শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিশ্বসেরা ধনীই নন, অনুসরণযোগ্য ব্যক্তিও বিল গেটস

আজম জহিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২২ নভেম্বর, ২০১৯, ৫:২৭ এএম

প্রত্যেক মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একটা আকাক্সক্ষা থাকে। এটা তার স্বভাবগত ধর্ম। কেউ হতে চায় শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, কেউ শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়, কেউ বড় ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, কেউ চাঁদের মাটিতে পা রেখে ধন্য হতে চায়, কেউ এভারেস্টের চূড়ায় উঠে জানান দিতে চায় তার শ্রেষ্ঠত্ব, কেউ বা শীর্ষ ধনী হয়ে তাক লাগিয়ে দিতে চায় পুরো বিশ্বকে। এমনি এক ব্যক্তি যিনি কিনা শ্রেষ্ঠ বা শীর্ষ ধনীর তকমা লাগিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন। ভাগ্যবান এই ব্যক্তিটির নাম বিল গেটস। তিনি এখন বিশ্বের শীর্ষ ধনী। বর্তমানে ১০৫.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক তিনি। কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম মাইক্রোসফট উইন্ডোজ তৈরি করে তিনি কম্পিউটিং জগতের ইতিহাস বদলে দিয়েছেন। ১৯৮৭ সালে শীর্ষ ধনীর তালিকায় উঠে আসা বিল গেটস কয়েক বছর শীর্ষ স্থানে তার নাম ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ১২ বার শ্রেষ্ঠ ধনীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।

৬৪ বছর বয়স্ক বিল গেটস নিজ দেশে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা বিল গেটস প্রতি মাসেই ওই প্রতিষ্ঠানে শত শত কোটি দান করছেন। এসব টাকার বেশিরভাগই ব্যয় করেন দরিদ্র, অসহায়, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পেছনে। মাইক্রোসফট থেকে সরে এলেও বিল গেটস যে আয় করেছেন তা শুনলে রীতিমতো চোখ কপালে উঠে যাবে। প্রতি সেকেন্ডে তার আয় ৩২ হাজার টাকা। সে হিসেবে মিনিট, ঘণ্টা, মাস ও বছরের হিসেবে কষলে টাকার অংকটা কতোতে গিয়ে দাঁড়াবে তা আমাদের মতো লোকদের হিসাব করাটা মুশকিল। জানা গেছে, প্রতিদিন ৮ কোটি টাকা খরচ করলেও তার টাকা শেষ হতে সময় লাগবে ২শ’ ১৮ বছর।

অসম্ভব মেধার অধিকারী বিল গেটসের জন্ম আমেরিকার ওয়াশিংটন শহরের সিয়াটলে। বাবা-মার ইচ্ছে ছিলো ছেলেকে আইনজীবী বানাবেন। কিন্তু সেই আশা নিয়ে বাবা-মা তাকে ভর্তি করে দেন স্থানীয় লেকসাইট স্কুলে। স্বাভাবিক শিক্ষা বাদ দিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের কাজ নিয়ে। কম্পিউটার সেকশনে বসে তিনি প্রথম প্রোগ্রাম লিখে ফেলেন। কম্পিউটার সেকশনের অন্য ছাত্রদের নিয়ে কম্পিউটার সেন্টার কর্পোরেশনের ডেমো অপারেটিং সিস্টেম আবিষ্কার করেন, যা ছিলো নীতিবিরোধী। ফলে তিনিসহ তার তিন বন্ধুকে স্কুল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের এহেন আচরণ তাকে বেশ মর্মাহত করে। তখন থেকেই তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, যে করেই হোক তাকে কম্পিউটার জগতে বিপ্লব ঘটাতে হবে। স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করে তিনি ম্যাজিক দেখান বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। তার বন্ধুদের নিয়ে আবিষ্কার করেন বিশ্বকে বদলে দেয়ার অপারেটিং সিস্টেম। এরপর বিস্ময়কর সাড়া ফেলে তাদের তৈরি মাইক্রোসফট উইন্ডোজ। সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহারকারীগণ আরো সহজে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে এটির প্রতি আগ্রহ দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে। ১৯৮৬ সালে তার প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববাজারে জায়গা দখল করে নিতে সক্ষম হয়। রাতারাতি মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিলিনিয়ারের খাতায় নাম লেখান বিল গেটস। ১৯৯০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটি অপারেটিং সফটওয়ারের পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসার প্রসারে একের পর এক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ শুরু করেন। আর এভাবেই তিনি উঠে আসেন বিশ্বসেরা ধনীর তালিকায়।

বিল গেটস-এর রয়েছে টাকার খনি। যুগ যুগ ধরে বসে খেলেও কিংবা দু’হাতে টাকা উড়ালেও তার অর্জিত সম্পদ কোনোদিন কমবে না। কিন্তু তিনি অন্যরকম মানুষ, একদম ব্যতিক্রমধর্মী। টাকা থাকলেই অবাধে খরচ করতে হবেÑএই মতের বিরোধী তিনি। সাদাসিদেভাবে চলতে অভ্যস্থ বিল গেটস-এর ভেতরে কোনো অহংবোধ নেই। এ কথা তিনি জনসমক্ষে অনেকবার বলেছেন। তার জীবনাচরণ ও পোশাক-আশাক দেখে মনে হবে তিনি একজন অতি-সাধারণ মানুষ। অনেক সময় তাকে ভিড়ের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম কিনতে দেখা গেছে।

তিন সন্তানের জনক বিল গেটস। তিনি তার সন্তানদের জন্য কোনো টাকা-পয়সা রেখে যাবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। সাধারণ জীবন যাপনের প্রয়োজনে যতোটুকু টাকা প্রয়োজন তাই সন্তানদের হাতে তুলে দেন তিনি। বিল গেটস চান, সন্তানরা লেখাপড়া করে মানুষ হোক, চাকরি বা ব্যবসা করে নিজেদের ক্যারিয়ার নিজেরাই তৈরি করুক। এতে তারা জীবনের প্রকৃত সুখ খুঁজে পাবে। আর এ কারণেই তার অর্জিত বিপুল সম্পদ সন্তানদের জন্য রেখে যেতে চান না, বা তাদের নামে কোনো ট্রাস্টও করতে চান না বিল গেটস। গেটসের মতে, তার রেখে যাওয়া বিপুল পরিমাণ সম্পদ উপকারের বদলে ক্ষতির কারণও হতে পারে।

বিল গেটস এমন একজন মানুষ যিনি ক্ষতির আশংকায় ১৪ বছরের আগে তার সন্তানদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেননি। ট্যাব, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, কম্পিউটার ইত্যাদি থেকে সন্তানদের দূরে রেখেছেন। ঘরের খাবার টেবিলে মোবাইল ফোন আনা নিষেধ করে দেন তিনি। তিনি একবার আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বলেছেন, তার সন্তানদের সহপাঠী বন্ধুরা স্কুলে সঙ্গে করে মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার নিয়ে আসতো। সন্তানরাও দাবি জানাতো স্কুলে মোবাইল ফোন-কম্পিউটার ব্যবহারের। আমি তাদের এসব করতে দিতাম না। সন্তানদের ঘুমের সময়ও তিনি ঠিক করে দিতেন। তিনি নিজে প্রচুর বই পড়তেন। সন্তানদের বই পড়তে উৎসাহ দিতেন। তিনি ভ্রমণে কোথাও বের হলে ন্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।

শীর্ষ ধনীর তালিকায় উঠে আসা বিল গেটসকে অন্য শীর্ষ ধনীদের সাথে মেলানো যাবে না। তার নীতি-আদর্শ, প্রজ্ঞা-মেধা অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি অকারণে টাকার শ্রাদ্ধ করতে ঘোর বিরোধী। স্ত্রীর জন্মদিনে বিলাসবহুল বিমান গিফট করা, ছেলে-মেয়ের জন্মদিন বা তাদের বিয়েতে পানির মতো টাকা খরচ করার পক্ষপাতি নন তিনি। তিনি মনে করেন এগুলো নিছক অপচয়। বরং ওই টাকাগুলো মানুষের সেবা বা কল্যাণে খরচ করাই হবে উত্তম।

একজন আদর্শ পিতা বলতে যা বোঝায় তার সবগুলো গুণই বিল গেটসের মধ্যে বিদ্যমান। এমন পিতৃসুলভ আদর্শ মানুষ এখন পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভার। আমরা বিশ্বসেরা ধনীদের ব্যাপারে কমবেশি জানি। তারা কীভাবে টাকা খরচ করেন, বিলাসবহুল জীবন যাপনে অভ্যস্থ তাও কারো অজানা না। বিশ্বসেরা ধনীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। সাধারণ ধনীদের কথাই যদি বলি, তাদের সন্তানরা বাবার সম্পদ ব্যবহার করে বিপথগামী হচ্ছে। টাকার গরমে এমন কোনো অপরাধ নেই যা তাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না। মাদকগ্রহণ, নারীআসক্তি, বখাটেপনা, সন্ত্রাস, গু-ামী-মাস্তানী থেকে শুরু হেন কাজ নেই তারা করছে না। সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা না করে আজকালকার বাবা-মায়েরা বৈধ-অবৈভাবে টাকা রোজগারের পেছনে ছুটছেন। তারা এমনই ব্যস্ত যে, সন্তানের পেছনে সময় ব্যয় করার মতো সময় তাদের হাতে নেই। ফলে আদরের সন্তানরা নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। সে হিসেবে একজন আদর্শ বাবা হিসেবে বিল গেটস শুধু ব্যতিক্রমীই নন, অনুসরণযোগ্যও।
বিল গেটসের বিকল্প বিল গেটসই। তিনি নিজেই একটি উপাখ্যান, একটি ইতিহাস। অন্য দশজন শীর্ষ ধনীর মতো নন তিনি। আজকাল ধনী বা বিত্তবান মানেই টাকার অহংকার, দম্ভ, যেনো মাটিতে পা-ই পড়তে চায় না। বিস্তর টাকা হলেই দেশে-বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি, কোটি টাকার গাড়ি, নারী বডিগার্ড সঙ্গে রাখা, কোটি টাকার হীরাখচিত কলম ব্যবহার, মন্ত্রীদের মতো সাইরেন বাজিয়ে চলাফেরা, সুইস ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়ে তোলা তাদের জন্য কোনো ব্যাপারই না। বিল গেটসকে তাই অন্য দশজন শীর্ষ ধনীর সাথে কিছুতেই মেলানো যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক, নাট্যকার, ছড়াকার

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
M ABU BAKAR ২২ নভেম্বর, ২০১৯, ১১:০৮ এএম says : 0
অসাধারণ!
Total Reply(0)
kamrul Hosen ২২ নভেম্বর, ২০১৯, ১১:৩৮ এএম says : 0
আমি একদিন একটা ছবির মধ্যে বিল গেটস কে লাইনে দাড়িয়ে বার্গার কিনতে দেখে রিতিমতো অবাক যে কিনা কয়েক হাজার বার্গারের দোকান দিতে পারে সে কিনা লাইনে দাঁড়িয়ে বার্গার কিনতেছে আসলে এটাই হলো একজন সৎ মানুষের পরিচয় যে কিনা তার পরিশ্রমের মাধ্যমে তার টাকাগুলো অর্জন করেছে ওই জন্য তিনি জানেন তাঁর টাকাগুলো কিভাবে কোন ভাবে ব্যয় করলে সঠিক পথে ব্যয় হবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন