আবদুল আউয়াল ঠাকুর
বাংলাদেশের শ্রোতাদের টার্গেট করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ একটি রেডিও চ্যানেল চালু করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে পশ্চিমবাংলার হুগলিতে একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার বসানো হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। আকাশবাণীর নোটে লেখা রয়েছে যে, মৈত্রী চ্যানেলের অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন এফএম কেন্দ্রের মাধ্যমে রিলে করার ব্যাপারে কথাবার্তা চলছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা প্রসার ভারতীর নির্বাহী জহর সরকার বিবিসিকে জানিয়েছেন, তাদের এই সম্প্রচারের লক্ষ্য বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়া। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের মানুষের ‘একাংশের’ মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব রয়েছে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা কূটনৈতিক প্রকাশ এই রেডিও স্টেশন। প্রসার ভারতীর মুখ্য কার্যনির্বাহী অফিসার জানিয়েছেন, দুই দেশের মধ্যে এত সাংস্কৃতিক মিল অথচ অনেক সময়েই অন্যরা কী করছে সেটা জানা যায় না। এই চ্যানেলে আমরা ভারতের শিল্পী-বিশ্লেষকদের সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদেরও ডাকব, যাতে একে-অন্যকে আরো ভালো করে বোঝা যায়। মতের আদান-প্রদান হয়। ভারতের রাজনৈতিক ভাষ্যকার অধ্যাপক সব্যসাচী বসু রায় চৌধুরী মনে করেন, আকাশবাণীর মাধ্যমে ভারত এটা বোঝাতে চাইছে যে, তারা বাংলাদেশের বৈরী নয়। তারা সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বেতার সংস্থা বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক কে এম নেসার উদ্দীন ভূঁইয়া বিবিসিকে জানিয়েছেন, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে এই রেডিও চ্যানেলটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে বেসরকারি রেডিও চ্যানেলগুলো বলছে, এর ফলে তারা বাণিজ্যিকভাবে চাপের মুখে পড়তে পারে। ইতোমধ্যেই অনেকে এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাংলা ভাষাতে হলেও বাংলাদেশে বাংলা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ভাষা অন্যদিকে ভারতে বাংলা একটি হারিয়ে যাওয়া ভাষার মধ্যে পড়ে। বাংলা ভারতের পশ্চিমবাংলার নাগরিকদের অনেকের এখনো মৌখিক ভাষা হিসেবে থাকলেও কার্যত ভারতের জাতীয় সংহতির চাপে হিন্দির দলনে সেখানে বাংলা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। সাধারণভাবে পশ্চিমবাংলার রাজধানী কলকাতায় বাংলাকে খুঁজে পেতে বা বাংলায় কথা বলতে সিদ্ধান্ত নিয়ে চলতে হয়। পরিস্থিতি এমন যে, ভারতীয় আকাশসীমা ভেদ করে আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশেও যখন হিন্দি আগ্রাসন মারাত্মকভাবে সক্রিয় তখন বাংলা ভাষায় রেডিও চ্যানেলের উদ্যোগকে একেবারে উদ্দেশ্যহীন মনে করার কোনো কারণ নেই, থাকতে পারে না। এটি কেবলমাত্র বাংলাভাষীদের জন্যই করা হচ্ছে সেরকম মনে করাও বোধহয় সন্দেহাতীতভাবে সত্যি নয়। এ ব্যাপারে ভারতীয় বিশ্লেষকগণও যেমনি একমত যে এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে তেমনি বাংলাদেশের বিশ্লেষকরাও উদ্বিগ্ন। বোধকরি এই উদ্বিগ্নতার আরো একটি বড় কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় হস্তক্ষেপের মাত্রা। হয়তো স্বাভাবিক কোনো সময় হলে এ নিয়ে তেমন প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকত না, কারণ একটি দেশের নির্বাচিত সরকারের সাথে নিকটতম প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক যদি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে হয় তাকে ভিন্ন চোখে বা দৃষ্টিতে দেখার কোনো সুযোগ নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভারতের তৎকালীন সরকারের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের মধ্যদিয়ে যে রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে তাকে ভারতীয় কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ ইতিবাচকতার চোখে দেখলেও সামগ্রিক এবং গণতন্ত্রের চোখে দেখলে তাকে অস্বস্তিকর মনে না করার কোনো কারণ নেই। আলোচ্য ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ভারতবিরোধী মনোভাব অপনোদনে এই চ্যানেল কাজ করবে। তাহলে অবশ্যই পরিষ্কার হওয়া জরুরি, আলোচ্য চ্যানেলটির মূল উদ্দেশ্য এবং এর স্বরূপ কি? ইতোমধ্যেই বাংলা ভাষায় নতুন করে এই রেডিও অনুষ্ঠান সম্প্রচারের পেছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দীর্ঘদিন ধরে গণমাধ্যমে কাজ করছেন এমন একজন সানাউল্লাহ লাভলু মনে করেন, যেহেতু এটা ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তাই এর একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকবে। তিনি আরো মনে করেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকবে। আর যেহেতু ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে সেহেতু এই রেডিওর অনুষ্ঠানে ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তোলা হবে। বাংলাদেশের এফএম রেডিও ভূমির স্টেশন চিফ শামস সুমন বলেছেন, ...আকাশবাণীর মৈত্রীর যদি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকে তাহলে বাংলাদেশের এফএম রেডিও প্রতিযোগিতায় পড়তে পারে। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা দরকারÑ বাংলাদেশের সাথে বোঝাপড়ার জন্য মৈত্রী চালু করার সক্রিয় উদ্যোগ থাকলেও দীর্ঘ চেষ্টা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর ভারতে প্রবেশের অনুমতি মেলেনি। অথচ নির্বিবাদে ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মিডিয়ার প্রচারণাকে হয়তো খুব একটা নেতিবাচকতায় দেখার কোনো সুযোগ নেই। দেখলে তাতে কারো কিছু আসে যায় তাও বোধহয় মনে করার কোনো কারণ নেই। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষায় রেডিও চ্যানেল রয়েছে। অনেক দেশের চ্যানেলের সাথেই বাংলাদেশের নাগরিকগণ জড়িত। এর মধ্যে বিবিসির আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যে কোনো কারণেই হোক বিবিসি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ একটু বেশি। যদিও বিবিসি আগের মতো নেই। এখন বিবিসির অনুষ্ঠানের মানের অনেক অধঃগতি হয়েছে, বিশেষ করে সেখানে ছাঁটাইয়ের পর। তা সত্ত্বেও বিবিসি এখনো সমভাবে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ। বিবিসির আলোচনা এ জন্য যে, বাংলাদেশ নিয়ে বিবিসি যেসব সংবাদ ও ফিচার প্রচার করে তার একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য রয়েছে। বিবিসির সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ে মাঝে-মধ্যে যারা কথাবার্তা বলেন তাদের কথায় এমনকি বিবিসিতে কাজ করেছেন এমনসব বন্ধু-বান্ধবদের কথাতেও এটা বোঝা যায় এমনকি বিবিসির নিয়মিত শ্রোতারাও টের পান বিবিসির মিশন নিয়ে। কোনো দীর্ঘ আলোচনা বা সমালোচনা এর উদ্দেশ্য নয় বরং এটুকু বলা যে, বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকটিতেই তাদের নজর। হতে পারে বৃটেনের গণতান্ত্রিক চর্চার কারণেই হয়তো এটাই তার পলিসি। এই পলিসির সাথে দেশের অনেক রাজনীতিকে নানা সময়ে পার্থক্য থাকলেও সাধারণ জনগণের সাথে একটা সুসম্পর্ক রয়েছে। গত কিছু দিনেও বিবিসি এমন কিছু খবর ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে, প্রকাশ করেছে যা বাংলাদেশের মিডিয়ার পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিবিসির সাথে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকলেও রেডিও তেহরানের সংবাদ ভাষ্যের একটি অনুষ্ঠান সারা বিশ্বের বাংলাভাষী মুসলমানদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে বিবিসি তার প্রচারণা চালাতে পারলেও রেডিও তেহরান তা পারেনি। কোনো কোনো মহলের চাপে তা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আধুনিক যুগে যেখানে মানুষ ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিশেষ করে টেলিভিশনে মুখ গুঁজে থাকে সেখানেও রেডিও কতটা জনপ্রিয় তা প্রমাণ করে আকাশবাণীর আলোচ্য উদ্যোগ। নিরপেক্ষ খবরের অর্থ হচ্ছে খবরের প্রতি পক্ষপাতিত্ব। একে খবরের বস্তুনিষ্ঠতাও বলা যেতে পারে। সঙ্গত বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে খবর কি? এ কথা বলে রাখা ভালো মিডিয়ার সাথে মূল সম্পর্ক মনে করা হয় ইহুদিদের। খবর কোনো না কোনোভাবে আন্তর্জাতিকভাবে ইহুদিদের স্বার্থরক্ষা করে। জনসংখ্যা পরিসংখ্যানের দিক থেকে এই জনগোষ্ঠী নগণ্য হলেও আধিপত্য বিস্তারের দিক থেকে প্রণিধানযোগ্য। খবর কি বা কোনটি খবর এ নিয়ে আধুনিক যুগে নানা আলোচনা রয়েছে। প্রকৃত খবর বা খবর বানানোর ব্যাপারটিও বর্তমানে আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। একজন সিনিয়রের কাছ থেকে শোনা একটি প্রসঙ্গ তুলে ধরতে চাই। হয়তো এটি নিছক গল্প, তবুও এর বিষয়বস্তু প্রণিধানযোগ্য। প্রভাবশালী কেউ একজন তার পরিচিতজনকে সাংবাদিক বানাতে একজন মালিক-সম্পাদককে নাকি অনুরোধ করেছিলেন। অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো সম্পাদকও তাই করেছিলেন। ছেলেটিকে খবর সংগ্রহ করতে বললে ছেলেটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। প্রথমদিন সে নাকি শহরে কুকুরের খবর দিয়েছিল। সম্পাদক তাকে বুঝালেন, এটা তেমন কোনো খবর নয়। তবে মানুষ কুকুরকে কামড়ে দিয়েছে এটা একটা ভালো খবর হতে পারে। কদিন পর নাকি আলোচ্য আগ্রহী এরকম একটা খবরই দিল। নিশ্চিত হতে সম্পাদক যাচাই-বাছাই করে নিশ্চিত হন যে কুকুরকে কামড়ে দেয়া ব্যক্তিটি আর কেউ নয় আলোচ্য প্রার্থী। পরের আলোচনা বোধকরি অর্থহীন। যা বলছিলাম, খবরের একটি লক্ষ্য, বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য থাকতে হয়। অন্যথায় একে খবর হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এ কারণেই দেশে দেশে নিগৃহীত নিপীড়িত মানুষের কথা আপনাতেই খবর হয়ে ওঠে। স্থান কাল পাত্রভেদে খবরের বিষয়বস্তু অনেকটাই অভিন্ন। মানুষের দুর্ভোগ দুর্যোগ, মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন দুর্ভিক্ষ মহামারী এসবই খবরের বিষয়বস্তু। অর্থাৎ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা-পুনঃপ্রতিষ্ঠা এসব নিয়েই সারা দুনিয়ার খবরের কাজ। এসব ক্ষেত্রে হয়তো দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের জন্য নানা প্রশ্ন ওঠে বা উঠছে। সে কথা আলাদা। আলোচ্য মৈত্রী রেডিওর লক্ষ্য হচ্ছে, একটি সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন। বোধকরি এমন ধারণা এই প্রথম শোনা গেল। কারণ কোনো সরকারের সাথে সম্পর্ক নির্ভর করে সে দেশের জনগণের সাথে সম্পর্কের বিবেচনায়। জনগণকে শাসানো এবং শুধুমাত্র সরকারের সাথে সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি যে একটি গণমাধ্যমের লক্ষ্য হতে পারে বোধকরি এমন ধারণাও ভারতের আগে কোথাও শোনা যায়নি। কোনো ক্ষেত্রে আদর্শের বিষয় থাকতে পারে সে ক্ষেত্রে হয়তো এমন কোনো আলোচনা রয়েছে। ধরা যাক কোনো বিশেষ মতাদর্শের প্রসঙ্গ থাকতে পারে, যার সাথে কোনো কোনো মহলের বিশেষ সম্পর্ক থাকতে পারে। এ আলোচনার নানা দিক রয়েছে। এমন এক সময় ছিল যখন কোনো ঘটনার সত্যতা প্রমাণের জন্য রয়টার্স, এএফপি না তাসের ওপর নির্ভর করতে হবে সেসব প্রসঙ্গ উঠত। এখনো ক্ষেত্রবিশেষ রয়েছে। যখন কোনো হামলা হয় তখনও প্রশ্ন থাকে কে কীভাবে দেখছে লিখছে বলছে। আফগানিস্তান-ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আক্রমণের সময়ও যুদ্ধের বিবরণ ও বিশ্লেষণ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। যেসব দেশের সংবাদ মাধ্যমকে এর আগে নিরপেক্ষ বলে মনে করা হতো তাদের খররের বিশ্বস্ততা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন ছিল। বাংলাদেশেও এর বহু নজির রয়েছে। অনেক ঘটনারই বিবরণ বিশ্লেষণ সব মিডিয়ায় অভিন্ন নয়। এই মতপার্থক্যকে যদি শত ফুল ফুটতে দেয়ার দৃষ্টিতে দেখা যায় তাহলে এর একরমক অর্থ দাঁড়াবে। এসব ক্ষেত্রে সমর্থন-অসমর্থনের বিষয় রয়েছে, রয়েছে মতাদর্শের ব্যাপারও। সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতায় দাঁড়িয়ে থেকে যেসব বিশ্লেষণ করা হয় তার সাথে দ্বিমত থাকলেও তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ খুবই কম। বাংলাদেশের মিডিয়া নিয়ে এখন নানা আলোচনা রয়েছে। কোনো গভীর বিশ্লেষণে না গিয়েও বলা যায় মিডিয়ার একটি বড় অংশই এখন সরকার তথা ভারতীয়দের সমর্থক। এরা অনেকেই কেবলমাত্র সরকারে কর্মকা- বা গৃহীত কর্মপন্থাকে সমর্থনই করছে না বরং অনেক ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রবর্তী বাহিনীর ভূমিকাও পালন করছে। সেসব ক্ষেত্রে হয়তো সমর্থন অসমর্থনের প্রশ্ন থাকতে পারে। সে এক দিক। দেশে এতসব মিডিয়া সরকার ও ভারতের পক্ষে যে প্রচারণা চালাচ্ছে তাকে যথেষ্ট মনে না করে একটি অগ্রণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ব্যাপক ধরপাকড়, গুপ্তহত্যার মধ্যদিয়ে টিকে থাকার চেষ্টায়রত একটি সরকারকে সমর্থনের জন্য চ্যানেল খোলার বিষয়টি সত্যিই ভাবার। মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে ঘোষিত কারণই হয়তো মূল কারণ নয়, গভীরে আরো অন্তর্নিহিত কিছু রয়েছে।
গোয়েবলসীয় প্রচারণার ধরন নিয়ে নতুন আলোচনা অর্থহীন। একটি মিথ্যা বারবার বলে তাকে সত্যে পরিণত না করা গেলেও এক ধরনের বিভ্রান্তি যে সৃষ্টি করা যায় তার অজ¯্র উদাহরণ বর্তমান সময়েও রয়েছে। একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আক্রমণের আগে বারবার বলা হয়েছে, সেখানে মারাত্মক অস্ত্র রয়েছে। দখলের পর তো ইরাক চষে বেড়িয়েছে মার্কিন বাহিনী। কই খুঁজে পেয়েছে ? ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বারবার বলেছেন, তার কাছে এ ধরনের কোনো অস্ত্র নেই। মিথ্যা অভিযোগে ইরাক দখল এবং পরবর্তী বীভৎসতার জন্য তো কেউ মার্কিন বা তাদের দোসরদের বিচারের কথা বলছে না। ইরাকসহ ওই অঞ্চলে এখন যা ঘটছে তার জন্য মূলত এ আক্রমণই দায়ী। ইঙ্গ-মার্কিন আক্রমণের আগে ওই অঞ্চলের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। যারা বিশ্বশান্তির জন্য কথা বলছেন তারা তো এই জটিল বিষয়টি তুলছেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্প্রতি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির হত্যাকা-কে ভুল বলে স্বীকার করেছেন। এসব স্বীকারোক্তিতে মূল পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। লিবিয়ার মিঠাপানি এখন ফ্রান্সে সস্তা দামে বিক্রি হচ্ছে আর লিবীয় জনগণ মরছে গৃহযুদ্ধে। এসব ঘটনার পেছনে একশ্রেণীর মিডিয়ার অপপ্রচারের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এসব উদাহরণ সামনে রেখে এটা বলা কষ্টসাধ্য যে, মৈত্রী চ্যানেলের আসল উদ্দেশ্য কি। অন্তত নেপাল বা ভারতের অন্য পার্শ¦বর্তী দেশগুলোর দিকে যদি তাকানো যায় তাহলে এই বোঝাপড়ার বিষয়টির আধিক্য বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
প্রসঙ্গ যদি ভারত বিরোধিতার অপনোদন হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই দুই দেশের সম্পর্কের দিকে নজর না দিয়ে কোনো উপায় নেই। ভারতের সাথে বাংলাদেশের জনগণের বৈরিতা রয়েছে এমন ধারণা পোষণ করতে হলে অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে তার স্বরূপ কি? ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় পক্ষই দাবি করছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পরস্পর পরস্পরের বন্ধু প্রতিমে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়েও দাবি করা হচ্ছে, সম্পর্ক যে কোনো সময়ের চেয়ে উত্তম। তা সত্ত্বেও সম্পর্ক যে স্বাভাবিক অথবা যথেষ্ট নয় সেটাই প্রমাণ করছে বর্তমান উদ্যোগ। চলমান সম্পর্কের প্রকৃতি হচ্ছে একপক্ষীয়। ফারাক্কা বাঁধ-পরবর্তী বাংলাদেশে যে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তার একমাত্র কারণ ভারতের বৈরী পানি নীতি। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে সামান্য পরিমাণ পানি দিতেও ভারতীয়দের অনীহা। পানি নিয়ে যেসব সংকটের কথা ভারতীয়রা বলে আসছে তা নিয়ে দুই পক্ষেই এক প্রকার আলোচনা হয়েছে। পানির প্রবাহ বাড়ানো বা বর্ষাকালীন অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার বিষয় নিয়েও দুই দেশের মধ্যে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। হিমালয়ের পাদদেশে রিজার্ভার নির্মাণে ভারত বাংলাদেশ নেপালকে অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনাও কম হয়নি। বাংলাদেশের পানি সমস্যা সমাধানে গঙ্গা বাঁধের আলোচনাও হয়েছে। কার্যত সব আলোচনাই ভ-ুল হয়ে গেছে বা যায় ভারতীয় একগুঁয়েমি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। পানি চাওয়া ভারতবিরোধিতা না দেশপ্রেম সেটি অবশ্যই বিবেচনার বিষয়। সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যার বিরোধিতা দেশপ্রেম না ভারতবিরোধিতা তাও নিয়েও ভাবার রয়েছে। নির্বাচন একটি দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। বাংলাদেশে এই অধিকার প্রয়োগে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বাধা প্রদানের বিরোধিতা করা যদি ভারত বিরোধিতা হয় তাহলে অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে ভারত সমর্থনের ভিত্তি কি? বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণসহ পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক বিশ্ব যখন বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পক্ষে কথা বলছে তখন ভারতীয়রা অনেকটাই অনির্বাচিত সরকার রক্ষার প্রচারণায় মাঠে নামতে সচেষ্ট হচ্ছেন। এটা মূলত এক ধরনের আগ্রাসনের শামিল। অথবা পূর্বলক্ষণ। এই সমঝোতার অর্থ পারস্পরিক বোঝাপড়া নয় বরং ভারতীয় চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া। এই দাদাগিরি খেলার পরিণতি সুখকর হবে বোধকরি তা বলা যাবে না। শেষ করি কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি চরণ দিয়ে “পঞ্চশরে বিদ্ধ করে করেছ একি সর্বনাশ, বিশ্ব মাঝে দিয়েছ তাকে ছড়িয়ে।” ভারতীয়দেরও বুঝতে হবে তারা যাদের নির্মূল করতে চাচ্ছেন সরকারের সাথে মিলে তারা মিশে আছে এদেশের মাটিতে ঘাসে বটমূলে শস্যক্ষেতে সে কারণেই সমঝোতা হতে হবে সাধারণের সাথে।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন