বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

সত্যালোকের সন্ধানে - ইসলামে আত্মিক ইবাদতের গুরুত্ব

প্রকাশের সময় : ২৩ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুনশী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আল-কোরআনে আরো ঘোষণা করা হয়েছে, “তিনিই দয়ালু যিনি প্রতিটি বস্তুকে সুন্দর ও নিখুঁত করে পয়দা করেছেন, আর মানুষের পয়দায়েশ শুরু করেছেন কর্দম থেকে। তারপর মানব সন্তানকে মর্যদাহীন প্রবাহিত বীর্য দ্বারা পয়দা করেছেন; তারপর তাকে বিন্যস্ত করেছেন এবং তন্মধ্যে স্বীয় রূহ থেকে ফুৎকার করেছেন এবং তোমাদের জন্য দর্শনেন্দ্রিয়, শ্রবণেন্দ্রিয় ও অন্তর প্রদান করেছেন, সুতরাং তোমরা কম শোকর গুজারীই করছ।” (সূরা সিজদাহ : রুকু-১)
অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, “আল্লাহ পাক তোমাদের মায়েদের উদর হতে বের করেছেন, যখন তোমরা কিছুই জানতে না, তারপর তোমাদের জন্য শ্রবনেন্দ্রিয়, দর্শনেন্দ্রিয়, অন্তর ও দিলের ব্যবস্থা করেছেন, যেন তোমরা যথার্থভাবে শোকর আদায় করতে পার।” (সূরা নহল : রুকু-১১)
এ সকল আয়াতে দৈহিক কৃষ্টিসুলভ নেয়ামতের বয়ান এবং এর শোকরগুজারী করার আহ্বান জানানো হয়েছে। অর্থাৎ অন্তর দ্বারা আল্লাহর এই দান ও অনুকম্পাসমূহ মেনে নিয়ে আল্লাহর প্রভুত্ব, বিশালত্ব ও একাকীত্বকে কবুল করা হয়। আর এই দৃঢ় আশা- পোষণ করা, যিনি এই জীবন দান করেছেন, জীবন পরিচালনার উপায় উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন, তিনি আমাদের মৃত্যুর পর পুনর্বার জীবন দানেও সক্ষম। সে জীবনেও তিনি আমাদেরকে অনেক কিছু দান করতে পারেন। তারপর হাত, পা, কান, চোখ প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আল্লাহর দান দৈহিক নেয়ামতরাজির হক আদায় করা। তাই তো আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে,
“তোমরা ঐ সকল পশুর গোশত হতে কিছু ভক্ষণ কর এবং কিছু অন্যকে ভক্ষণ করাও, যারা ধৈর্যসহ বসে আছে, কিংবা অভাবগ্রস্ত হয়ে; এভাবেই আমি এই পশুগুলোকে তোমাদের আয়ত্তে দান করেছি। যেন তোমরা শোকর আদায় করতে পার।” (সূরা হজ) অপর এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুজি দান করেছি, তন্মধ্যে পবিত্র বস্তুসমূহ থেকে তোমরা ভক্ষণ কর এবং আল্লাহর শোকর আদায় কর।” (সূরা বাক্কারাহ: রুকু-২১) অন্য এক আয়াতে আরও ঘোষণা করা হয়েছে, “সুতরাং আল্লাহপাক তোমাদের জন্য যে হালাল ও পবিত্র জিনিস রিজিক হিসেবে রেখেছেন এগুলো ভক্ষণ কর এবং তার নেয়ামতের শোকর আদায় কর, যদি তোমরা তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করে থাক।” (সূরা নহল : রুকু-১৫) এগুলো হচ্ছে সম্পদ-ভিত্তিক নেয়ামতের  বয়ান। এগুলোর শোকরগুজারীও করা উচিত। কেননা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এর দ্বারা প্রকাশ পায়।
এই পৃথিবীতে শোকর-গুজারীর তৃতীয় প্রকার হচ্ছে এই যে, কোনও সহানুভূতিসম্পন্ন সত্তা যদি আমাদের উপর কোনও প্রকার সহানুভূতি প্রদর্শন করে, তাহলে সমপরিমাণ সহানুভূতি তার প্রতি প্রদর্শন করা আমাদেরও উচিত। এ কথা সুস্পষ্ট যে, আল্লাহপাক বে-নেয়াজ সত্তার সাথে এ জাতীয় কোন শোকরিয়া আদায় করা যায় না। তবে এই তৃতীয় প্রকার শোকরিয়ার সুরত হচ্ছে এই যে, আল্লাহপাক আমাদের সাথে যে ইহসান প্রদর্শন করেছেন, সমপরিমাণ ইহসান আমরাও তার বান্দাদের সাথে প্রদর্শন করব। এই বিশেষত্বকে আল্লাহপাক হযরত মূসা (আ:)-এর কাওমের প্রসঙ্গে এভাবে ব্যক্ত করেছে, “এবং যেভাবে আল্লাহপাক তোমাদের সাথে ইহসান করেছেন, তোমরাও তদনুরূপ ইহসান প্রদর্শন কর।” (সূরা কাসাস : রুকু-৮) আর আল্লাহকে কর্জ দেয়ার অর্থও ঠিক একই এ কথা সর্বজনবিদিত যে আল্লাহপাক কোন জিনিসের মুহতাজ বা মুখাপেক্ষী নন। যার জন্য তাকে কর্জ দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। বস্তুত আল্লাহকে কর্জ দেয়ার অর্থ হচ্ছে তার অভাবগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত বান্দাদেরকে প্রয়োজনের প্রাক্কালে টাকা-পয়সা দান করা। এ প্রসঙ্গে আল- কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “এমন কে আছে,  যে আল্লাহকে ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ দান করে।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-৩২ এবং সূরা হাদীস : রুকু-২)।
অপর এক আয়াতে আরো ঘোষণা করা হয়েছে, “এবং তোমরা আল্লাহকে কর্জে হাসানা প্রদান কর।” (সূরা হাদীদ : রুকু-২ এবং সূরা মুযযাম্মিল : রুকু-২) অন্যত্র আরো ঘোষণা করা হয়েছে “যদি তোমরা আল্লাহকে কর্জে- ‘হাসানা প্রদান করতে’ (সূরা তাগাবুন : রুকু-২) আল্লাহকে কর্জে হাসানা প্রদান করার যে তফসীর উপরে বর্ণনা করা হয়েছে, এরই আলোকে নি¤েœর এই হাদীসকে পাঠ করতে হবে।
হযরত আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন : কিয়ামতের দিন আল্লাহপাক ইরশাদ করবেন, হে আদম সন্তান! আমি যখন রুগ্ন  ছিলাম, তখন তোমরা-আমার সেবা-যতœ করনি। বান্দাহ বলবে, হে আমার পরওয়ারদিগার! তুমি তো সারা জাহানের প্রতিপালক। আমি তোমার সেবা-যতœ কিভাবে করব? আল্লাহপাক বলবেন, “তবে কি তুমি জানতে না, আমার অমুক বান্দাহ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল? তুমি তাকে সেবা-যতœ করনি। যদি তার সেবা-যতœ করতে তাহলে আমাকে তার নিকট অবশ্যই পেতে। আবার আল্লাহপাক বলবেন, “হে আদম সন্তান। আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে আহার দান করনি। বান্দাহ আরজ করবে, হে আমার পরওয়ারদিগার! তুমি তো বিশ্বজাহানের প্রতিপালক। আমি তোমাকে কেমন করে আহার দান করি? আল্লাহ বলবেন, তোমার কি জানা নেই, আমার অমুক বান্দাহ তোমার নিকট আহার্য চেয়েছিল, তুমি  তাকে আহার্য দাওনি। যদি তুমি তাকে আহার্য দান করতে, তাহলে তার বিনিময় আজ আমার কাছে লাভ করতে।” পুনর্বার আল্লাহপাক বলবেন, “হে আদম সন্তান! আমি তোমাদের কাছে পানি চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি আমাকে পানি পান করাওনি। বান্দাহ বলবে, হে আমার প্রতিপালক! তুমি হলে সারা জগতের পরওয়ারদিগার! আমি তোমাকে কেমন করে পানি পান করাই? আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দাহ তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তাকে পানি দান করনি। যদি তুমি তাকে পানি দান করতে তাহলে আজ আমার কাছে এর বিনিময় লাভ করতে।” (সহীহ মুসলিম: রোগীর সেবা যতœ অধ্যায়) এই বিশ্লেষণের দ্বারা অবশ্যই জানা যায় যে, আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের দৈহিক ও সম্পদভিত্তিক শোকরগুজারি আমাদের কিভাবে আদায় করা দরকার।
আল্লাহপাক স্বীয় নেয়ামতসমূহের শোকর আদায় করার তাকিদ বার বার এ জন্যও করেছেন, যেন আমরা এই ধারণা পোষণ না করি যে, আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পা ছাড়াই আমরা এ সকল নেয়ামতের অধিকারী হওয়ার যোগ্যতা রাখি। অথচ এ সকল নেয়ামতের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন না আমরা নিজেরা ছিলাম, না আমাদের বংশ মর্যাদা এর যোগ্য ছিল, না এ সকল আমরা নিজেদের জ্ঞান-গরীমা ও মনীষার দ্বারা লাভ করেছি। বরং যা কিছুই আমরা লাভ করব বা করি তা কেবলমাত্র আল্লাহর দান এবং বকশিশ ছাড়া কিছুই নয়।
মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে যে সকল অনুগ্রহের প্রবাহ আসমান হতে জমিন পর্যন্ত বিস্তৃত দেখতে পায় এবং এগুলো প্রত্যক্ষ করে মানুষ বুঝতে পারে যে, এর সব কিছুই স্বাভাবিক অনুগ্রহ ও অনুকম্পার ¯্রােত ধারা মাত্র এবং এই ধারণা সর্বোতভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায় যে, আমাদের উপর আল্লাহর কোন দান বা অনুকম্পা নেই বা এর জন্য শোকর আদায় করারও প্রয়োজন নেই। এর দ্বারা এ সকল নেয়ামতের শোকর আদায় করার প্রতি এমন একটি অনীহাসুলভ কুফুরী ইচ্ছা প্রকাশ পায়, যাদ্বারা মানুষ প্রকৃতই অবিশ্বাসী ও অংশীবাদী হয়ে পড়ে। যা তার মূল বিশ্বাসকে ক্রমশই ধ্বংস করে দেয়। এই ঘৃণ্য মনোভাবকে চিরতরে বিলুপ্ত করার জন্য আল্লাহপাক কুরআনুল কারীমে স্বীয় প্রতিটি দান ও অনুকম্পার কথা পৃথক পৃথকভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং এগুলোর উপর শোকর আদায় করার তাকীদ দান করেছেন। যেন আল্লাহর প্রভুত্ব ও প্রতিপালনের বিশ্বাস ও একীন তার অন্তর প্রদেশকে সমুজ্জ্বল করে তোলে এবং সে অনুগতশীল বান্দাহ হিসেবে বরিত হতে পারে।
ধন-সম্পদ ও অর্থকরি লাভ করার পর মানুষ বুঝতে শুরু করে যে, সে সাধারণ মানুষ হতে বেশি মর্যাদার অধিকারী এবং যা কিছু সে লাভ করেছে এটা তার বংশগত অধিকার ও তার নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধি এবং মনীষার দ্বারাই সে লাভ করেছে। যেমনটি আমরা আল-কুরআনে উল্লিখিত কারূনের কাহিনীর মাঝে দেখতে পাই। সে অহংকার বসে বলেছিল, সবই তার বুদ্ধিমত্তার ফসল। পরিণামে সে অহংকার, কৃপণতা ও জুলুম অত্যাচারের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আল্লাহপাক এর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরশাদ করেছেন, “আর তোমাদেরকে যা কিছু প্রদান করা হয়েছে এর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরশাদ করেছেন, “আর তোমাদেরকে যা কিছু প্রদান করা হয়েছে এর জন্য অহংকার ও অহমিকা প্রকাশ করো না, কেননা, আল্লাহপাক সকল অহংকার ও দাম্ভিককে পছন্দ করেন না; যারা কৃপণতা প্রকাশ করে এবং লোকজনদের বখিলী করার নির্দেশ প্রদান করে; আর যারা ভরসা করে, অবশ্যই আল্লাহপাক ধনী এবং প্রশংসিত।” (সূরা হাদীদ ঃ রুকু-৩) কেননা তিনি স্বীয় সত্তা ও কুদরতের বলে মানুষের ধন-দৌলতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন। কারণ তিনি নিজেই ধনী। এর জন্য তিনি নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হোক, এই ইচ্ছাও পোষণ করেন না। তিনি নিজেই সর্বাত্মক প্রশংসিত ঃ অন্যের প্রশংসার প্রয়োজনীয়তা তার মোটেই নেই।
আল্লাহপাক মানুষের উপর যে সকল অজ¯্র নেয়ামত অবতীর্ণ করেছেন, এমনকি সে সকল বকশিশ দ্বারা তিনি বান্দাহদের সৌভাগ্যশালী করেছেন এর দ্বারা মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, মানুষ যেন সেই করুণা নির্ধারণের প্রকৃত মর্যাদা ও শান চিনতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। এর সত্যতাকে মেনে চলে এবং আল্লাহর নেয়ামত ও বকশিশের যথার্থ শোকর নিজের জান, মাল ও অন্তর দ্বারা আদায় করে। আল-কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “তিনিই তোমাদেরকে পবিত্র জিনিস রিজিক দান করেছেন, যাতে করে তোমরা শোকর আদায় করতে পার।” (সূরা আনফাল ঃ রুকু-২) অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে, “তিনিই সমুদ্রকে তোমাদের অধীনস্ত করে দিয়েছে, যেন তোমরা এর থেকে তাজা গোশত (মাছ) লাভ করতে পার এবং এর থেকে এমন সব সৌন্দর্যের জিনিস উদ্ধার কর, যা তোমরা পরিধান করতে পার, আর তোমরা জাহাজসমূহ দেখছ যে তা পানি চিরে এগিয়ে চলে, যাতে করে তোমরা আল্লাহর মেহেরবাণী তালাশ কর এবং যেন তোমরা শোকরগুজার হতে পারে।” (সূরা নহল ঃ রুকু-২) অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে “এভাবেই আমি এই পশুগুলোকে তোমাদের অধীনস্ত করে দিয়েছি। যেন তোমরা শোকরগুজার হও।” (সূরা হজ্জ ঃ রুকু-৫) অন্য এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে, “এবং তার রহমতের মাঝে এও যে, তিনি তোমাদের জন্য রাত এবং দিন পয়দা করেছেন যেন রাতে তোমরা আরাম করতে পার এবং দিনে তার ফজল ও করম তালাশ কর, যেন তোমরা শোকরগুজার হও।” (সূরা কাসাস ঃ রুকু-৭)
এ ছাড়াও অনেকগুলো আয়াত রয়েছে, যেগুলোতে আল্লাহপাক সুস্পষ্টভাবে ইরশাদ করেছেন যে, এ সকল নেয়ামতের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, যেন বান্দা স্বীয় মনিবকে চিনতে পারে এবং সর্বান্তঃকরণে তার ইহসানকে গ্রহণ করে। তবে গুনাহগার মানুষের হাল কি হবে, এ সম্পর্কেও আল-কোরআনে বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, “অবশ্যই আল্লাহপাক মানব সন্তানকে বড় বড় ফজিলত প্রদান করেছেন; কিন্তু মানুষের মাঝে অধিকাংশই শোকরগুজার নয়।” (সূরা ইউনুস ঃ রুকু-৬) অপর এক আয়াতে আরো ইরশাদ হচ্ছে, “এবং আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে শক্তি দান করেছি এবং এর মাঝে তোমাদের জীবিকায় অসংখ্য উপকরণ রেখেছি, তবুও তোমাদের কম লোকই শোকরগুজারি করে।” (সূরা আরাফ ঃ রুকু-১) অপর এক স্থানে আল্লাহপাক মানুষের এই না-শোকরীর উপর ভালোবাসা পূর্ণ অসন্তুষ্টির কথাও প্রকাশ করেছেন, “ধ্বংস হোক, মানুষ কত না অকৃতজ্ঞ।” (সূরা আবাসা ঃ রুকু-১)
কৃতজ্ঞতা সম্পর্কিত বিষয়াদির মাঝে সবচেয়ে বড় ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে এই যে, মানুষ মনে করে আমরা মুখে, “আল-হামদু লিল্লাহ” বলে দিলেই মালিকের শোকর আদায় হয়ে যায়। অথচ তা মোটেই ঠিক নয়। শোকর মূলত অন্তরের সেই গোপন অনুভূতির নাম যার দরুন আমরা অনুগ্রহকারীকে ভালোবাসি। সকল ক্ষেত্রেই তার অনুকম্পাকে স্মরণ করি। এর জন্য উদগ্রীব থাকি এবং সচেষ্ট হই, যেন তাকে পরিতুষ্ট রাখতে পারি। তাই তার নির্দেশ পালনে ব্রতী হই। যদি আমরা শুধু মুখে শোকর শব্দটি উচ্চারণ করি। কিন্তু অন্তরে কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য তার ভাব জাগরুক না হয়, তাহলে আমরা অনুগ্রহকারীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মিথ্যা দাবিদার বলে সাব্যস্ত হব। আল্লাহপাক আমাদের এ শ্রেণীর শোকর কবুল করবেন না। এ কারণেই আল্লাহপাক হযরত দাউদ (আ.) এবং হযরত সুলাইমান (আ.)-কে স্বীয় অযাচিত ইহসানের দ্বারা বিভূূষিত করেছিলেন এবং তার পরই নির্দেশ করেছিলেন, “হে দাউদের গৃহবাসী আপনজন। তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্ত নেক আমল কর।” (সূরা সাবা ঃ রুকু-২) এই আয়াতে পাকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। কেবলমাত্র মুখের মাঝেই যেন সীমিত না হয়। বরং কাজেও তা প্রকাশ করতে হবে। এ জন্যই হযরত সুলাইমান (আঃ) আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, “হে আমার পরওয়ারদিগার! আমাকে সুযোগ দান করুন, যেন আমি ঐ সকল ইহসানের শোকর আদায় করতে পারি, যা আপনি আমার উপর এবং আমার পিতামাতার উপর করেছেন এবং সে নেক কাজ করতে পারি, যা আপনার পছন্দনীয়।” (সূরা নহল ঃ রুকু-২) এই দোয়ার মাঝেও বলা হয়েছে যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আন্তরিক অভিনিবেশসহ নেক আমলও করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে অন্তরে এ কথার উদয়ও হয় যে, আল্লাহপাক শোকরগুজারি বান্দাহদের সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন, তারা যতই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে থাকবে, আমি ততই তাদেরকে বেশি নেয়ামত প্রদান করব। এর বিশ্লেষণ হচ্ছে এই যে, বান্দাহ যতই মালিকের শোকর আদায়ের জন্য কার্যত প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকবে, ঠিক ততখনি নতুন নতুন নেয়ামতও মালিকের পক্ষ হতে নাযিল হতে থাকবে। এ জন্যই আল-কুরআনে ঘোষণা হয়েছে, “যদি তোমরা শোকর আদায় কর, তাহলে আমি তোমাদেরকে অধিক নেয়ামত প্রদান করব, আর তোমরা যদি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে আমার আযাব খুবই কঠিন।” (সূরা ইব্রাহীম ঃ রুকু-২) অপর এক আয়াতে আছে, “এভাবেই আমি কৃতজ্ঞদেরকে বিনিময় প্রদান করি।” (সূরা কামার ঃ রুকু-২) অন্য এক আয়াতে আছে, “অতি সত্বর আমি কৃতজ্ঞদেরকে বিনিময় দন করব।” (সূরা আলে ইমরান ঃ রুকু-১৫)
মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, যদি মানুষের অন্তরে কৃতজ্ঞতার অনুপ্রেরণা পয়দা হয়, তাহলে দীন ও দুনিয়ার মঙ্গলের জন্য কোন প্রকার তাম্বিহ করার প্রয়োজনীয়তা থাকে না। সে স্বভাবতই আল্লাহর নেয়ামতসমূহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে, তার নির্দেশ মোতাবেকই পথ চলবে এবং তার বান্দাহদের সাথে কৃতজ্ঞতা সুলভ আচরণ করবে; এমনকি বান্দাহদের মাঝে পরোপকার সুলভ কর্মকা- বাস্তবায়ন করবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সা.) এক বান্দাহর সাথে অপর বান্দাহর কৃতজ্ঞতা সুলভ কার্যাবলী শোকরগুজারির মানদ- হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, “যে ব্যক্তি মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহর শোকরগুজারিও আদায় করে না।” (জামে তিরমিজী) এই হাদীসের অপর একটি মর্ম হচ্ছে এই যে, যে ব্যক্তি মানুষের ইহসানসমূহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না, আল্লাহপাকও স্বীয় অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতাকে তার নিকট হতে কবুল করবেন না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন