কামরুল হাসান দর্পণ
‘আমরা কি স্বাধীন হয়েছি কেবল ভারতের ঋণ শোধ করতে? ভারতের আর কত চাহিদা আমাদের পূরণ করতে হবে। স্বাধীনতার সময় পাশে দাঁড়িয়ে যে সহযোগিতা করেছে, তার বিনিময়ে যদি এত ঋণ পরিশোধ করতে হবে জানতাম তাহলে এ সহায়তা নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা কয়েকবার ভাবনা-চিন্তা করতাম।’ এমন ধরনের কথাবার্তা ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ভারতকে টনপ্রতি মাত্র ১৯২ টাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট দেয়ার পর এ ধরনের কথাবার্তা বেশি বলা হচ্ছে। শুধু ট্রানজিট নয়, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে খবরদারিমূলক আচরণ এবং তার পরামর্শ মতো চলতে বাধ্য করার প্রবণতা সচেতন মানুষের মনে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং তাদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তাদের ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে ইদানীং ভারতের সাথে বাংলাদেশের লেনদেনের হিসাব বা বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে কী পেল, এ বিষয়টি খুব বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতন মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া অনেকটা স্যাটায়ারভাবে ব্যক্ত করেছে। সম্প্রতি ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির ছেলে অভিজিৎ মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে আসেন। সফরকালে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ যে কোনো সমস্যা যেন দ্রুত ভারতকে জানায়। এর জবাবে ফেসবুকে এক সচেতন ব্যক্তি লেখেন, ‘জানানোর কি আছে দাদা! আমাদের আগেতো আপনারাই জানেন আমাদের সমস্যা। আমরাতো সব খুলে বসে আছি, আপনাদের জেনে যাওয়ার জন্য। আপনাদের আর কিছু লাগবে কিনা বলেন, আমরা গিয়ে দিয়ে আসবো, আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। ঋণ শোধ করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি। দাদা, আরেকটা মুক্তিযুদ্ধ করার শক্তি নাই আমাদের।’ আরেকটি খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লেখেছেন, ‘বাংলাদেশের জন্য রেডিও সম্প্রচার করবে আকাশবাণী মৈত্রী। এ খবরের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তিনি লিখেন, আমাদেরকে তো ঋণে ঋণে জর্জরিত করে ফেলেছেন দাদা ভাইরা। এই ঋণ শোধ করিতে করিতে আমরা শুকাইয়া যাইতেছি’। বিএসএফের গুলিতে সম্প্রতি দুই বাংলাদেশী নিহত হয়। বিএসএফ, বিজিবির কাছে লাশ দুটি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে। এ সময় ছবিও তোলা হয়। এ নিয়ে এক ব্যক্তি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘হাসি মুখে লাশ বরণ করে নিচ্ছে আমাদের বিজিবি। মনে হয়, বিশাল একটা কার্য স¤পাদন করেছে। লাশগুলো যে বিএসএফ ফেরত দিলো তাতেই যেন মহাখুশি ওনারা। ভাবটি এমন যেন যত পারেন মারেন, শুধু লাশগুলো ফেরত দিয়েন। কাদের নিয়ে আমরা গর্ব করবো! আমাদের গর্ব করার জায়গাগুলো আস্তে আস্তে মেরুদ-হীন হয়ে যাচ্ছে।’ ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণ এবং তার প্রতি আমাদের সরকারের অতি বিনয়াবনত যে আচরণ, তাতে দেশের সচেতন মহলে এখন এ ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নিখাদ দেশপ্রেমিকদের অনেকে কইতেও পারছেন না, সইতেও পারছেন না। কইতে গেলেই বিনয়ে নুয়ে পড়া সরকারের রোষাণলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এটা সবাই জানেন ভারতের সমর্থনে বলীয়ান সরকারের ক্ষমতার বিরুদ্ধে কিছু বললে তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। এমনকি সাথে সাথে অ্যাকশনও হতে পারে। এই আতঙ্কে অসংখ্য মানুষ বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে চায় না। তবে ইদানীং অনেকেই একটু-আধটু সাহস সঞ্চয় করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে সেইসব ক্ষুব্ধ মানুষের কথাই যেন তুলে ধরছে। তাদের সাথে অসংখ্য মানুষকে সহমত পোষণ করতেও দেখা যায়। বলা যায়, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে প্রভুত্বমূলক আচরণ, তা সরকার কৃতজ্ঞচিত্তে মেনে নিলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মেনে নিতে পারছে না। সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে অনেকে নিজের হাত কামড়ে কোনো রকমে সহ্য করে যাচ্ছে। এসব মানুষের মনের এই তীব্র যন্ত্রণা ধারণ ও প্রকাশ করার মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি যেন বাংলাদেশে নেই। ভারত যে তার স্বার্থে বাংলাদেশকে যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করছে এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাথে কোনো দেশের এ ধরনের আচরণ মেনে নেয়া যায় কিনাÑ এ বিষয়টি যথাযথভাবে উপলব্ধি করার কোনো শক্তি যেন আমাদের দেশে নেই।
দুই.
ভারত আমাদের যে কত বড় ক্ষতি করেছে এবং করে চলেছে, বিষয়টি বুঝতে খুব বেশি সময় লাগবে না। নিকট ভবিষ্যতে মনে হতে পারে, এ আমরা কী করেছি! নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই করে ফেলেছি বা করতে দিয়েছি। তখন হয়তো সময় থাকবে না। আমাদের সরকার আন্তরিকতা ও বন্ধুত্বের কথা বলতে বলতে ভারতের আধিপত্য, আগ্রাসন ও খবরদারির যে সুযোগ করে দিয়েছে, তা এখন পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও অচিরেই দেশের মানুষ দেখবে। তবে যাদের একটু বোধবুদ্ধি রয়েছে, তারা এখনই বুঝতে পারছেন, আমরা আর আমাদের মধ্যে নেই। আমাদের আত্মা ভারত গ্রাস করে ফেলছে। আমরা দেখেছি, সরকার ভারতের চাহিদার সবকিছু অবলীলায় বিলিয়ে দিয়েছে। আর সরকার অতিভক্তি দেখিয়ে ও বিনয়াবনত হয়ে আমাদের ন্যায্য দাবীর কোনো কিছুই আদায় করতে পারেনি। ভারত যা চেয়েছে এবং যেভাবে চেয়েছে, তার সবই দিয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে সরকার ভারতের কাছ থেকে পেয়েছে প্রশংসাসূচক কিছু বাণী। এ সরকার সঠিক এবং তারা সঠিকভাবে কাজ করছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে ভাল সরকার আর কোনো দেশে নেই। সরকারও গদগদ হয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে রয়েছে। সরল এ কথা বুঝতে পারছে না, জগতে যে দেয় তার চেয়ে উত্তম দ্বিতীয় আর কেউ হতে পারে না। জগতের আরেকটি নিয়ম হচ্ছে, দুর্বল কারো কাছে যদি সবলের কোনো স্বার্থ থাকে, তখন সবল নানাভাবে ছলচাতুরির মাধ্যমে তা আদায় করে নেয়। আদায় করার পর সবল তার স্বরূপে দুর্বলের সামনে দাঁড়ায়। তখন দুর্বলেরও কিছু করার থাকে না। কারণ সবলের যে জিনিসটি তার কাছে ছিল, সবল তার কাছ থেকে ছলেবলে কলাকৌশলে আদায় করে নিয়েছে। সবলকে ঠেকানোর মতো দুর্বলের কাছে আর কিছু থাকে না। দুর্বলের এই মহা ভুলের খেসারত তাকে সারাজীবন দিয়ে যেতে হয়। সবলের ধমকের নিচেই তাকে থাকতে হয়। আত্মমর্যাদা বলে কিছু থাকে না। সবল তাকে নিয়ে যেমন খুশি তেমন খেলায় মেতে উঠে। যা খুশি তা বলে। দুর্বলের স্বাধীনতা বলে কিছু আছে, এটা মনেই করতে চায় না। অর্থাৎ দুর্বলকে অনেকটা খেলার বস্তুতে পরিণত করে। বাংলাদেশের কাছে ভারতের চাওয়ার আর কিছু বাকি না থাকায় সে ঐ সবলের মতোই আচরণ করা শুরু করেছে। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, সচিব ও নেতারা বাংলাদেশ সফরে এসে যেসব কথাবার্তা বলেন তাতে বাংলাদেশকে তারা কীভাবে দেখছে, তা কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাদের বক্তব্যে এমন মনোভাবই প্রকাশিত হয় যেন তাদের কথা মতো আমাদের চলা উচিত। আবার এটাও মনে হতে পারে সরকার কখনো কখনো একটু বেকায়দায় পড়লে তার কষ্ট যেন ভারত সরকারের গায়ে গিয়ে লাগে। দুঃখে সে যেন আহাহা করে উঠে। কাজেই সরকারের পাশে দাঁড়ানোর একমাত্র দায়িত্ব ভারতেরই এবং সে ছাড়া পৃথিবীতে আমাদের সরকারের আর কেউ নেই। ভারতের আচরণ দেখে মনে হবে, তার উদ্বেগ কেবলমাত্র সরকারকে নিয়ে। বাংলাদেশের আলাদা সত্তা ও এর স্বত্বাধিকারী জনগণকে নিয়ে নয়। আমরা যে একটি আত্মমর্যাদাশীল ও স্বাধীন রাষ্ট্র, তার বক্তব্য-বিবৃতি ও আচার-আচরণে এর প্রতিফলন খুব কমই ঘটে। এক ধরনের তুচ্ছ্য-তাচ্ছিল্য এবং ধমকি মনোভাব বরাবরই ফুটে উঠে। আমরা জানি না, ভারত আমাদের সাথে যে আচরণ করে চলেছে, তার দশ ভাগের এক ভাগও অন্য কোনো আত্মমর্যাদাশীল দেশের সাথে করলে তা সহজে ছাড় পেতো কিনা। দুঃখের বিষয়, আমাদের সরকার ভারতের এ মনোভাবকে ‘বন্ধুত্ব’ বলে বরণ করে নিচ্ছে। তবে সরকারের এই ছাড় সব দেশের ক্ষেত্রে সমান নয়, শুধু ভারতের ক্ষেত্রে। ভারতের সব চাহিদা পূরণ করেও আর কী দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করা যায়, তা নিয়ে যেন আমাদের সরকার সর্বদা ব্যতিব্যস্ত। অন্যদিকে পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্য প্রভাবশালী দেশকে গণার মধ্যেই ধরে না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে পাকিস্তান নাক গলানোর মতো যে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছে, তাতে সরকার ন্যূনতম ছাড় দেয়নি। আচ্ছা রকমে যেমন বকেছে তেমনি সম্পর্ক ছিন্ন করার কথাও বলেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে গালাগালি করেছে, তা বিশ্বের কোনো দেশের পক্ষে আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অবশ্য আমাদের নিজস্ব ব্যাপারে যেই নাক গলাতে আসুক না কেন, তার সাথে জামাই আদরের মতো ব্যবহার করা কোনোভাবেই উচিত নয়। আমরা সরকারের এ মর্যাদাশীল ভূমিকা দেখে যেমন পুলক অনুভব করি, তেমনি লজ্জিত হই যখন দেখি ভারতের সামনে গেলেই সরকারের মেরুদ- মোমের মতে গলে যায়, তার অন্যায় আচরণে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারে না। এতে কি বোঝা যায়? সরকার কার জোরে কথা বলে? সরকারের আত্মা কোথায়?
তিন.
ইদানীং ভারতের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে থাকা জনগণ যেন অতি দূর থেকে ভেসে আসা কোনো আশার বাণী ক্ষীণভাবে হলেও শুনতে পাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নেতৃবৃন্দ ভারতের অন্যায় আচরণ ও তার প্রতি সরকারের অতি উদার হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছে। শুরুতে দলের মধ্যম সারি থেকে এ আওয়াজ উঠা শুরু করে। এখন দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া গত কিছুদিন ধরে বেশ জোর গলায়ই ভারতের অন্যায্য আচরণ ও সরকার ভারতের সাথে যেসব গুপ্ত চুক্তি করেছে এবং একতরফা ট্রানজিট দেয়ার বিরোধিতা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। বহুদিন পর জাতীয়তাবাদী আদর্শ নিয়ে গঠিত দলটি যেন চরম হতাশ হয়ে পড়া জাতীয়তাবাদী আদর্শের জনগণের মনে সূক্ষ্ম আলোক রশ্মির জন্ম দিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া যে কথাটি বলেছেন তা হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আছে কিনা এখন তা ভেবে দেখতে হবে। এ কথার মধ্য দিয়ে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক জনগণ ঠিকই বুঝতে পেরেছে। গত ২৪ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা সম্পূর্ণরূপে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী ভারতের ‘অব্যাহত আগ্রাসী’ মনোভাবের কাছে বর্তমান সরকার ‘নতজানু’। তিনি বলেন, একটি দেশ আমাদের প্রতি যে অন্যায়গুলো করছে এই অন্যায় ভয়াবহ। ২০ দলীয় জোট নেতাদের মধ্যেও কেউ কেউ ভারতের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছেন। জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ কাউকে খেরাজ-খাজনা দিয়ে রাজনীতি করে না। স্বাধীনতার বুক চিরে ট্রানজিট-করিডোর চলবে না। টনপ্রতি ১৯২ টাকায় আমার স্বাধীনতা বিক্রির লাইসেন্স দেশবাসী কোন গভর্নমেন্টকে দেয় নাই। এটা অত্যন্ত আশার কথা, সরকারের দমন-পীড়নে দিশেহারা হয়ে পড়া বিএনপি তার জাতীয়তাবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এ কথা মানতেই হবে, শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল থাকলে কোনো সরকারের পক্ষেই এভাবে ভারতের সমর্থন ও স্বার্থ রক্ষা করে চলা সম্ভব নয়। তাই সরকারের ক্ষমতায় থাকার স্বার্থ এবং ভারতের সমর্থন লাভের আশায় তার স্বার্থ রক্ষা করার জন্য শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দলকে সামনে থেকে সরিয়ে দেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। মূলত এই লক্ষ্যেই বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোটকে স্বাধীনতা বিরোধী ও জঙ্গি সংগঠনসহ নানা অপবাদ দিয়ে মারতে মারতে একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বিএনপি ও তার জোটকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি অপবাদ দিয়ে এবং সরকার নিজেদের একমাত্র স্বাধীনতার স্বপক্ষধারী হিসেবে গণ্য করে আমাদের স্বার্থ বিসজর্ন এবং সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। সবাই মনে করবে, স্বাধীনতার পক্ষের দলের সরকার কস্মিনকালেও এ কাজ করতে পারে না। অভিযোগ উঠেছে, সরকার নাকি ভারতের সাথে পঞ্চাশ দফা চুক্তি করেছে। তাতে কী আছে আজ পর্যন্ত জনগণ তার কিছুই জানে না। একটি সরকার কতটা দুর্বল হলে পরে অন্য দেশের সাথে আমাদের কী চুক্তি হয়েছে, তা প্রকাশ করে না। অপ্রকাশিত এ চুক্তির মধ্যেই যদি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়টি ক্ষুণœ হওয়ার মতো কোনো কিছু রয়েছে এমন চিন্তা যদি জনগণ করে তবে তা কি অযৌক্তিক হবে? জনগণ লক্ষ্য করছে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের কোনো ব্যাখ্যা বা প্রতি উত্তর সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে না। এমতাবস্থায় মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তারা ভাবতে পারে বাংলাদেশের মানুষ প্রচ্ছন্নভাবে ভারতের প্রভাব বলয়ের মধ্যে রয়েছে। যে দেশের মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, সে দেশের মানুষ ভারতের এমন আচরণ মেনে নেবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, যারা শুধুমাত্র সাময়িক ক্ষমতায় থাকার মোহে দেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বেতোয়াক্কা, তাদের জনগণ কখনো ক্ষমা করবে না।
চার.
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে, এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে জনগণ আশা করে। একটা সময় ভারতবিরোধী রাজনীতিকে ‘পলিটিক্যাল রেটরিক’ বা রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর হিসেবে ধরা হতো। তবে তার ভিত্তি ছিল। আমাদের প্রতি তার চরম বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ দেখে দেশের সিংহভাগ মানুষ ভারতবিরোধী হয়ে উঠে। এজন্য ভারত নিজেই দায়ী। এখন যদি বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা নিয়ে জরিপ করা হয়, তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, এই হার অতীতের যে কোনো হারের তুলনায় অনেক বেশি হবে। কারণ বাংলাদেশের মানুষ না খেয়ে থাকতে পছন্দ করে, অন্যের খবরদারির মধ্যে থাকতে চায় না। যুগে যুগে এর প্রমাণ তারা দিয়েছে। পরোক্ষ হোক আর প্রত্যক্ষ হোক, বাংলার মানুষ কারো কাছে দায়বদ্ধ ও নতজানু হতে চায় না। তারা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার পরিবেশে মুক্তভাবে জীবনযাপন করতে চায়। এখন সময় বদলেছে, রাজনীতির ধরনও বদলেছে। রাজনীতিটা হচ্ছে, সরাসরি দখল করে নয়, পরোক্ষভাবে কোনো দেশকে নতজানু করে রাখা। ভারতের কাছে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার যে কোনো মূল্য নেই, তা আমরা ৫ জানুয়ারির বহুল বিতর্কিত নির্বাচনে তার ভূমিকা দেখে বুঝেছি। করিডোর দিয়ে ভারতের মালামাল আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে টন প্রতি বাংলাদেশ যে ১০৫৮ টাকা ধরেছিল, ভারত তা পাত্তা না দিয়ে অনেকটা নিজেই মূল্য নির্ধারণ করেছে। সে ১৯২ টাকা দিতে চেয়েছে এবং তাই আমাদের সরকার বিনাবাক্যে মেনে নিয়েছে। এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন নানা প্রশ্ন ওঠে। এসব প্রশ্নের জবাব সরকারকে দিতে হবে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যে কেউ সরকারকে প্রশ্ন করতে পারে। তখন সরকার যদি গণতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল হয় তবে সে আশ্বস্থ করে বলবে, আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ভাব-মর্যাদা অটুট ও সুসংহত আছে। তবে যে সরকার গণতান্ত্রিকি নয়, দুর্বল এবং দুর্বলতা ঢাকতে দমন-পীড়ন বেছে নেয়, অন্য দেশের শক্তি ও সমর্থনের করুণা প্রার্থী হয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়, সে সরকার কখনোই সৎ সাহস নিয়ে নাগরিকদের এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। সে সবসময়ই ঢাকঢাক গুড়গুড় অবস্থার মধ্য দিয়ে চলে। দেশ ও জাতি তার কাছে গৌণ, ক্ষমতা মুখ্য। এজন্য দেশের স্বার্থ বিসর্জন ও পরোক্ষভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন