বেড়েই চলেছে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা। পাথরের আঘাতে নিহত ও আহত হচ্ছেন অনেকে। পাথর নিক্ষেপ করা দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় দিন দিন বেড়েছে ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ।
অন্য যেকোনো গণপরিবহনের তুলনায় ট্রেনকে নিরাপদ ভেবে অনেকেই ট্রেনে যাতায়াত করে। কিন্তু ট্রেনে দুর্বৃত্তদের পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় যাত্রীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে। রেল পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনামূলক লিফলেট বিতরণ, মাইকে প্রচার করাসহ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কাজ করলেও সহসাই রোধ করা যাচ্ছে না ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা। ফলে রেলপথ অনিরাপদই থেকে যাচ্ছে। বিগতদিনে চলন্ত ট্রেনে পাথরের আঘাতে রেলকর্মীদেরও মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
রেল সূত্রে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২ হাজার ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ফলে দরজা জানালা ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে প্রীতি দাশ নামের এক প্রকৌশলী নিহত হবার পর এ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। গত বছর নিহত হয় রেলেরই এক পরিদর্শক (টিটি)। তাছাড়া গত বছরের মে মাসে জিসান নামে একটি শিশুর আহত হবার ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনায় আসে রেলে পাথর নিক্ষেপের বিষয়টি। তাছাড়াও গত বছর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী উত্তরাঞ্চলে ভ্রমণের সময় তাকে বহনকারী ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন তার বিবৃতিতে বলেছিলেন, এই ধরনের জঘন্য অপরাধ যারা করবে তাদের চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিতে হবে। রেলমন্ত্রীর এই রকম বিবৃতির পরও থেমে যায়নি পাথর নিক্ষেপের ঘটনা। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর ট্রেন সুবর্ণ এক্সপ্রেস কুমিল্লার গোমতী ব্রিজ এলাকায় আসলে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনের জানালার গøাস ভেঙে ৪ যাত্রী আহত হয়।
এ ঘটনায় লাকসাম রেলওয়ে জংশন থানার ওসি মো.নাজিম উদ্দিন দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এ ঘটনার খবর পেয়ে পুরো এলাকায় রেলওয়ে পুলিশের টহল বৃদ্ধি করেছি। এছাড়া এই ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
এর আগে ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে ছোড়া ঢিল থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যায় ১৩ মাস বয়সী এক শিশু। গত ১৮ ডিসেম্বর রাত সোয়া ৭টায় ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে এলাকায় ঢাকাগামী আন্তঃনগর তিস্তা এক্সপেসের চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে শিশুসহ দুই জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
গত ২৪ ডিসেম্বর জয়পুরহাটের আক্কেলপুরের ঢাকাগামী পঞ্চগড় এক্সপ্রেসকে লক্ষ্য করে ছোড়া পাথরে জহুরুল ইসলাম (৩২) নামে এক যাত্রী আহত হয়েছেন। একই এলাকায় পাথরের আঘাতে খুলনাগামী রূপসা এক্সপ্রেসের ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙে আক্কেলপুরের জাফরপুরে এসব ঘটনা ঘটে।
সান্তাহার জিআরপি থানার উপপরিদর্শক নজরুল ইসলাম জানান, দুটি আন্তঃনগর ট্রেনে পাথর ছোড়ার খবর শুনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। ১৯ নভেম্বর চলন্ত ট্রেনে ছোড়া পাথরের আঘাতে মালবাহী ট্রেনের গার্ডসহ ৬ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।
ভৈরবের স্টেশন মাস্টার মো. কামরুজ্জামান বলেন, শুধু পাথর ছুড়ে মারার কারণে যাত্রীদের যাত্রা অনিরাপদ হয়ে পড়ার পাশাপাশি ট্রেনের কামরার দরজা-জানালার কাচ ভেঙে যাচ্ছে। ট্রেনের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। বিশেষ করে এলাকার মানুষের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করছেন।
২০১৭ সালে সারা দেশে দেড় শতাধিক পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে রেলওয়ের ১৪জন কর্মচারী-কর্মকর্তা রয়েছেন।
সারা দেশে দুই হাজার ৯০০ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ২০ জেলার ওপর দিয়ে চলার সময় ট্রেন লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি ও পশ্চিমাঞ্চলে ১৫টি জেলায়। আর গুরুত্বপূর্ণ স্পট হিসেবে ৬৫টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। পাথর ছোড়ার বেশি ঘটনা ঘটছে গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে গঙ্গাসাগর, কুমিল্লার ময়নামতি ও চট্টগ্রামের পাহাড়তলি থেকে সীতাকুন্ড অংশে। এ ছাড়া নরসিংদী, পুবাইল, গফরগাঁও, গৌরিপুর, মোহনগঞ্জ, সরিষাবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, তেজগাঁও, কাওরানবাজার, ফতুল্লা, লালমনিরহাট, পীরগঞ্জ, গাইবান্ধা, বুনারপাতা, সোনাতলা, আজিমনগর, খুলনা, পার্বতীপুর, জামতৈল কোট চাঁদপুর, নোয়াপাড়া, দৌলতপুর, রংপুর, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা, ষোলশহর, ফৌজদারহাট, সীতাকুন্ড, চৌমুহনী, কুমিল্লার শশীদল, ইমামবাড়ি, কসবা, পাঘাচং, ভাতশালা, শায়েস্তাগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কাউনিয়া, বামনডাঙ্গা এলাকায়।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে রেলপুলিশের মাঠে কাজ করা এক কর্মকর্তা বলেন, ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা সাধারণত নিরিবিলি এলাকাগুলোতে হয়ে থাকে। দেখা গেছে রেল লাইনের আশপাশে যে সব বাড়ি ঘর আছে সেখান থেকে কেউ একজন রেল লাইনের পাথর নিয়ে নিক্ষেপ করে দিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ের যুগ্ম-মহাপরিচালক (অপারেশন) মোছা. রশিদা সুলতানা গণি বলেন, পাথর নিক্ষেপ দেখার দায়িত্ব আরএনবি, রেল নিরাপত্তা বাহিনী এবং পুলিশের। লিফলেট দিয়ে এবং পাথর নিক্ষেপের স্পট চিহ্নিত করে প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করে ওই সব এলাকায় দেখানো হচ্ছে এবং মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণা করার কারণে আগে থেকে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা কিছুটা কমেছে।
ট্রেন যাত্রী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, প্রায় প্রতি সপ্তাহে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া হয়। আরামদায়ক ও নিরাপদ হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই যাওয়া আসা করা হয় ট্রেনেই। তবে বিভিন্ন সময় দেখি ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় অনেক যাত্রী আহত-নিহত হন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন