মোবায়েদুর রহমান : সুপ্রীম কোর্টের একজন আওয়ামী পন্থী আইনজীবী বিএনপি চেয়ারপারসন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা বা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাভ করেছে এবং আদালত মামলাটি আমলে নিয়েছে। ঢাকার নিম্ন আদালত এই মামলার ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়াকে আগামী ৩ মার্চের মধ্যে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া নির্ধারিত দিনে আদালতে হাজিরা দেবেন কিনা সেটি আমরা জানি না। সেটি একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। যে কারণে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা আনা হয়েছে সেই কারণটি অত্যন্ত সাধারণ।
মামলার আরজিতে বলা হয়েছে, বিগত বছরের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেন, ‘আজকে বলা হয় এত লাখ শহীদ হয়েছে, এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।’ ২৩ ডিসেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যে দেশদ্রোহিতার আলামত পাওয়া যাচ্ছে, এমন অভিযোগ করে আওয়ামী এডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন আহমদ সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে তা প্রত্যাহার করার জন্য বেগম জিয়ার কাছে উকিল নোটিশ পাঠান। নোটিশের জবাব না পাওয়ায় এডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৬ ধারা মোতাবেক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা অনুমোদনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানান। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়ার পর ২৫ জানুয়ারি (২০১৬) সোমবার বেগম জিয়াকে গ্রেফতারের আবেদন করে তিনি মামলা দায়ের করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম রাশেদ তালুকদারের আদালত ঐ দিন দুপুরেই শুনানি শেষে গ্রেফতারের সমন জারি করেন এবং আগামী মার্চে বা তার আগে খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির হতে বলেন। এই বিবরণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বেগম জিয়াকে মাত্র একটি বাক্য উচ্চারণ করার জন্য দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সেই বাক্যটি ছিল, ‘আজকে বলা হয় এত লাখ শহীদ হয়েছে, এটা নিয়েও অনেক বিতর্ক আছে।’ অথচ একই বিষয়ে অনেক বেশি কথা বলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ^র চন্দ্র রায়, স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এবং দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।
বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, বিএনপি নেত্রী এমন কি বক্তব্য দিলেন যে তিনি অপরাধী হয়ে গেলেন? আমরা সবাই তার কথায় সমর্থন জানালাম। পারলে এখন সবাইকে গ্রেফতার করুন। ৩১ জানুয়ারির প্রথম আলোর রিপোর্টে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়ার বক্তব্যে সমর্থন জানিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, ‘বিএনপি নেত্রী এমন কী বক্তব্য দিলেন যে তিনি অপরাধী হয়ে গেলেন? আমরা সবাই তার কথায় সমর্থন জানালাম। পারলে এখন সবাইকে গ্রেফতার করুন।’
‘সম্মান জানানোর কর্তব্য’ পালনে এবার মুক্তিযুদ্ধে শহীদের নাম লিপিবদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তাদের তালিকা হয়েছে, হচ্ছে। আমরা সম্মানী ভাতা পাচ্ছি। যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের সম্মান জানানো কি আমাদের কর্তব্য নয়?’
গত শনিবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনে ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক প্রতিবাদ সমাবেশে নজরুল ইসলাম খান এসব কথা বলেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বক্তব্যের কারণে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার প্রতিবাদে ২০-দলীয় জোটের শরিক জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এ সমাবেশের আয়োজন করে।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, শহীদের নাম লিপিবদ্ধ করতে মুজিব সরকারের আমলে বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটি প্রথমে ২৮ হাজার শহীদের নাম লিপিবদ্ধ করেছিল। কিন্তু এটা কারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তাই পরবর্তী সময়ে ২ লাখের বেশি সংখ্যক নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে কথা বলার সময় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘থ্রি মিলিয়ন’। তারপর থেকে এটাই শহীদের সংখ্যা ধরা হয়।
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, এম আর আখতার মুকুলসহ অনেক বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা একেক রকম উল্লেখ করেছেন। খালেদা জিয়া তো কোনো সংখ্যা উল্লেখ করেননি। তাহলে তো খালেদা জিয়ার আগে তাদের নামে মামলা করা উচিত। শেখ মুজিব তো যুদ্ধের পরে মুক্তি যোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করার জন্য কমিটি করেছিলেন। এমনকি প্রতি পরিবারকে ২ হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তারপরও ১ লাখ ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম পাওয়া গিয়েছিল।
॥ দুই ॥
এর আগে গয়েশ^র চন্দ্র রায় বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং -মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কথা বলেছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে তিনি কথা বলেছেন ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখে। খালেদা জিয়ার পর এবার মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে মন্তব্য করলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। গত ২৫ ডিসেম্বর শুক্রবার প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা নির্বোধের মতো মারা গেছেন। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ন্যাশনালিস্ট এক্স স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ‘স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রুহুল কবির রিজভী’ শিরোনামে এক আলোচনা সভায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের যারা বেতন-ভাতা খাইছে শেষ দিন পর্যন্ত, তারা (শহীদ বুদ্ধিজীবী) নির্বোধের মতো মারা গেল, আমাদের মতো নির্বোধেরা প্রতিদিন তাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ফুল দেয়। না গেলে আবার পাপ হয়। ওনারা যদি এত বুদ্ধিমান হন, তাহলে ১৪ তারিখ পর্যন্ত নিজের ঘরে থাকে কী করে, একটু বলেন তো। আর তাছাড়া নিজ নিজ কর্মস্থলে প্রতি মাসে পাকিস্তানের বেতন খাইল, এটাও তো বলা যায়, যায় না? পাকিস্তান সরকারের তারা বেতন খাইল, তারা হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা, আর যারা পালায়ে পালায়ে না খেয়ে বেড়াল তারা হয়ে গেল রাজাকার। তাই না?’
গয়েশ্বর বলেন, যারা ২৫ মার্চ মারা গেছেন, তারা মারা গেছেন না জানার কারণে। আর যারা ১৪ ডিসেম্বর মারা গেছেন, তারা অজ্ঞতার কারণে মারা যাননি। তারা জ্ঞাতসারে অবস্থান করছিলেন।
এর আগে গত ২১ ডিসেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তার ওই বক্তব্যকে সমর্থন জানান গয়েশ্বর। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বলেছেন, বিতর্ক আছে। উনি কমও বলেননি, বেশিও বলেননি। বলেছেন সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই বিতর্কের কথাটা ১৯৯১ সালে সংসদেও উঠেছিল। গয়েশ্বর বলেন, এখন আধুনিক প্রযুক্তি আছে। ইচ্ছা করলে সাত দিনের মধ্যে পরিসংখ্যান বের করা যায়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি জরিপ করারও আহ্বান জানান তিনি।
গয়েশ্বরের মতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হিথরো বিমান বন্দরে শহীদের সংখ্যা তিন লাখের জায়গায় তিন মিলিয়ন/৩০ লাখ বলেছিলেন। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে এমনটি হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে ৩ লাখ ৭৬ হাজার পরিবারের তালিকা আছে। বাকি ২৭ লাখ কোথায়?
আয়োজক সংগঠনের সভাপতি বাহাউদ্দিন বাহারের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, সাবেক সাংসদ সৈয়দা আসিফা আশরাফি প্রমুখ বক্তব্য দেন।
॥ তিন ॥
মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কে পরবর্তিতে আরো স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন বাবু গয়েশ^র চন্দ্র রায়। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের নাম প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন। গত বুধবার ২৭ জানুয়ারি বিকেলে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক দোয়া-মাহফিলে অংশ নিয়ে তিনি এই দাবি করেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা মহানগর বিএনপি ওই মিলাদ ও দোয়া-মাহফিল আয়োজন করে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার প্রসঙ্গ টেনে গয়েশ্বর রায় বলেন, ‘কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা। সত্য কথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতা, আর মিথ্যা কথা বললে দেশপ্রেম, এই নীতিতে বিশ্বাস করি না। সত্য যত নির্মম হোক, সত্য সত্যই। ইতিহাস সঠিকভাবে লিখতে হয়। কে কত লাখ বলল এটা বড় কথা নয়। গুণে গুণে ৩০ লাখ শহীদের নাম পত্রিকায় প্রকাশ করুন। তারপর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যত পারেন, মামলা করেন।’ মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদদের প্রতি ইঙ্গিত করে গয়েশ্বর রায় বলেন, ‘তারা ৩০ লাখ হোক, বা ৬০ লাখ হোক, তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। তাদের তালিকা কী কারণে থাকবে না। শহীদদের নাম উল্লেখ করে এলাকায় এলাকায় স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করতে হবে। শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো, তাদের ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ জন্য সরকারকে বলব, মামলা-টামলা যা দেন লাভ হবে না।’
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘আমরা যত চুপ করে থাকি না কেন, মামলা আমাদের ছাড়বে না। সহকর্মীদের গুমের মিছিল অনেক বড় হয়ে গেছে। শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। নিখোঁজ গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে। নিজের ভালো থাকার জন্য কৌশল অবলম্বন না করে বুক টান করে রাজপথে হাঁটুন।’
॥ চার ॥
প্রিয় পাঠক, আজ আমি এই কলামে নিজস্ব কোনো বক্তব্য দেইনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কথা বলিনি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়েও নিজস্ব কোনো বক্তব্য অথবা মন্তব্য দেইনি। বেগম জিয়াসহ বিএনপির ৪ জন সিনিয়র ও অভিজ্ঞ নেতার বক্তব্য হুবহু তুলে ধরেছি মাত্র। এসব বক্তব্য অত্যন্ত সাম্প্রতিক। তারপরেও আমি তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি। এজন্যই এটা করেছি যে, আপনারা ৪ জনের বক্তব্যই পাশাপাশি পড়–ন। দেখুন, বেগম জিয়া মাত্র ১ লাইনের বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানেও মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সম্পর্কে এক বিন্দুও কটাক্ষ করেন নেই। তারপরেও তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা আনা হয়েছে। অথচ অন্য ৩ নেতা যা বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আমাকে কেউ ভুল বুঝবেন না। আমি ঐ ৩ নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছি না । কারণ তারাও মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সম্পর্কে এক বিন্দুও কটাক্ষ করেননি। আমার বক্তব্য হচ্ছে, ১ লাইনের বক্তব্যের জন্য যদি বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হতে পারে তাহলে যারা একাধিক লাইনের বক্তব্য দিলেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় না কেন? আসল কথা হলো, বেগম জিয়া তাদের চোখের বালি। তাকে ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে।’
e-mail: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন