ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্টের বিরুদ্ধে আসাম আর ত্রিপুরার মামলা আলাদাভাবে শুনানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে আদালত এটা স্বীকার করে নিলো যে ভারতের মূল ভূখণ্ড – যারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মূল সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে, তারা এটা দেখতে ব্যর্থ হয়েছে যে, নতুন আইনের সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যটাই শুধু এই রাজ্যগুলোতে সমস্যা তৈরি করেনি।
সিএএ বিরোধী আন্দোলন, যেটা আসামে শুরু হয়েছে, সেটা বাড়তে বাড়তে এখন পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই আন্দোলন থেকে বিশেষ করে আসামের এবং সামগ্রিকভাবে উত্তরপূর্বাঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠির অস্তিত্বের প্রতি যে হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, সেটা ইস্যুটা সবার অগোচরে চলে গেছে। আর পুরো ভারতে এবং আন্তর্জাতিক বিবেকের কাছে এই বিষয়টি একেবারেই আড়ালে রয়ে গেছে।
আসামে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণ শুধু এটা নয় যে, সিএএ সাম্প্রদায়িক, এবং একটা বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি এতে বৈষম্য করা হয়েছে। বরং রাজ্যের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিগুলো – যাদের পরচিয় তাদের ভাষা, সংস্কৃতি আর আসামের ভূখণ্ডের সাথে জড়িয়ে আছে, তাদেরকে সুরক্ষার জন্য ১৯৭৯ সাল থেকে ছয় বছর দীর্ঘ যে আসাম মুভমেন্ট চালানো হয়েছিল, সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যে সব প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল, নতুন এই চুক্তির মাধ্যমে সেই সব প্রতিশ্রুতিগুলো ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এই পরিচয় এখন বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের কারণে হুমকির মুখে পড়ে গেছে। ১৯৮০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস এল শাকধার ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে একটি সার্কুলার জারি করে সকল অবৈধ ভোটারদের ভারতের নাগরিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে পিপলস রিপ্রেজেন্টেশান অ্যাক্টকে অবজ্ঞা করা হয় এবং ভোটার তালিকা পর্যালোচনার বিষয়টি বন্ধ হয়ে যায়। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই আসাম মুভমেন্টের সূচনা হয়েছিল।
আসামের অভিবাসীদের নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী জওহরলাল নেহরু আর সর্দার প্যাটেলের রাজনীতিটাই অনুসরণ করে গেছেন ইন্দিরা গান্ধী। নিজেদের ভূখণ্ডে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার যে আশঙ্কা রয়েছে আসামের মানুষের, গান্ধীজি সেটা বুঝলেও নেহরু আর প্যাটেল সেটার পাত্তা দেননি। জনসংখ্যার চিত্র বদলে দেয়ার মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। যে বিপর্যয়টা আসছে, গান্ধীজি সেটা দেখতে পেয়েছিলেন এবং আসামের নেতাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন যাতে প্রয়োজনে তারা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহে বসে। অবস্থাটা এই দাঁড়িয়েছে যে, আসাম যদিও ভারতের অংশ হয়েছে, কিন্তু শুরু থেকেই আসামের সমস্যাকে ভারতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে সেটার সমাধান করা হয়নি। এতে অবাক হওয়ার অবশ্য কিছু নেই: আদিবাসী জনগোষ্ঠি সারা পৃথিবীতেই ঔপনিবেশিক রাজনীতির শিকার যেখানে তাদের মৌলিক অধিকারকে অবজ্ঞা করা হয়েছে এবং তাদের উপর এমন রাজনীতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে যেটা তাদেরকে ভূমি, সম্পদ ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে এবং এর মাধ্যমে ঔপনিবেশিক সমাজ ও সংস্কৃতির সামনে মাথা নত করতে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে।
নতুন আইনে আসামিদের ‘পরিচয়ের’ ব্যাপারে কোন সম্মান দেখানো হয়নি। আসামে এই সিএএ আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকার কারণ হলো আসামের মানুষ এই আইনকে তাদের ভূমি, সংস্কৃতি, ভাষা এবং এর মাধ্যমে তাদের পরিচয় মুছে দেয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখছে, কারণ এই আইনের মাধ্যমে জনসংখ্যার ভারসাম্য বেপরোয়াভাবে নষ্ট হতে দেয়া হচ্ছে। তাদের চিৎকারের মধ্য দিয়ে বিশ্বের নৃতাত্তিক জাতিগোষ্ঠিগুলোর হাহাকার প্রতিফলিত হচ্ছে। সূত্র: এসএএম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন