পিঁয়াজ একটি মসলাজাতীয় উদ্ভিদ। রান্নায় পিঁয়াজ ব্যবহার না হলে খাবার সুস্বাদু হয় না। বাঙালি সমাজে রান্নায় পিঁয়াজ থাকা আবশ্যিক একটি বিষয়। রান্নার সময় এটি হাতের কাছে না থাকলে গৃহিণীদের অভিযোগের শেষ থাকে না। তাই ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার ঘরে পিঁয়াজ থাকা চাই। হালে পুঁজি করে রাজনীতি শুরু হয়েছে। জমে উঠেছে পিঁয়াজ-রাজনীতি। পিঁয়াজের আকাশছোঁয়া দাম নিয়ে মানুষ যেমনি বিরক্ত, তেমনি উদ্বিগ্নও। এ পণ্যটি নিয়ে এ ধরণের ফটকাবাজি অতীতে হয়েছে কিনা জানা নেই। যেখানে গত ঈদেও এর প্রতি কেজির দাম ছিল মাত্র ১৫/২০ টাকা। এখন এটি সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এরই মধ্যে দাম ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল। ভুক্তভোগী মানুষ ভেবেছিল, আস্তে আস্তে এটি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসবে। আগের স্থানেই সমহিমায় ফিরে আসবে এই মহামূল্যবান দ্রব্যটি। কিন্তু না, মানুষ যা প্রত্যাশা করে অনেক সময়ই তার প্রতিফলন ঘটে না। মানুষ যা ভাবে সাধারণত তার উল্টোটাই হয়। পিঁয়াজের দাম নতুন করে বেড়ে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় উঠেছে।
পিঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কারণ খুঁজতে গিয়ে মানুষ জানলো, আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারত পিঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। সে দেশেও পিঁয়াজের দারুণ আক্রা। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে গেছে কৃষকের পিঁয়াজ। সেখানেও হু হু করে দাম বাড়ছে পিঁয়াজের। যার কারণে আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়ছে দারুণভাবে। আর এই সুযোগে বাংলাদেশের পিঁয়াজ ব্যবসায়ীরা মানুষের গলা কাটতে শুরু করেছে। পিঁয়াজের আড়ত, পাইকারী বাজার ও খুচরা দোকানগুলোতে প্রচুর পিঁয়াজ থাকা সত্তে¡ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে অতিরিক্ত দাম আদায় করছে ভোক্তাদের কাছ থেকে। সারাদেশে এই নিয়ে যখন তুমুল হৈচৈ শুরু হলো, তখন সরকারের টনক নড়ে। সরকার বিদেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানি করে বাজার স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও পিঁয়াজ সিন্ডিকেট বাজার দখলে নিয়ে যায়। তারা যোগসাজস করে প্রতিদিনই দাম বাড়াতে থাকে। সকালে এক দামতো, বিকালে আরেক দাম। এমনি করে এই দ্রব্যটির দাম আকাশে গিয়ে ঠেকে, যা মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। বিষয়টি মন্ত্রী মিনিস্টারদের নজরে আসে। তারা রীতিমতো হুংকার দেন, পিঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি সহ্য করা হবে না। মাঝে মাঝে লোকদেখানো লম্পঝম্প শুরু হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। সরকার ম্যাজিস্ট্রেসি পাওযার দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মাঠে নামিয়ে ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমানা করে বটে; কিন্তু যেই কদু সেই লাউ-এর মতোই অবস্থা হয়। দাম কমার বদলে প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাড়তে থাকে। আর এভাবে জনগণের পকেট কেটে হাতিয়ে নেয়া হয় কয়েক হাজার কোটি টাকা।
এদিকে এমপি ও সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ জনগণের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করে বলেছেন, পিঁয়াজ কম খান। আমরা পিঁয়াজ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। কেউ কেউতো আগ বাড়িয়ে বলেছেন, এ জিনিসটি না খেলে কী হয়? তরকারিতে পিঁয়াজ ব্যবহার না করলে তরকারির স্বাদ কমে না। সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীতো (পিঁয়াজ গবেষক) জনগণের উদ্দেশ্যে অমূল্য বাণী দিয়েছেন, তিনি পিঁয়াজ ছাড়া ২৬ রকমের তরকারি রান্না করতে পারেন। আর এই গরম খবরটি ফেসবুক ও ইউটিউবের ভাইরাল হয়ে যায়।
বর্তমানে পিঁয়াজ জিনিসটি এমনই বহু মূল্য, অনেককে বিয়েশাদী ও নানা অনুষ্ঠানে পিঁয়াজ উপহার দিতে দেখা যায়। কিছু কিছু পত্রপত্রিকা পিঁয়াজ নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনও তৈরি করে। অনেক পত্রিকা প্রকাশ করে পিঁয়াজ বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা। ভারতের একটি অঞ্চলে ছেলেমেয়ের বিয়েতে সোনার গহনার পরিবর্তে পিঁয়াজ দিয়ে তৈরি গহনা উপহার দেয়া হয়। আর এটি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়। ফেসবুক ও ইউটিউবতো পিঁয়াজ নিয়ে রসাত্মক সিরিজ তৈরি করেছে, যা দেখতে মজাই পায় মানুষ।
দেখতে দেখতে পবিত্র রমজান মাস সমাসন্ন। এই মাসটিকে কেন্দ্র করে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে বলা হয়, পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখা হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে বলা হয়, নিত্যপণ্য নিয়ে কারসাজি করলে তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। কিন্তু সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বাণী যেনো নিরবে-নিভৃতে কাঁদে। ব্যবসায়ীরা সরকারের কথা শোনে না। বরং তাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনতে হয় সরকারকে। কারণ রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে এবং অতীতেও পাল্লা দিয়ে এটির দাম বেড়েছে। সরকার ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
কিছুদিন আগে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদের উপস্থিতিতে ও বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ানোর জন্য অনুরোধ জানান সাবেক এই মন্ত্রী। তোফায়েল আহমদ যখন বাণিজ্য মন্ত্রী ছিলেন তখনও তিনি ফি-বছর ব্যসায়ীদের নসিহত করতেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় কর্ণপাত করতেন না।
মানুষ পিঁয়াজ নিয়ে যেভাবে হৈচৈ শুরু করেছে, অন্যান্য নিত্যপণ্য নিয়ে তেমনিভাবে সোচ্চার হচ্ছে না। আজকে শুধু পিঁয়াজই নয়, সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এমন কোনো পণ্য নেই যেগুলো ক্রেতাসাধারণের নাগালের মধ্যে আছে। মাছ, মাংস, তরি-তরকারি, চাল, আটা, ময়দা, বিস্কুট, চিনি, গুড়, ডাল, তেল, দুধ, সাবান, ওষুধ থেকে শুরু করে সব জিনিসের দাম ঊর্ধ্বমুখি। এসব জিনিসেরও প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ছে। অবস্থা এমন যে, এগুলো মনিটরিং করা বা দেখভালের কেউ নেই। যে যেভাবে পারছে ফ্রি-স্টাইলে দাম বৃদ্ধি করে চলছে।
সমাজে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে রয়েছে টাকার খনি। তাছাড়া যারা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাদের প্রচুর আয়-উপার্জন, অবৈধ রোজগার, নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও তাদের উপর খুব একটা প্রভাব পড়ে না। কিন্তু যারা খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের সীমিত আয় এবং অল্প আয়ে যারা সংসারের ঘানি টানে তাদের অবস্থা খুবই বেহাল। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে তাদের উপর নেতিবাচক চাপ পড়ে। তাদের আকাশছোঁয়া দামে পিঁয়াজ কেনাতো দূরের কথা, অন্যসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেও মাথার ঘাম ঝরে। এসব অসহায়-দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোর কথা চিন্তা করা দরকার। কারণ তারা প্রতিবাদ করতে জানে না, প্রতিবাদ করে না। এ ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছে দেশের ভুক্তভোগী মানুষ।
লেখক : সাংবাদিক, ছড়াকার, নাট্যকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন