শিশু জনের পর পিতা-মাতার উপর অর্পিত দায়িত্বগুলোর মধ্যে সন্তানের নামকরণ অন্যতম একটি দায়িত্ব। অর্থপূর্ণ এবং রুচি সম্পন্ন সন্তানের নামকরণকে ইসলামে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজ আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়েদের নাম রাখার ক্ষেত্রে অনেক অসচেতনতা ও দারুণ আলসেমী পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে অনেক অভিভাবকদের মাঝে ইসলামী নাম রাখার আগ্রহ থাকার পরও অজ্ঞতাবশত এমন কিছু নাম নির্বাচন করা হয় যেসব নাম আদৌ ইসলামী নামের আওতাভুক্ত নয়। নামটি আরবি অথবা কুরআনের শব্দ হলেই যে নামটি অর্থবোধক বা ইসলামী হবে এমন ভাবনা সঠিক নয়। কারণ পবিত্র কুরআনে তো ইবলিস, ফেরাউন, হামান, কারুন, আবু লাহাবসহ অনেক পাফের এবং পাপিষ্ট লোকদের নামও রয়েছে। তাই বলে কী এসব নামে নাম বা উপনাম রাখা সমীচীন হবে কী?
মানুষের কৃতিত্ব ও গুণাবলী শৈশবকালের রাখা সেই নামেই ছড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তির চরিত্র, কৃতিত্ব নামেই প্রকাশিত হয়। সুন্দর ও ইসলামী নামের বদৌলতে ভবিষ্যৎ জীবনও সুন্দর এবং সুখময় হয়। মানুষের জীবনে সুন্দর নামেরও একটি প্রভাব রয়েছে। কাজেই সন্তানের জন্য একটি সুন্দর ও অর্থবোধক নাম রাখা প্রত্যেক মা-বাবার অন্যতম একটি দায়িত্ব। যাতে এ নামের প্রভাবে পরবর্তী জীবনে সন্তানের স্বভাব-চরিত্রে শুচি, শুভ্রতা ফুটে ওঠে। ব্যক্তির নাম তার স্বভাব চরিত্রের উপর ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে বলে হাদিসে বর্ণিত আছে। শায়খ আবু বকর আবু যায়েদ বলেন-ঘটনাক্রমে দেখা যায় ব্যক্তির নামের সাথে তার স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের মিল থাকে। এটাই আল্লাহর তাআলার হেকমতের দাবি যার নামের মধ্যে গাম্ভীর্যতা আছে তার চরিত্রে গাম্ভীর্য পাওয়া যায়। খারাপ নামের অধিকারী লোকের চরিত্রও খারাপ হয়ে থাকে। ভালো নামের অধিকারী ব্যক্তির চরিত্রও ভাল হয়ে থাকে। (তাসমিয়াতুল মাওলুদ-বকর আবু যায়দ ১/১০, তুহফাতুল মাওদুদ-ইবনুল কাইয়্যেম ১/১২১)।
পবিত্র কোরআন-হাদিসে অর্থবোধক ভালো নাম রাখার ব্যাপারে তাকিদ দেয়া হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন-‘একদা সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সা.) এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, হুজুর পিতার হক সর্ম্পকে তো আমরা আপনার কাছ থেকে জানলাম। পিতার উপর সন্তানের হক সম্পর্কে আমাদেরকে জানান! তদুত্তরে রাসূল (সা.) এরশাদ করলেন, পিতা সন্তানের অর্থপূর্ণ ভালো নাম রাখবে এবং তাকে সুশিক্ষা দিবে। (বায়হাকি)। হজরত আবু ওহাব জুশানী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা নবীদের নামে নিজেদের নাম রাখবে। তবে আল্লাহর নিকট সর্বোত্তম নাম হলো আবদুল্লাহ ও আবদুর রহমান। (আবু দাউদ)। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, যার সন্তন জন্ম গ্রহণ করে সে যেন সন্তানের সুন্দর নাম রাখে ও সুশিক্ষা দেয় এবং প্রাপ্তবয়ষ্ক হলে তাকে বিবাহ প্রদান দান করে। (বূখারি)।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, তোমরা সন্তানদের তার পিতার নামেই ডাক সেটাই আল্লাহর কাছে ন্যায়সঙ্গত। (সূরা আহযাব : ৫)। হজরত আবূ দারদা (রা.) হতে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের পিতার নামে ডাকা হবে। অতএব তোমাদের নামগুলো অর্থবোধক রাখো। (আবু দাউদ)। রাসূল (সা.) সুন্দর নাম পছন্দ করতেন এবং তিনি সুন্দর নাম রাখার জন্য আদেশও করেছেন। ইবনে কাইয়্যেম জাওযী (রাহ.) তার কিতাব ‘তুহফাতুল মাওদূদ বি আহকামিল মাওলুদ’ এর মধ্যে বলেন নামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবেই মানুষের ভালো-মন্দ আচরণ, চরিত্র ও কর্মধারা প্রভাবিত হয়। মন্দ নামেরও মন্দ প্রভাব রয়েছে। ইমাম মালেক (রাহ.)-এর প্রসিদ্ধ হাদিসের কিতাব ‘মুয়াত্তায়’ বর্ণিত রয়েছে হযরত ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ (রা.) হতে বর্ণিত, ওমর ইবনে খাত্তাবের কাছে জুহারনা কাবীলার এক ব্যক্তি এলো। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার নাম কী? সে বলল জামরা (অগ্নিস্ফুলিঙ্গ), তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কার পুত্র সে বললো ইবনে শিহাব (অগ্নিশিখার পুত্র), তিনি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন কোন গোত্রের সে বললো হারাকা (প্রজ্জলন), তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তোমার বাড়ি কোথায়? সে বললো হারাকা (অগ্নিগর্ভে), তিনি শেষে জিজ্ঞাসা করলেন কোন অংশে সে বললো বিযাতিল লাযা (শিখাময় অংশে)! ওমর (রা.) তাকে বললেন যাও তোমার গোত্রের লোকদের কাছে গিয়ে দেখ তারা ভস্মীভূত হয়েছে! লোকটি বললো তাদের কাছে এসে দেখলাম সত্যিই তারা সকলেই ভস্মীভূত হয়েছে। মন্দ নামের প্রভাব মানুষের চরিত্র ও আচরণকে প্রভাবিত করে। রাসূল (সা.) এর নিকট কেউ আসলে তার নাম জিজ্ঞাস করতেন নাম পছন্দ হলে খুশি হতেন, অপছন্দ অর্থহীন হলে তা পরিবর্তন করে অর্থপূর্ণ নাম রেখে দিতেন। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম নাম হচ্ছে আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান। রাসূল বলেছেন-তোমাদের নামসমূহের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে- আব্দুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা) ও আব্দুর রহমান (রহমানের বান্দা)। আবার আল্লাহর অন্যান্য নামের সাথে আরবী ‘আব্দ’ (বান্দা বা দাস) শব্দটিকে সমন্ধিত করে নাম রাখাও উত্তম। (মুসলিম)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন