জামালউদ্দিন বারী
ব্রেক্সিট বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বেরিয়ে যাওয়ার গণভোট বিশ্ব ইতিহাসের একটি নতুন মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। তবে এই রেফারেন্ডামের ফলাফল অনুসারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইউনাইটেড কিংডম তার পুরনো সা¤্রাজ্যবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে কিনা তা নিয়ে যুক্তরাজ্যের জনগণ এবং রাজনীতিকদের মধ্যে একটি প্রগাঢ় সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য ও আত্মবিশ্বাসের দিক থেকে বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদ আর আগের অবস্থানে নেই। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য রেফারেন্ডামই যথেষ্ট নয়। সেই সাথে বৃটিশ পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কমিশন এবং তাদের আইনগত প্রটোকলসহ অনেকগুলো ধাপ পেরোনোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ওসব আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগেই বৃটিশ জনমত এরই মধ্যে ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করেছে। গত ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। বিশেষত বৃটিশ পাউন্ড ও অর্থবাজারে অপ্রত্যাশিত ধস নামে। এই বাস্তবতার মুখোমুখি বৃটিশ নাগরিকদের অনেকেই তাদের সুর বদলে ব্রেক্সিটের বিপক্ষে অবস্থান নিতে শুরু করেছেন। গণভোটে ২ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে ব্রেক্সিট পন্থিদের জয় হয়েছে, ভোটের অংকে যা ১৫ লাখের কম। অন্যদিকে ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে একটি অনলাইন ক্যাম্পিংয়ে ইতোমধ্যেই প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ নিজেদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে অনুষ্ঠিত গণভোটে শতকরা ৭১ ভাগ ভোটার ভোট দিলেও যারা ভোটদানে বিরত ছিলেন তাদের বেশির ভাগ এখন ব্রেক্সিটের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন বলে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে। এরা এখন পুনরায় গণভোটের দাবি জানিয়ে গণস্বাক্ষর অভিযানে অংশ নিচ্ছে। ব্রেক্সিট রেফারেন্ডামের পর যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি-অর্থনীতি ও সিভিল সোসাইটিতে যে ধরনের তোলপাড় শুরু হয়েছে তাতে শেষ পর্যন্ত এর ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখনই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের সরে যাওয়ার সাথে সাথে আরো কয়েকটি দেশ ইইউ থেকে সরে যাওয়ার প্রাথমিক চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। সেই সাথে স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে স্বাধীনতার জন্য গণভোটের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। রেফারেন্ডামের ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশের শুরুতেই বৃটিশ প্রটেকটরেট জিব্রালটারের নির্বাচনী ফলাফল টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠতে দেখা যায়, যেখানে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে মত দিয়েছে। চূড়ান্ত ফলাফলের পর স্পেন জিব্রালটারের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণের অংশীদারিত্বের দাবি তুলেছে। অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার সাথে সাথে উত্তর আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও জিব্রালটারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। এতসব প্রতিবন্ধকতার কারণেই ব্রেক্সিটের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে এখনো যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
এমনিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অন্যান্য আঞ্চলিক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ফোরামগুলোর মতো করেই চিত্রিত করা হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপট আরো সুদূরপ্রসারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্যতম একটি সম্মিলিত শক্তি হিসেবে প্রভাব ও অবস্থান বজায় রাখছে। বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার বোঝাপড়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদের বিস্তৃতি ও সামর্থ্যরে পূর্ণতা লাভ করেছে। ইউরোপের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের ইতিহাসের সর্বশেষ ধাপে একটি ‘সুপ্রান্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন’ হিসেবে ১৯৫০ সালে ইউরোপিয়ান স্টিল অ্যান্ড কোল কমিউনিটি (ইসিএসসি) নাম দিয়ে বাহ্যিকভাবে একটি বাণিজ্যিক প্লাটফর্ম হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে তা ইউরোপীয় ইউনিয়নে রূপান্তরিত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক ভিত্তির গভীরে রয়েছে ইউরোপীয় নেতাদের হাজার বছরের আকাক্সক্ষা ও ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক চেতনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদারদের কথা পুরো বিশ্ব জানে, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফাউন্ডিং ফাদারদের কথা ততটা আলোচিত না হলেও আধুনিক ইউরোপে পশ্চিমা অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদের ভিত্তি গড়ে তোলতে তাদের চিন্তাধারা যে কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে গত ৬ দশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির দিকে তাকালে তা অনুধাবন করা যায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফাউন্ডিং ফাদারদের অন্যতম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী রবার্ট শুম্যান (জন্ম ২৯ জুন ১৮৮৬- মৃত্যু ৪ঠা সেপ্টেম্বর ১৯৬৩) ১৯৪৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের প্রস্তাব রাখতে গিয়ে এক বক্তৃতায় রোমান সা¤্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত ইউরোপীয় সভ্যতা পুনরুদ্ধারে তাদের পূর্বপুরুষদের হাজার বছরের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। মধ্যযুুগে রোমান চার্চ সে স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হলেও পঞ্চদশ-সোড়শ শতকের ইউরোপীয় রেনেসাঁসের লেখক দার্শনিক, দান্তে, ইরাসমাস, রুশো, কান্ট ও প্রুধোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে টমাস মোরের ‘ইউটোপিয়া’র মতো একটি সমৃদ্ধ রিপাবলিক গড়ে তোলার লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার যাত্রা শুরু করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বপ্নদ্রষ্টা বা প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন (১৯৪৯) ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদিও ফ্রান্সিসকো গাসপেরি, বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী পল হেনরি স্পাক এবং ফরাসি কূটনীতিক-রাজনীতিক এবং প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর লিগ অব নেশনস-এর ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল জাঁ ওমার গাব্রিয়েল মনে এবং ফরাসি প্রধানমন্ত্রী রবার্ট শুম্যান একটি যুদ্ধমুক্ত সমৃদ্ধ ইউরোপ গড়ে তোলতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের গোড়াপত্তন করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে জাতিগত বিদ্বেষ ও আধিপত্যবাদী নীতি পরিহার করে আঞ্চলিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে স্থিতিশীলতা ও আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলাই ছিল বাহ্যিকভাবে এই আঞ্চলিক ফোরামের লক্ষ্য। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত, জার্মানি (পশ্চিম) ও ইতালিকে সাথে নিয়ে একটি সমৃদ্ধ ইউরোপের নতুন ও দীর্ঘস্থায়ী পথচলা নিশ্চিত করা। এই আঞ্চলিক ফোরামের প্রতিষ্ঠালগ্নে যুক্তরাজ্য অনুপস্থিত থাকলেও যুক্তরাজ্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ২৮ জাতির ইউরোপীয় ইউনিয়নে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার সাড়ে ৭ ভাগের কম মানুষের বাস হলেও বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ২৫ ভাগই এই দেশগুলো ভোগ করে। ছয় দশক ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য বিরোধ ও যুদ্ধ পরিহার করতে সক্ষম হলেও তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে প্রতিটি আঞ্চলিক ও গৃহযুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ অংশগ্রহণ রয়েছে। তাদের সম্মিলিত স্বার্থরক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইএমএফ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার পাশাপাশি সামরিক জোট ন্যাটো বাহিনীও সমন্বিত ভূমিকা পালন করে চলেছে। ব্রেক্সিট সফল হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডসসহ আরো কয়েকটি দেশ এই ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এর ধারাবাহিকতায় ন্যাটো জোটেও ভাঙন ধরতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পেছনে এর ফাউন্ডিং ফাদারদের মধ্যে মুসলমানদের হাতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের বেদনা এবং টমাস মোরের ইউটোপিয়ার চেতনা কাজ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত জার্মানি ও ইতালিকে নিয়ে ফরাসি ও বেলজীয় নেতারা একটি রিকনসাইল ইউরোপ গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিলেও তারা কখনো প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অটোমান সা¤্রাজ্যের উত্তরাধিকারী তুরস্ককে সাথে রাখার কথা ভাবেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য তুরস্ক গত তিন দশক ধরে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও সেখানে তার স্থান না হওয়ার কারণ সম্ভবত তুরস্কের মুসলিম আত্মপরিচয়। ঊনবিংশ শতকের বেলজীয় প-িত ও ইতিহাসবিদ হেনরি পিরেনি তার ‘মেডিয়েভাল সিটিজ’ নামক গ্রন্থে অষ্টম শতকের ফরাসি স¤্রাট ও রাষ্ট্রনায়ক শার্লমেন বা কিং প্রথম চার্লস এবং ইসলামের মহানবী মুহাম্মদ (সা.) এর একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। সেখানে পিরেনি আধুনিক ইউরোপের রাজনৈতিক বিবর্তনের পেছনে জার্মান সা¤্রাজ্যবাদের ইনভেশনের চেয়ে ইসলামের অগ্রযাত্রার কারণে ওয়েস্টার্ন সিভিলাইজেশনের থমকে যাওয়া ও ভেঙে পড়াকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। সে সময় শার্লমেন প্রথম ইসলামের প্রভাবমুক্ত একটি ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তবে উমাইয়া খলিফাদের সময়োপযোগী তৎপরতায় তিনি মুসলমানদের ওপর কর্তৃত্ব অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মুসলমানদের দিগি¦জয়, ব্যবসায়-বাণিজ্যে সাফল্য এবং ঐক্যবদ্ধ ও খলিফার প্রতি অনুগত প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর দ্বারা এক নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার ইতিহাস উঠে এসেছে পিরেনির বর্ণনায়। ১৯৪৯ সালে স্ট্রসবার্গের বক্তৃতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবের শুরুতেই রবার্ট শুম্যান ইউরোপের হাজার বছরের ঐতিহাসিক উত্থান পতন ও বিবর্তনের প্রসঙ্গ তুলে এনেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাটো সামরিক জোট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ও স্বাক্ষরদাতাও ছিলেন তৎকালীন ফরাসি প্রধানমন্ত্রী রবার্ট শুম্যান।
প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থায় যারা নিজের প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করতে পারে না তারা নিজেদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে। যে জাতি তার অতীত বিস্মৃত, ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা গ্রহণ করে না তারা অবধারিতভাবেই নির্মম পরিণতির শিকার হবে। মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও অ্যাকাডেমিশিয়ান মাইকেল হাডসন গত সপ্তায় জার্মানির তুবিনজেন ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে সেখানে যে বক্তৃতা দিয়েছেন তার শিরোনাম দিয়েছেন, ‘রিভল্ট অব দ্য ডেবটর্স : ফ্রম সক্রেটিস টু ইবনে খালদুন’। এই নিবন্ধে মানব সভ্যতায় বিগত ৫ হাজার বছরের ইতিহাসে সুদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, দাসত্ব ও ঋণগ্রস্ত মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা অঙ্কন করেছেন। নিউ ইয়র্কে ওয়াল স্ট্রিট বিরোধী আন্দোলনকারী যারা নিজেদেরকে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের প্রতিনিধি বলে দাবি করেছে, তাদেরকে এ বিপ্লবের অন্যতম শরিক হিসেবে বিবেচনা করেছেন হাডসন। ইতিহাস পর্যালোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন, খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে রোমান সা¤্রাজ্যেও অনুরূপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যখন রোমান শাসক ডাইওক্লেশিয়ান ও কনস্টানটিনের সময় মার্কেট ইকোনমি গড়ে উঠেছিল এবং রাষ্ট্রের সম্পদ সা¤্রাজ্যের সামরিক-বেসামরিক আমলা ও সামন্ত প্রভুদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়েছিল। মার্সেনারি বাহিনীর খরচ জোগাতে গিয়ে জনগণের ওপর বাড়তি ট্যাক্স বসিয়ে রাজস্ব সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সে সময় রোমে দাসপ্রথা প্রবলভাবে বিদ্যমান থাকলেও সেখানে কোনো দাস বিদ্রোহ দেখা না গেলেও জীবনযাপনের দায়ে ঋণভারে ন্যুব্জ সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছিল।
সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতায় অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী তৎপরতা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে গৃহযুদ্ধ, বহুজাতিক সামরিক আগ্রাসন, ডি-স্ট্যাবিলাইজেশন ও ভলকানাইজেশন তৎপরতার নেপথ্যে একই সাথে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক লালসা এবং ইসলামের প্রতি একটি ঐতিহাসিক বিদ্বেষ সমান্তরালভাবে সক্রিয় রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো সামরিক জোট গড়ে ওঠার নেপথ্যে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক বাস্তবতা যাই থাক, সেক্যুলারিজমের ছদ্মাবরণে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি সাত দশক ধরে বিশ্বের মুসলমানদের দাবিয়ে রাখতে এসব প্লাটফর্ম ব্যবহার করছে। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ায় রিজিম চেঞ্জের পর সিরিয়া এবং সর্বশেষে ইরানের রিজিম চেঞ্জের পরিকল্পনা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যে সন্ত্রাসবিরোধী সামরিক আগ্রাসন শুরু হয়েছিল তাকে শেষ পর্যন্ত আরেকটি মহাযুদ্ধে রূপান্তরিত করতে ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিওকন রাজনীতিকরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন অর্থনীতিবিদ, কলামিস্ট ও সাবেক সিভিল আমলা পল ক্রেইগ রবার্টস এক বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন ব্রেক্সিট বা গণভোটে বৃটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বর্তমান আশঙ্কা কমে গেছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ব্রেক্সিট সফল হলে অর্থাৎ সত্যিকার অর্থেই বৃটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলে আরো কয়েকটি দেশ ইইউ থেকে বেরিয়ে আসলে বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব অনেকটা কমে যাবে। এরই ধারাবাহিকতায় ন্যাটো সামরিক জোটেও ভাঙন ধরতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী অর্থনীতি শুরু থেকে অদ্যাবধি শোষণ ও যুদ্ধবাদী নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর একটি জায়নবাদী নীলনকশার অংশ হিসেবে অব্যাহত প্রোপাগান্ডা এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থার কভার্ট অপারেশনের মধ্য দিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের প্রধান আদর্শিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। একই সময়ে রাশিয়া, চীন এবং ইরান অর্থনৈতিক, সামরিক প্রযুক্তিগত ও রাজনৈতিকভাবে অভাবনীয় শক্তি অর্জনে সক্ষম হওয়ায় পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী একাধিপত্য ধরে রাখতে আরো একটি মহাযুদ্ধের পরিকল্পনা এখনো সক্রিয় আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মত দিয়েছেন। পল ক্রেইগ রবার্টস তাদেরই একজন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো সামরিক জোট এবং ফিলিস্তিনি আরবদের ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের সৃষ্টি প্রায় একই সময়ের ঘটনা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ম্যাকানিজমের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ইহুদি জায়নবাদী চক্রের কুশীলবরা অস্ত্র ও অর্থের জোরে ইসরাইল গঠনের পর থেকেই এই অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখতে ক্রমাগত শক্তি প্রদর্শন, সামরিক আগ্রাসনের পথ বেছে নিয়েছে। মুক্ত বাজার অর্থনীতির কথা বলা হলেও নিজেদের গোপন এজেন্ডা অনুসারে বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের পথ নিস্কণ্টক রাখাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একটি কর্তৃত্ববাদী সুপ্রান্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল মূল লক্ষ্য।
সুপ্রান্যাশনাল মানে বহুজাতিক বা আন্তর্জাতিক নয়, এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে আধিজাতিক বা আধিরাষ্ট্রিক অথরিটি, জাতি বা রাষ্ট্রসমূহের ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। রবার্ট শুম্যান রোমান সা¤্রাজ্যের গৌরব পুনরুদ্ধারে পূর্বপুরুষদের যে স্বপ্নের কথা বলেছেন তার নেপথ্যে সম্ভবত ইসলামের খিলাফতের অনুরূপ বা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বদলে একটি আধিজাতিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা ছিল। খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে পোপ দ্বিতীয় আরবান মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন তার মূল লক্ষ্য ছিল জেরুজালেমকে মুসলমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া। খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা প্রায় ২০০ বছরব্যাপী যুদ্ধ করেও মুসলমান শাসনের ভিত্তি টলাতে পারেনি। বিংশ শতকে এসে দুটি মহাযুদ্ধ এবং ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ক্রুসেডারদের সেই লক্ষ্যই অর্জিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে টু স্টেট সলিউশন থিওরির মাধ্যমে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার দায় মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড’ বা অন্তহীন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। পেন্টাগন, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ন্যাটো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মোসাদ, আইডিএফ এবং তাদের বশংবদ রাজশক্তি এই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সত্তর বছর ধরে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো মাঝে মাঝে শান্তি আলোচনার ভান করে থাকে। সম্প্রতি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ইসরাইল তার দেশকে একটি কারাগারে পরিণত করেছে। তিনি আরো অভিযোগ করেছেন ইহুদি ধর্মযাজকরা ফিলিস্তিনের জন্য সরবরাহ করা পানিতে বিষ মিশিয়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স নামের একটি ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের প্রতি পশ্চিমতীরের রাব্বি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান শোলম মিমাদ নামের এক রাব্বি পশ্চিমতীরের মুসলমান জনপদের পানির উৎসগুলোতে বিষ মিশিয়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে মুসলমানরা বিতাড়িত হলে সহজেই সেখানে ইহুদি বসতি সম্প্রসারিত করা যায়। তবে মাহমুদ আব্বাসের এই অভিযোগে ইউরোপ-আমেরিকার নেতাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ইসরাইলি সেনাবাহিনী কর্তৃক ফিলিস্তিনের শত শত বেসামরিক মানুষ বিমান হামলা ও টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগও তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। গাজা উপত্যকায় দশকব্যাপী অবরোধ এবং সর্বাত্মক যুদ্ধে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি হত্যার ঘটনার পরও ফিলিস্তিনিরা ন্যায়বিচার পায়নি। গত সপ্তায় ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বক্তৃতায় মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান ঘটলে ফিলিস্তিনিদের রেসিসটেন্স বা প্রতিরোধ যুদ্ধও বন্ধ হয়ে যাবে। পশ্চিমাসম্প্রদায়ের অন্যতম প্রভাবশালী কমিউনিটি হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার ও ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ বা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কখনো তার শক্তি সামর্থ্য ব্যবহারে আগ্রহী ছিল না। রোমান চার্চের স্থলাভিষিক্ত এই ইউনিয়নে দৃশ্যমান নীতিগত পরিবর্তন ছাড়া তাদের দ্বারা বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো সম্ভাবনা নেই।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন