বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর হেফাজত, হেদায়েত, সুখ, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনায় আখেরি মোনাজাতে লাখো লাখো মুসল্লির অশ্রæসিক্ত নয়নে আমিন আমিন ধ্বনিতে শেষ হলো ‘আলমি শুরা’ (বিশ্ব পরামর্শ সভা) আয়োজিত প্রথম পর্বের ৩ দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা। গতকাল বেলা ১১টা ১০ মিনিটে শুরু হয়ে ১১টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত ৩৫ মিনিট ব্যাপী আখেরি মোনাজাতে প্রথমে আরবি ও পরে বাংলা ভাষায় মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বি বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ যোবায়ের।
গণভবনে বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে শরিক হন। এছাড়া ইজতেমা ময়দানের মূল মঞ্চের কাছে বসে মোনাজাতে অংশগ্রহণ করেন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাজীপুর সিটি মেয়র মো. জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর জেলা প্রশাসক এস. এম. তরিকুল ইসলাম, ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, সংসদ সদস্য, সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। ইজতেমার ইতিহাসে এবারই প্রথম স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি মুসল্লির আগমন ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইজতেমা ময়দান ছাড়াও প্রায় তিন কিলোমিটার পর্যন্ত মুসল্লিদের মোনাজাতের সুবিধার্থে মাইকের ব্যবস্থা করেছে তথ্য অধিদফতর।
আখেরি মোনাজাতে লাখো লাখো ধর্মপ্রাণ মুসল্লি নিজ নিজ গুনা মাফ, সারা দুনিয়ার কল্যাণ কামনা, আল্লাহর নৈকট্য লাভ, দুনিয়াতে হানাহানি, মারামারিমুক্ত শান্তিময় সমাজ কামনা এবং ইহ ও পরলৌকিক সুখ-শান্তি কামনা করে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে আমিন আমিন ধ্বনিতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বাংলায় মোনাজাত পরিচালনা করায় বাংলা ভাষাভাষি মুসল্লিরা মোনাজাতের মর্ম উপলব্ধি করতে পারেন এবং নিজ নিজ গুনাহর কথা স্মরণ করে মহান আল্লাহর দরবারে কান্নায় বুক ভাসান। এ সময় দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্য দিয়ে রাব্বুল আলামিনের দরবারে ফরিয়াদ জানান।
গতকাল বাদ ফজর পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক আম বয়ান এবং ভারতের মাওলানা আহমদ ইব্রাহিম দেওলা হেদায়েতি বয়ান করেন। বয়ানে তারা নবী করিম (সা.) এর তরিকা মনে করিয়ে দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জানমাল কোরবানি দেয়া, মুসলমানদের ইমানী জিন্দেগি, আল্লাহ ও তার হাবিব রাসূল (সা.) এর সুন্নতের পথে চলা এবং দাওয়াতি কাজের কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করেন। হেদায়েতি বয়ান শেষে সকাল ১১টা ১০ মিনিটে বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ যোবায়ের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন।
আখেরি মোনাজাত চলাকালে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। নীরব নিস্তব্ধতা নেমে আসে গোটা এলাকায়। মাঝে মধ্যে এই নীরবতা ভেঙে ‘আমিন আল্লাহুম্মা আমিন, ছুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত ও প্রকম্পিত হয়ে উঠে গোটা ইজতেমা ময়দান।
হামদ ও দরুদ শরিফের পর হাফেজ মাওলানা যোবায়ের পবিত্র কালামে পাকের দোয়ার আয়াতগুলো দিয়ে মোনাজাত শুরু করেন। দীর্ঘ প্রায় ৩৫ মিনিটের মোনাজাতের প্রথম প্রায় ১৫ মিনিট তিনি কালামে পাকের বেশ কিছু দোয়ার আয়াত উচ্চারণ করেন। পাশাপাশি আরবিতে পরওয়ারদিগারের কাছে ফরিয়াদ জানান। এরপর মোনাজাতের বাকি অংশে তিনি বাংলায় মহান আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে আকুতি জানান। আরবিতে মোনাজাত চলাকালে তিনি সূরা বাকারার শেষাংশের দোয়ার আয়াতের একাংশ ‘ফান্সুরনা আলাল কাফিরিন অর্থাৎ কাফেরদের মোকাবেলায় তুমি আমাদের সাহায্য করো’ একাধিকবার উচ্চারণ করেন। এছাড়া তিনি বলেন, হে প্রভু! আপনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাশীল। আমাদের তওবা কবুল করুন। মুসলমানদের হেফাজত করুন।
বাংলায় মোনাজাতকালে তিনি মহান আলাহ রাব্বুল আ’লামিনের দরবারে দুনিয়া থেকে শিরক ও বিদআতের খতম কামনা করেন। বাতিলের পরাজয় ও হকের বিজয় চেয়ে বার বার আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানান। দ্বীনের হিজরত ও মেহনতকে কবুল করার আকুতি জানান। বনি আদমের হেদায়েত, উম্মতে মুহাম্মদির জান-মাল হেফাজত, সকল বিমারি থেকে আরোগ্য, সিরাতুল মুস্তাকিম ও ইবাদতে ইখলাস নসিব কামনা করেন। ইহ ও পরলৌকিক মুক্তি, দ্বীনের দাওয়াত ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা এবং তাবলীগের মেহনত ও ইজতেমাকে কবুল করার আকুতি জানিয়ে আখেরি মোনাজাত শেষ করেন।
আখেরি মোনাজাতে বাঁধভাঙা জোয়ার : প্রথম দফায় তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিনে গতকাল ভোর রাত থেকেই আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে অগণিত ধর্মপ্রাণ মুসলমান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ইজতেমা ময়দানে বাঁধভাঙা জোয়ারের ন্যায় আসতে থাকেন। ট্রেন, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, জিপ, কার এবং নৌযানসহ বিভিন্ন যানবাহনে শীত ও কুয়াশা উপেক্ষা করে ইজতেমা ময়দানে পৌঁছান তারা। মোনাজাত শুরুর আগেই সকাল ১০টার মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তুরাগ তীরের পুরো ইজতেমাস্থল ও চারপাশের সড়ক-মহাসড়ক অলিগলিসহ বিস্তীর্ণ এলাকা।
গত শনিবার মধ্য রাত থেকে আখেরি মোনাজাতের পূর্ব পর্যন্ত রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় যানবাহনের অভাবে মুসল্লিরা সকাল থেকেই দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে ইজতেমা অভিমুখে স্রোতের মতো আসতে থাকেন। সকাল থেকে যতই বেলা গড়াচ্ছিল টঙ্গী অভিমুখে ততই যেন টুপি পাঞ্জাবি পরিহিত মুসল্লিদের ঢেউ বাড়তে থকে। বিশ্ব ইজতেমা ময়দান ও তার আশপাশের এলাকায় যতদূর চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে তুরাগের তীরকে কেন্দ্র করে কয়েক বর্গকিলোমিটার জুড়ে যেন ধর্মপ্রাণ মানুষের এক বিশাল মানব বলয় সৃষ্টি হয়।
প্রতিবারের মত এবারও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লি ইজতেমা ময়দানের আশপাশে, বিভিন্ন মিল-কারখানা, বাসা-বাড়ি ও দালানের ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়। ইজতেমায় মহিলাদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা না থাকায় যে যেখানে পেরেছেন সেখানে বসেই মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
যানবাহন সঙ্কটে ভোগান্তি : বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত শেষে ময়দান থেকে লাখ লাখ মুসল্লি একসাথে নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার পথে যানবাহন সঙ্কটে পড়ে চরম দুর্ভোগের শিকার হন। মোনাজাত শেষে লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে স্রোতের মতো একসাথে ফিরতে শুরু করলে ময়দানের চারদিকে ৬ থেকে ৭ কিলোমিটারব্যাপী বিস্তীর্ণ এলাকায় মানবজটের সৃষ্টি হয়।
এদিকে ভোর থেকে টঙ্গী থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার ও টঙ্গী থেকে পূবাইল পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার, টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার, টঙ্গী থেকে আশুলিয়া সড়কের ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ইজতেমামুখী সকল যানবাহন চলাচল মুসল্লিদের মোনাজাত শেষে বাড়ি ফেরার জন্য বন্ধ রাখা হয়। এতে মুসল্লিরা পায়ে হেঁটেই ওই সকল দূরত্বের পথ পাড়ি দিয়ে মোনাজাত শেষে যে যার গন্তব্যে রওয়ানা দেন। বিভিন্ন জেলা হতে বাস রিজার্ভ করে আসা জামাতবন্দি মুসল্লিরা মোনাজাত শেষে নির্ধারিত গাড়ি পার্কিং এলাকায় গিয়ে যার যার গাড়িতে গিয়ে অবস্থান নেন। এরপর একসাথে সকল গাড়ি ছাড়ায় রাজধানী ও আশপাশের প্রতিটি সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যে সকল মুসল্লি বাস রিজার্ভ করতে পারেননি তারা ফেরার পথে নিরুপায় হয়ে স্থানীয় ট্রাক ট্রার্মিনাল থেকে ট্রাক ভাড়া নিয়ে গাদাগাদি করে গন্তব্যে ফিরতে দেখা যায়। ইজতেমায় যাতায়াতের সুবিধার্থে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মুসল্লিদের জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করলেও আখেরি মোনাজাত শেষে একসাথে লাখ লাখ মুসল্লির বাড়ি ফেরার জন্য তা ছিল খুবই অপর্যাপ্ত। ফলে মুসল্লিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাদ ও জানালায় ঝুলে গন্তব্যে রওয়ানা দেন। এ রিপোর্ট লেখার সময়ও হাজার হাজার মুসল্লিকে ট্রেনের অভাবে স্টেশনে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। এদিকে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা শেষে দেশ-বিদেশে যাওয়ার জন্য তাশকিলকৃত চিল্লাধারী মুসল্লীগণকে তাশকীল কামরায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারা সেখান থেকে আগামী এক দুই দিনের মধ্যেই জামাতবন্দি হয়ে দাওয়াতি কাজে দেশ বিদেশের উদ্দেশে রওয়ানা দিবেন বলে তাশকিল কক্ষের জিম্মাদার জানান।
৬১ দেশের অংশগ্রহণ : ইজতেমার মুরব্বিদের সূত্রে জানা গেছে, প্রথম পর্বের ইজতেমায় ভারত, পাকিস্তান, সউদী আরব, সংযুক্ত আরব-আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চাঁদ, ইথিওপিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান, খিরগিজস্থান, মালয়েশিয়া, মরক্কো, নেপাল, কেনিয়া, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, জর্দান ও দুবাইসহ বিশ্বের ৬১টি দেশের প্রায় ১ হাজার ৯শ’ বিদেশি মুসল্লি অংশ নিয়েছেন।
এছাড়াও ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা যায়, সাধারণ জামাতের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ও বাকপ্রতিবন্ধীরাও এই বিশ্ব ইজতেমার জামাতে অংশ নিয়েছেন। ইজতেমা ময়দান থেকে কেউ এক মাস, কেউ তিন মাস, কেউ এক বছর, কেউ আজীবন চিল্লা দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন অনেক জামাতের সাথী ভাইয়েরা।
১২ মুসল্লির মৃত্যু : গত চারদিনে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আসা ১২ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে প্রথম দুইদিনে ৯ জন এবং শনিবার বিকেল ও রাতে আরও তিন মুসল্লি মারা গেছেন। এ নিয়ে প্রথম পর্বের ইজতেমায় গত চারদিনে ১২ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমার পুলিশ কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, শনিবার বিকেল সোয়া ৫টায় কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থানার গুচিহাটা গ্রামের নুর ইসলাম (৫৫), রাত সাড়ে ১০টায় কক্সবাজারের টেকনাফ থানার সাব্রাম এলাকার আলী আহমদ (৬০) ও রাত পৌনে ১টায় জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানার আব্দুল মোমিন (৫৬) মারা যান।
দ্বিতীয় পর্ব শুরু শুক্রবার : ভারতের মাওলানা সা’দ অনুসারীদের ব্যবস্থাপনায় এবারের দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা তুরাগ তীরে একই প্যান্ডেলে আগামী শুক্রবার শুরু হয়ে রোববার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে। প্রথম পর্বের মুসল্লিরা মাঠ ত্যাগের পর দ্বিতীয় পর্বের মুসল্লিরা আসতে শুরু করবেন।
আগামী বছর শুরু ৮ ও ১৫ জানুয়ারি : আগামী বছর বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব ৮ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১০ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে। দ্বিতীয় পর্ব ১৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে শেষ হবে ১৭ জানুয়ারি। গতকাল সকালে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে বিশ্ব তাবলীগের আলমি শুরার শীর্ষ মুরব্বিদের মাশওয়ারায় এ সিদ্ধান্ত হয়। মাশওয়ারায় আলমি শুরার সদস্য ছাড়াও বাংলাদেশের শীর্ষ উলামায়ে কেরাম ও বিভিন্ন দেশের মারকাজের দায়িত্বশীলরা উপস্থিত ছিলেন বলে ইজতেমার দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন