কামরুল হাসান দর্পণ
পুলিশের সাত দিনব্যাপী জঙ্গি ধরার সাঁড়াশি অভিযান শেষ হয়েছে। অবশ্য কোনো কোনো পত্রিকা মারফত জানা যায়, ঘোষণা দেয়া সাত দিন শেষ হলেও, অভিযান এখনও চলছে। প্রতিদিনই শ’খানেক করে অভিযুক্ত ধরা পড়ছে। সাত দিনের বিশেষ অভিযান নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক ও বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। একজন কা-জ্ঞানসম্পন্ন মানুষকেও এ অভিযান সম্পর্কে একটা ভালো কথা বলতে শোনা যায়নি। একমাত্র সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও পুলিশের মুখেই অভিযানের ব্যাপক সাফল্যের কথা শোনা গেছে। সাত দিনের অভিযান শেষে দেখা গেল, গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা ১৪ হাজার ৫৫২ জন। এরমধ্যে পুলিশের ভাষ্যমতে জঙ্গি হচ্ছে ১৯৪ জন। জঙ্গিবিরোধী অভিযান কতটা সফল হয়েছে, তা জঙ্গির এই সংখ্যা দেখলে বোধকরি বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজন পড়ে না। বাকি যে ১৪ হাজারের বেশি গ্রেফতার হয়েছে, নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তারা জঙ্গি নয়। এরমধ্যে বেশিরভাগই ছিঁচকে চোর থেকে শুরু করে ওয়ারেন্টভুক্ত বা পুরনো মামলার আসামি রয়েছে বলে পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রায় প্রতিদিনই বের হয়েছে। বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি দাবি করেছে তাদের প্রায় তিন হাজার নেতাকর্মী রয়েছে। সবচেয়ে বড় খবরটি হচ্ছে, এর মাধ্যমে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ গ্রেফতার ও হয়রানির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য চলেছে। এমনও বলা হচ্ছে, যারা পুলিশকে তার চাহিদা মতো অর্থ দিতে পারেনি, তাদের অনেকেই গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছে। যারা দিতে পেরেছে, তারা ছাড়া পেয়েছে। ছাড়া পাওয়াদের সংখ্যা হিসাবে ধরা হলে, গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা যে আরও অনেক বেশি হবে, তাতে সন্দেহ নেই। পত্র-পত্রিকায় এমন খবরও বের হয়েছে, অভিযানে যেসব নিরীহ সাধারণ মানুষ ধরা পড়েছে, তাদের ছুটাতে গিয়ে স্বজনদেরকে সহায়-সম্বল পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। প্রিয় মানুষটিকে আইনের অপপ্রয়োগের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তারা এসব সম্বল বিক্রি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে অনেক ধরনের মন্তব্য করেছেন। তবে এ কথার সাথে অনেকেই একমত হয়েছেন যে, ‘এবার কারো ঈদ কাটবে চোখের পানিতে, কারো ঈদের আনন্দ কাটবে ডাবল খুশিতে।’ কাদের ঈদ চোখের পানিতে কাটবে, আর কাদের দ্বিগুণ আনন্দে কাটবে, পাঠকমাত্রই তা বুঝতে পারছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রেফতার বাণিজ্যের যে অভিযোগ উঠেছে, তাতে কী পরিমাণ বাণিজ্য হয়েছে এর একটি আনুমান নির্ভর হিসাব কেউ কেউ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কেউ বলছেন ১৪ কোটি, কেউ বলছেন ২৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। যদি ধরে নেয়া হয়, সত্যি সত্যি এই পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয়ে থাকে, তবে নিশ্চিতভাবেই পুলিশের একটি শ্রেণী যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে, তাদের সন্তানরা এবারের ঈদে অনেক আনন্দে থাকবে। তাদের এই বাড়তি আনন্দের জোগান দিয়েছেন তাদের বাবা কর্তৃক গ্রেফতারকৃত নিরীহ সাধারণ মানুষ। এইসব মানুষ তাদের বাবা, ভাইকে ছাড়িয়ে নিতে সহায়-সম্বল বিক্রি করে তাদের বাবাকে উৎকোচ দিয়ে রেহাই পেয়েছে। উৎকোচের বিনিময়ে ছাড়া পাওয়াদের ঈদ যে চোখের পানিতে কাটবে তাতে সন্দেহ নেই। তবে অর্থ-কড়ি বা সহায়-সম্বল হারালেও তাদের আনন্দ ও সান্ত¦না থাকবে এই, বাবা বা ভাইটিকে তো আর জেলে থাকতে হচ্ছে না, পাশে তো পাচ্ছি।
দুই.
এই অভিযানে এমন প্রশ্ন অনেকে তুলেছেন, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে তো কোনো বেশভূষাধারী হোমরা-চোমরা ধরনের লোক ধরা পড়তে দেখা যায়নি। টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় যেসব ছবি দেখা গেছে, একেবারে হতশ্রী ও হতদরিদ্র লোকজনের ছবিই বেশি দেখা গেছে। কোনো ভদ্রবেশধারী ও পয়সাওয়ালা দুর্ধর্ষ কাউকে দেখা যায়নি। তার অর্থ হচ্ছে, যারাই ধরা পড়েছে তাদের অধিকাংশই একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের। এদের উপর দিয়ে অভিযানের ঝড় বইয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের কারেন্ট জালে চুনোপুটিই বেশি ধরা পড়েছে। সপ্ত শতাব্দীতে শশাঙ্কের শাসনামলের শেষ দিকে এই বাংলায় বেশ অরাজকতা দেখা দিয়েছিল। অরাজকতা চলাকালে, প্রভাবশালীরা কমজোরি বা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের উপর বেশি আক্রমণ চালানো হতো। তাদের বিনাশে সর্বশক্তি প্রয়োগ করা হতো। এই অরাজকতাকে তখন নাম দেয়া হয় মাৎসান্ন্যায়ন। অর্থাৎ বড় বড় মাছ ছোট ছোট মাছকে খেয়ে ফেলছে। এবারের বিশেষ অভিযানে নিরীহ ও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেল, তাকে অনেকটা এই মাৎসান্ন্যায়নের সাথে তুলনা করা যায়। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিই যেন এখন মাৎসান্ন্যায়নের নীতিতে চলছে। দেশের জনগণ গুঁড়া মাছ আর সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রুই-কাতল-বোয়াল। সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা যেত সামরিক শাসনামলে। তখন জনগণের একটা সান্ত¦না থাকত, সামরিক শাসন চলছে, ওরা এমনই করবে। তবে বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যদি সামরিক বাহিনীর মতো ব্যবহার করে জনগণকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা হয়, তখন তা সামরিক শাসনের আতঙ্ককেও ছাড়িয়ে যায়। এই সময়ে যে কোনো একজন সাধারণ মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ভাই, আপনি কি স্বস্তিতে আছেন? উত্তর যে শতভাগ নেতিবাচক হবে তাতে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। আবার তাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার সবচেয়ে বড় ভয় কি? তার উত্তর হবে, বাঘও না ভাল্লুকও না, কুমিরও না সাপও নাÑপুলিশ! সাথে ছোট্ট একটি ব্যাখ্যা জুড়ে দিয়ে বলবে, পুলিশ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের কাছ থেকে আমাদের অধিক নিরাপত্তা দিতে গিয়ে নিজেরাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। কনফিউজড হয়ে যাকেই দেখে তাকেই জঙ্গি মনে করা শুরু করেছে। আর গ্রেফতার করে নিজের বুঝটুকু ঠিকই বুঝে নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। এছাড়া যখন-তখন হয়রানি তো আছেই। আরও বড় ভয় হচ্ছে, সন্ত্রাসী-মাস্তান এবং যারা সত্যি সত্যি জঙ্গি কার্যক্রমে লিপ্ত হয়ে মানুষকে কুপিয়ে মারছে তাদের। এসব কথিত জঙ্গিদের তো কোনো মা-বাপ নাই, যখন খুশি তখন কুপিয়ে যাবে। বোঝার কোনো উপায় নাই। সাধারণ মানুষের যখন এ পরিস্থিতি, তখন সরকারের তরফ থেকে আহ্বান জানিয়ে বলা হচ্ছে, জনগণকে এসব মোকাবেলায় এগিয়ে আসতে। আমরা দেখেছি, সরকার একাধিকবার বলেছে ঘরে ঘরে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। পুলিশও একই কথা বলেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে জনগণ ঘরেই জান বাঁচাতে পারছে না, সে বাইরে এসে কীভাবে জঙ্গি মোকাবেলা করে জান বাঁচাবে? অবশ্য ইদানিং পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়, পুলিশ জঙ্গি মোকাবেলায় জনগণের হাতে হাসিমুখে বাঁশ তুলে দিচ্ছে। এই বাঁশের অর্থ কি, সারা জীবন বাঁশ খাওয়া সাধারণ মানুষের আর বুঝতে বাকি থাকে না। এর অর্থ যদি এই হয়, জনগণ! এই নাও বাঁশ, এবার নিজেরাই লাঠালাঠি কর। একে অপরকে বাঁশ দাও। হাত নিশপিশ করলে বাঁশ ঘুরিয়ে কারো মাথায় বসিয়ে দাও। স্বাধীন দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন নিজেরাই জনগণের হাতে বাঁশ তুলে দিয়ে বলে আপনারা সন্ত্রাসীদের মোকাবেলা করুন, তখন সেই দেশের জনগণের কি আর নিরাপদবোধ করার কারণ থাকতে পারে? মনে করা কি যায়, দেশে কোনো সরকার বা সুশাসন আছে? সরকার কথায় কথায় জনগণের কথা বলছে। জনগণের উন্নয়নের কথা বলছে। আবার জনগণের নিরাপত্তা জনগণকেই করার কথা বলছে। যেখানে জনগণকে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে হয়, সেখানে উন্নয়ন হয় কিভাবে? যে সরকার জনগণের যথাযথ নিরাপত্তা দিতে পারে না, সে সরকার কি জনগণের হতে পারে? অবশ্য বর্তমান সরকার জনগণের সরকার কিনা, এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেকে এ সরকারকে সংবিধানের সরকার মনে করলেও, জনগণের সরকার মনে করে না। কারণ জনগণের সরাসরি ভোটে এ সরকার নির্বাচিত হয়নি। সরকার গঠনের মধ্যে এক ধরনের জোরজবরদস্তি রয়েছে। এতে অর্ধসত্য রয়েছে। পরিপূর্ণ সত্য নেই। সাংবিধানে লিখিত বিধি মোতাবেক বৈধ, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে বা সম্মতিতে নির্বাচিত নয়। যে সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয় না, সে সরকার কী করে জনগণের সহায়তা কামনা করে? এ প্রশ্নও এখন অহরহ উঠছে। অনেকে মনে করে, ক্ষমতাসীন দলের কম-বেশি যে ৩০-৪০ শতাংশ ভোট রয়েছে, এ ভোটেও যদি নির্বাচিত হয়ে আসত, তাহলেও সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতার পাল্লা ক্রমাগত ভারী হতো না। ক্ষমতার নৌকাটি একদিকে কাত হয়ে থাকত না। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ায় এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক রায় না নেয়ায় সরকারের কনফিডেন্সের জায়গাটা যেমন কমে গেছে, তেমনি অতি সাহস দেখাতে গিয়ে সব গোলমাল পাকিয়ে ফেলছে এবং একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এখন এমন একটা প্রবণতা লক্ষ্যণীয় যে তারা মনে করে দেশটা শুধু তাদের। কাজেই তারা যেভাবে চালাবে এবং বলবে, সেভাবে সবকিছু চলবে। তার কথাই শেষ কথা। এই দেশে যে আরও ষাট ভাগ মানুষ রয়েছে, যারা সরকারকে সমর্থন করে না, এ কথা সরকার মানতেই পারছে না। এই মনোভাব যে কতটা গোয়ার্তুমিপূর্ণ এবং স্বৈরমানসিকতা সম্পন্ন, তা বোধকরি বিস্তারিত বলার অবকাশ নেই। একগুয়েমি মনোভাবের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে গিয়ে দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা সে নিশ্চিত করতে পারছে না। বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীর উৎপাত এবং এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া থেকে বুঝতে বাকি থাকে না, সরকার মুখে যতই তার সাফল্যের কথা বলুক, বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই হয়।
তিন.
ক্ষমতাসীন দলের জনসমর্থন এখন কতটুকু আছে, তা একমাত্র সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই বোঝা যেত। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমনকি ক্ষমতাসীন দলের অনেক সমর্থকের মধ্যেও এমন ধারণা বিরাজমান, ক্ষমতাসীন দলের জনসমর্থন অকল্পনীয় হারে কমে গেছে। ক্ষমতাসীন দল যে বোঝে না, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। সে ভালোই বোঝে। এটাও বোঝে বর্তমানে তার যে জনসমর্থন রয়েছে, তা দেশ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। সাধারণত জনগণ যে দলকে নির্বাচিত করে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেয় জনগণ তার পেছনে সর্বশক্তি দিয়ে সহায়ক হয়ে থাকে। ব্যর্থ হলে মেয়াদন্তে তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে অন্য দলের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে। যখন একটি সরকার জনগণের এ শক্তি উপেক্ষা করে ট্রিক্স-এর আশ্রয় নেয় এবং তা যতই আইন-কানুনের আওতায় হোক, জনগণ তা মেনে নেয় না। কারণ জনগণ চায়, শুধু সংবিধানের দোহাই দিয়ে নয়, সংবিধান মোতাবেক এবং ভোটের মাধ্যমে তার মতামত নিয়েই সরকার গঠিত হোক। বর্তমান সরকার জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করেনি। সে ট্রিক্স পলিটিক্স-এ গেছে। ফলে এই ট্রিক্সের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সে সরকার যখন জনগণকে আহ্বান করে তাকে সহায়তা করার, তখন তাতে সাড়া পাওয়ার আশা করা জনগণের কাঁটা গায়ে নুনের ছিঁটা দেয়ার মতো হয়ে দাঁড়ায়। তার উপর যদি সরকার জনগণের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হয় এবং জনগণকেই নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিতে বলে, তখন জনগণের দুঃখের সীমা থাকে না। প্রশ্ন হচ্ছে, যে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করে কোণঠাসা করে ফেলতে পারে, সে কেন জঙ্গি দমন করতে পারছে না? জঙ্গিরা কি বিরোধী দলের চেয়ে অধিক শক্তিশালী যে তাদের দমন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে? জনগণকে কেন নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেদের করতে হবে? বিরোধী দলের রাজনীতি দমন এবং তাদের কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে কি জনগণের সহায়তা চাওয়া হয়েছিল? তখন তো জনগণকে আহ্বান করে বলা হয়নি, আসেন, আমরা একটি নির্বাচন দিয়ে বিরোধী দলকে বর্জন করি। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জনগণের শক্তির পরিবর্তে বলপ্রয়োগকে মূলমন্ত্র হিসেবে নিয়েছে। জনগণকে বাদ দিয়ে যখন সরকার গঠন ও পরিচালনা করা হয়, তখন সরকার জনগণকে ডাকলে তারা সাড়া দেবে, এমন আশা করাও তো একটা মানসম্মান ও ইজ্জতের ব্যাপার।
চার.
আমরা যদি সরকারের শাসন প্রক্রিয়ার প্রবণতার দিকে তাকাই তাহলে দেখব, এ প্রবণতার মূলই হচ্ছে দমন নীতি। খাঁটি বাংলায় যাকে বলে ‘ডা-া মেরে ঠা-া’ করা। সরকারের কর্মকা- এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণের দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। চারদিকে কেমন এক ‘চোখ রাঙ্গানী’ ও ঘাড় ঘুরিয়ে ‘কটমট করে তাকানো’র মতো পরিবেশ। এসব দেখলে নিরীহ জনগণকে কচ্ছপের মতো মাথাটা কোনো রকমে বের করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার খোলসের ভেতর ঢুকে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সরকার এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি জরি করে রেখেছে। অবশ্য সাংবিধানের দোহাই দেয়া সরকারের জনগণকে এভাবে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। তা না হলে তার ক্ষমতায় থাকার ভিতই নড়বড়ে হয়ে যাবে। জনগণকে বগলদাবা বা খোলসের ভেতর না রাখলে সরকারের জন্য বিরাট প্রবলেম। আর বগলদাবা করেই বলতে হবে, জনগণকে সাথে নিয়েই জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করব। পাশাপাশি জনগণকে ঠা-া ও ভীত রাখার জন্য প্রায়ই কথিত ‘বন্দুক যুদ্ধ’, সাঁড়াশি অভিযান, কথায় কথায় গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া ইত্যকার ঘটনা ঘটিয়ে যেতে হবে। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়ে যাবে। একদিকে কথিত সন্ত্রাসীও মারা হলো, অন্যদিকে জনগণকেও ভয় ধরিয়ে দেয়া হলো। জনগণ যে সরকারের এসব চাল ও চালাকি বোঝে না, তা নয়। সবাই বোঝে। তবে বেরিকেড দিয়ে থাকা সরকার ক্ষমতা ও শক্তির মদমত্তে মনে করছে, জনগণ এসব কিছুই বোঝে না এবং যেভাবে রাখা হবে তারা সেভাবেই থাকবে। রঙিন চশমা পরা সরকারের কাছে সবকিছুই সুন্দর মনে হবে, এটাই স্বাভাবিক। মাঝেমাঝে তন্দ্রাভেঙে বলবে, জনগণ আমাদের সাথে আছে। তাদের সাথে নিয়ে জঙ্গি ও সন্ত্রাস মোকাবেলা করব। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে ‘থিংস ডান বাই হাভস আর নেভার ডান রাইট’। অর্ধেক কাজ কখনোই সঠিক হয় না। যে কাজ অর্ধসমাপ্ত তা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কাজ করা সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার যতই জনগণের দোহাই দিক না কেন, সে সংবিধানের সরকার হলেও জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার নয়। ফলে এ সরকার সাংবিধানিক ধারা বজায় রাখতে পারলেও, জনগণের সম্মতি না থাকায় তার কল্যাণ করা তার পক্ষে কঠিন হওয়াই স্বাভাবিক। সরকার যা করতে পারে তা হচ্ছে, অনেকটা মন ভোলানো কিছু কর্মকা-ের উদ্যোগ নেয়া। এ সরকারও তাই করার চেষ্টা করছে। তবে এটা কোনোভাবেই জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট নয়। এটা অনেকটা কোনো আগন্তুক কর্তৃক ছোট শিশুদের চকচকে-ঝকঝকে খেলনা দেখিয়ে কিছু সময় সন্তুষ্ট বা আকৃষ্ট করে রাখার মতো। তবে দিন শেষে শিশু তার আপন অভিভাবককের কাছেই ফিরে যায়। গোয়ারতুমি না করে এ সত্যটি সরকার যত দ্রুত বুঝতে পেরে জনগণের সত্যিকারের অভিভাবক হওয়ার উদ্যোগ নেবে, তত দ্রুতই দেশ ও জনগণের উপর যে অশুভ শক্তির থাবা বিস্তৃত হচ্ছে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ হবে।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন