিমনির মূল উদ্দেশ্য। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স (এমআইসি), প্রেস এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া (কর্পোরেট মিডিয়া), কর্পোরেট ব্যাংকিং সেক্টর, স্টক এক্সচেঞ্জ (শেয়ারবাজার), হলিউড, ইয়াহু, গুগল, বৃদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের অধিকার, অধিকাংশ থিঙ্কট্যাঙ্ক, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং প্রোপাপান্ডা মেশিনারিজের ওপর ভর করে জায়নবাদী অর্থনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। পারমাণবিক বোমাসহ সামরিক শক্তির দিক থেকে এক ধরনের ভারসাম্য থাকায় পশ্চিমা রাজনীতি ও অর্থনীতির মূল প্রতিপক্ষ ছিল সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের দেশগুলো। নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক বলয়ের পতনের মধ্য দিয়ে সেই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর ইউনিপোলার বিশ্বে একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে মুসলিম বিশ্বকে দাঁড় করানো কঠিন হওয়ায় নিজেদের সৃষ্ট আলকায়েদা, আফগান তালেবান, হেজবুল্লাহ, হামাসের মতো মুজাহিদ গ্রুপগুলোকে পশ্চিমা সমাজের মানুষদের কাছে এদেরকে ভীতিকরভাবে উপস্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেই সাথে ইরানের সাথে আট বছরব্যাপী যুদ্ধে পশ্চিমাদের একচেটিয়া সমর্থনপুষ্ট ইরাকি শাসক সাদ্দাম হোসেনকেও বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হিসেবে চিত্রিত করার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে একটি সামরিক আগ্রাসন ও পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতি কায়েম করার অভিসন্ধি গ্রহণ করা হয়। আট বছরের যুদ্ধে দেউলিয়াপ্রায় ইরাকের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং ধারদেনা পরিশোধের সুযোগ হিসেবে সাদ্দাম হোসেনকে পরোক্ষভাবে গোপনে কুয়েত দখলের পরামর্শ দিয়ে কুয়েত পুনরুদ্ধারের নামে মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তম সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব কায়েমের প্রথম পদক্ষেপ। ভিন্ন ভিন্ন অজুহাতে ইরান ও ইরাকের ওপর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দুটি দেশকে দুর্বল করে তোলার প্রয়াস অব্যাহত রাখা হয়। অবশেষে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে ইরাকে সরাসরি সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব কায়েম করতে সক্ষম হলেও ইরানের বেলায় ফলাফল হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ ইরানকে সর্বক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত করেছে। পারমাণবিক গবেষণা, সামরিক ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিল্পপ্রযুক্তি গবেষণা ও উদ্ভাবনে ইরানের বিস্ময়কর সাফল্য পশ্চিমা বিশ্বকে ইরানের সাথে সমঝোতায় বাধ্য করেছে। ইরানের অভ্যন্তরীণ সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং শাসকদের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা না থাকলে শুধুমাত্র প্রযুক্তি ও সমরশক্তি দিয়ে এই সাফল্য ধরে রাখা হয়তো সম্ভব হতো না। তবে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের বশংবদ নয়, ইসরাইলের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয় এমন কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র পশ্চিমারা দেখতে চায় না। এটি তাদের একটি শর্তহীন সিদ্ধান্ত। অতএব মধ্যপ্রাচ্যে আইএস ও রিজিম চেঞ্জ পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে ইরানকে পদানত করার পরিকল্পনা অব্যাহত আছে। শুধু ইরান নয়, গোটা মুসলমান দুনিয়া এবং ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি এখন পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের টার্গেট। এই লক্ষ্য অর্জনে টার্গেটেড কিলিং, ফল্সফ্লাগ অপারেশন ও জঙ্গিবাদী তৎপরতার ক্ষেত্র প্রস্তুতের সব ধরনের রসদের জোগান দিয়ে চলেছে ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি ছড়িয়ে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের বহুজাতিক ষড়যন্ত্র এখন নিপুণ আন্তর্জাতিক শিল্পে পরিণত হয়েছে। এ সম্পর্কে উদাহরণ দিতে গিয়ে একজন পশ্চিমা সাংবাদিক-কলামিস্ট গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড এই সপ্তাহে একটি অনলাইন মিডিয়ায় প্রকাশিত নিবন্ধে দেখিয়েছেন, কীভাবে মিডিয়া মুসলমান ও অমুসলমান অপরাধীদের ইমেজ তৈরিতে পার্থক্য তৈরি করে। গত সপ্তাহে ব্রিটেনের লেবার দলীয় এমপি জো কক্সকে হত্যা করেছে ৫২ বছর বয়সী একজন শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান টমাস মেয়ার। জো-কক্সকে হত্যা করার সময় মেয়ার ‘ব্রিটেন ফার্স্ট’ বলে চিৎকার করেছিল বলে জানা যায়। জো কক্সকে হাতেনাতেই ধরেছে পুলিশ, তবে বিশ্বের কোনো মিডিয়াই তাকে ‘টেররিস্ট’, খ্রিস্টান টেররিস্ট বা জঙ্গিবাদী বলে শিরোনাম করেনি। পক্ষান্তরে এই ব্যক্তি যদি মুসলমান হতো, যদি সে ব্রিটেন ফার্স্ট না বলে ‘আল্লাহু আকবার’ স্লেøাগান দিয়ে জো কক্সকে হত্যা করত তাহলে বিশ্বমিডিয়ার প্রচার-প্রচারণার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো বলে মনে করেন গ্রিনওয়াল্ড। এ ক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ হিসেবে ২০১০ সালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ নারী ইরাক যুদ্ধে সমর্থন দেয়ায় ব্রিটিশ এমপি স্টিফেন টিমসের ওপর ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলার ঘটনার কথা তুলে ধরেন। সে হামলার পর বিশ্বের প্রায় সব মিডিয়া একে একটি সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে তুলে ধরেছিল। টেররিস্ট এবং নাৎসিবাদী হওয়ার পরও জো কক্সের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ‘টেররিস্ট’ শব্দটি শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য ও সঙ্কোচিত করা হচ্ছে। অরল্যান্ডোতে সমকামী নাইটক্লাবে হামলার দায়ে কথিত একজন মুসলমান ইমিগ্রান্ট ওমর মতিনের নাম প্রচার করা হয়েছে। সেই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারো জোর দিয়ে তার মুসলমান অভিবাসনবিরোধী অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন। পালস নাইট ক্লাবে সেমি অটোমেটিক গান নিয়ে হামলা করে ৪৯ জনকে হত্যা এবং আরো কয়েক ডজন মানুষকে আহত করার আগে ওমর মতিন ইমার্জেন্সি ৯১১ নম্বরে ফোন করে নিজের আইএস সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছিল বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। তবে সিআইএ এবং ফেডারেল ব্যুরোর তদন্তে মতিনের আইএস সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে রবিবার মধ্যরাতে পালস নাইটক্লাবে সন্ত্রাসী হামলার সময় ভিতরে আটকে পড়া শত শত মানুষ যখন প্রাণভয়ে আর্তনাদ করছিল, তখন ইউসুফ ইমরান নামের এক মুসলমান যুবকের সাহসিকতায় ৭০ জনের বেশী মানুষের প্রাণে বাঁচার গল্প এখন ‘সুপারম্যান’র বীরত্ব গাথায় পরিণত হয়েছে। আর ওমর মতিনের ব্যবহৃত অস্ত্র দুটি বৈধভাবেই কেনা হয়েছিল। এরপরও ডোনাল্ড ট্রাম্প সবার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে আইনগত বৈধতার দাবি ও প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। তবে একজন মুসলমান অভিবাসী নাগরিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরাল্যান্ডো নাইটক্লাবে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ৪৯ জনকে হত্যা করার পরও সেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো কম্বিং অপারেশনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে হাজার হাজার মানুষকে আটক করেনি। জো-কক্সকে হত্যার দায়ে আটক টম মেয়ারকে ধরার তিন দিনের মধ্যেই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে ব্রিটিশ পুলিশ। কোনো রাজনৈতিক ব্লেইম-গেম বা কাদা ছোড়াছুড়ির ঘটনাও ঘটেনি। রিমান্ডের নামে জো-কক্সকে বন্দুকযুদ্ধের নাটকে মরতে হয়নি। ব্রিটেনে এখন ব্রেক্সিট বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে গণভোট বা রেফারেন্ডামের আয়োজন চলছে। এমপি জো-কক্স ব্রিটেনের ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। ব্রিটেন ফার্স্ট স্লোগান দিয়ে জো কক্সের ওপর আততায়ী হামলার ঘটনাকে কোনো পক্ষই রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে ব্যবহারের চেষ্টা করেনি। বরং সব মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে একটি বৃহত্তর মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়িয়েছে ব্রিটেনের সকল রাজনৈতিক দল। আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতিক এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তারা কি কখনো এমন দৃষ্টান্তের কাছাকাছি দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন? তবে আমরা পুরো জাতি দেশকে এমন গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের বাস্তবতায় পৌঁছাতে চাই।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন