রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

লক্ষ্মীপুরে ৬ মাসে ৩৭ লাশ উদ্ধার-জনমনে আতঙ্ক

মামলার তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারে নেই অগ্রগতি : অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অপরাধ কমবে বলে সচেতন মহলের ধারণা

প্রকাশের সময় : ১০ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এস এম বাবুল (বাবর), লক্ষ্মীপুর থেকে
লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে চলিত বছরের ৬ মাসে নারী ও শিশু, রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমিক, মাদক ব্যবসায়ী, ও সাধারণ মানুষের ৩৭টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে ১১ নারী, ৩ শিশু রয়েছে। ৬ লাশের পরিচয় পাওয়া যায়নি। ২জন পুলিশের সাথে ক্রস ফায়ারে নিহত হয়। আধিপত্ত বিস্তার, মাদকব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, জমিসংক্রন্ত বিরোধ, যৌতুক আদায়, ক্রস ফায়ারসহ নানা কারণে এসব হত্যাকা- সংঘটিত হয়। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এসব লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটলেও এসব হত্যার কারণ উৎঘাটনে ব্যর্থতা, প্রকৃত আসামিরা গ্রেফতার না হওয়া হত্যাকা-ের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সচেতন মহল মনে করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ঘটনায় প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার ও মামলার তদন্তে অগ্রগতি না থাকায় জেলার মানুষ শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। সর্বত্র বিরাজ করছে আতঙ্ক, সৃষ্টি হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। তিনটি ডাবল মাডারসহ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় ১৭টি, রায়পুর উপজেলায় ৮টি, কমলনগর উপজেলায় ৭টি এবং রামগঞ্জ উপজেলা ৫টিসহ মোট ৩৭টি লাশ উদ্ধার হয়েছে। (লক্ষ¥ীপুর সদর) গত ২৬জুন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজার ইউনিয়নের মহাদেবপুর এলাকায় ১০ মাসের শিশু কন্যা রাইসার লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১২জুন সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নের নলডগী গ্রামের একটি খাল থেকে অজ্ঞাত এক নারী (৩০) ও শিশুর (১০) গলা কাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ১০জুন সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের রমারখিলের বাড়ি থেকে লাবনী আক্তার (১৫) নামে এক মাদ্রাসার ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। লাবনী স্থানীয় রমারখিল ইসলামীয়া জাব্বারিয়া দাখিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্রী ও রমারখিল  গ্রামের প্রবাসী দেলোয়ার হোসেনের মেয়ে। গত ২৫মে সদর উপজেলার বশিকপুর গ্রামের বৈদ্দের বাড়ির মোড়ে মো. ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ও তার ভাই ইব্রাহীম হোসেন রতনকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতরা সদর উপজেলার পূর্ব বশিকপুর গ্রামের মুন্সি বাড়ির শরিফ উদ্দিনের ছেলে। নিহতদের চাচাতো ভাই হারুনুর রশিদ জানান, সকালে ইসমাইল ও রতন বৈদ্দের বাড়ির মোড়ের একটি চায়ের দোকানে বসে ছিল এসময় সিএনজি চালিত অটোরিকশায় করে চার/পাঁচজন যুবক এসে তাদের খুব কাছ থেকে গুলি করে পালিয়ে যান। গত ১০মে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ইউছুফ নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। নিহত ইউছুফ বশিকপুর ইউনিয়নের আলী আকবরের ছেলে। চন্দ্রগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একে এম আজিজুর রহমান মিয়া সাংবাদিকদের জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা থেকে অভিযান চালিয়ে ইউছুফকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার সহযোগী সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর গুলি চালায়। এসময় পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুড়ে। এতে সন্ত্রাসী ইউছুফ নিহত হন। গত ৯মে সদর উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রাম থেকে আলাউদ্দিন (১৪) নামে এক কিশোরের লাশ একই গ্রামের বিসমিল্লাহ বেকারি থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। আলাউদ্দিন দত্তপাড়ার উত্তর মাগুরি গ্রামের আবুল কালাম আজাদের ছেলে। গত ৩০এপ্রিল সদর উপজেলার লামচরী এলাকায় জান্নাতুল ফেরদৌসী নামে এক গৃহবধূকে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে। নিহত জান্নাতুল ফেরদৌসী সৌদি প্রবাসী বেলাল হোসেনের স্ত্রী। নিহতের স্বজনরা জান্নাতুল ফেরদৌসিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। গত ২৮এপ্রিল গভীর রাতে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাঙ্গাখাঁ ইউনিয়নের রাজিবপুর গ্রামে ইসমাইল হোসেন মানিক (৪৮) ও কামরুল ইসলাম (২৮)নামের দুই ব্যক্তিকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতের স্বজনরা জানায়, রাত সোয়া ১টার দিকে কে বা কারা মোবাইল ফোনে কামরুল ও মানিককে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এরপর রাতে আর তারা ফিরে আসেননি। সকালে গ্রামের নবী উল্যার দোকানের পাশে তাদের লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেন। গত ০৬ এপ্রিল  লক্ষ্মীপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সন্ত্রাসী কাউসার (বড় কাউসার) নিহত হয়েছেন। নিহত কাউসার চন্দ্রগঞ্জের পশ্চিম লতিফপুর গ্রামের ইউনুছ মিয়ার ছেলে। চন্দ্রগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একে এম আজিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সন্ত্রাসী কাউসারকে  গ্রেফতারের পর রাতে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পুলিশও আত্মরাক্ষার্থে পাল্টাগুলি চালায়। গত ০৪ মার্চ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের বিনোদধর্মপুর গ্রামে শাহেদ আলম নামে এক সৌদি প্রবাসীর বাড়ি থেকে ফারুক হোসেন (১৯) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত ফারুক হোসেন সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের পরাশগঞ্জ গ্রামের কারিমুল হকের ছেলে। গত ০১ মার্চ সদর উপজেলার টুমচর ইউনিয়নের কালিরচর গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় রুহুল আমিন (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি দুপুরে লক্ষ্মীপুর শহরের রহমতখালী খালের রেহান উদ্দিন ভূঁইয়া ঈদগাঁও এলাকা থেকে নির্মাণ শ্রমিক আবুল কালামের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত আবুল কালাম সদর উপজেলার চরুহিতা গ্রামের মৃত মোবারক আলীর ছেলে। গত ১১ জানুয়ারি সদর উপজেলার মান্দারী থেকে জাহেদা বেগম ও বিজয়নগর থেকে আসমা বেগম নামে দুই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার পুলিশ। জাহেদা বেগম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের সোলায়মানের স্ত্রী এবং আসমা বেগম বিজয়নগরের দক্ষিণ হামছাদী গ্রামের মো. হোসেনের স্ত্রী। গত ১৮ জুন রায়পুর উপজেলার বামনী ইউনিয়নের সাগরদী গ্রামের  একটি  খাল থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ১১ জুন রাতে রায়পুর পৌর শহরের মোল্লার হাট এলাকা থেকে লাকী আক্তার (২৮) নামের এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহতের ভাই মাসুদ জানান, যৌতুকের জন্য তাকে  নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। গত ৪ জুন রায়পুর উপজেলার শায়েস্তানগর এলাকার দেবিপুর গ্রামের দেওয়ান বাড়ি থেকে ফরিদা বেগম (২৮) নামের এক গৃহবধূর  লাশ তার স্বামীর বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ফরিদা সোনাপুর ইউনিয়নের বাসাবাড়ি এলাকার লুতু মিয়ার মেয়ে। গত ২৭ এপ্রিল  রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ কেরোয়া গ্রামে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলা থেকে বৃদ্ধ বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে  মো. আরিফ (৩৫) নামে এক যুবক নিহত হয়। নিহত আরিফ ওই গ্রামের আনার উল্যা মৌলভী বাড়ির মোহাম্মদ আলীর ছেলে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ বাজার এলাকার রচিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পিছনের ফারুক মিয়ার সুপারির বাগান থেকে অজ্ঞাত যুবকের মাথাবিহীন লাশ উদ্ধার করেছেন থানা পুলিশ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রায়পুর উপজেলার উদমারা গ্রামের সরর্দার বাড়ি থেকে নুর মোহাম্মদ মাস্টারের ছেলে মো. ইউছুফ (২৫) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ২৩ জানুয়ারি রায়পুর উপজেলার চরআবাবিল ইউনিয়নের গাইয়ারচর গ্রাম থেকে এক অজ্ঞাত নারীর (৪০) রক্তাক্ত ও জখম হওয়া লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ৬ জানুয়ারি রায়পুর উপজেলার চরবংশী ইউনিয়নের চরবংশী গ্রামের ধানক্ষেত থেকে উদমারা গ্রামের সিরাজ সরদারের ছেলে মো. জলিল সরদার (৩০) নামের এক যুবকের লাশ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করেছেন পুলিশ। গত ০৬ জুন চর জাঙ্গালীয়া এলাকার সানা উল্যার বাড়ির টয়লেটের টাংকি থেকে মাকছুদ নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত মাকছুদ চর লরেন্স ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের এনায়েত উল্যার ছেলে। গত ১৮ এপ্রিল  কমলনগর উপজেলার পাটোয়ারিহাট ইউনিয়নে মেঘনা নদী সংলগ্ন খালে নোঙর করা নৌকা থেকে কবির হোসেন (২১) নামে এক জেলের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত জেলে কবির হোসেন দক্ষিণ চর ফলকন গ্রামের আবুল বাশারের ছেলে। গত ০৬ এপ্রিল কমলনগর উপজেলার চরলরেন্স ইউনিয়নের করইতলা এলাকায় ডাকাতের গুলিতে আবদুল অদুদ জমদ্দার (৬২) নামে এক গৃহকর্তা নিহত হয়েছেন। গত ১২ মার্চ কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা গ্রামের চক বাজার এলাকায় জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে আল মাসুদ লিমন (৫০) নামের একজন নিহত হয়েছেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কমলনগর উপজেলার চর লরেন্স ইউনিয়ন থেকে সাজু বেগম (২৪) নামের এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত সাজু বেগম চরলরেন্স ইউনিয়নের শাহ আলমের মেয়ে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি কমলনগর উপজেলার চরলরেন্স এলাকা থেকে আবদুল গণি (৩৮) নামে এক যুবকের  লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৬ জানুয়ারি কমলনগর উপজেলার চরলরেন্স গ্রামে থেকে পুলিশ সুলতানা (২০) নামে এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করে। গত ২৫ জুন রামগঞ্জ উপজেলার ৩ নং ভাদুর ইউনিয়নে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত রহিমা বেগম প্রকাশ সুন্দুরী (৪০) নামে এক মহিলার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। সুন্দুরী বেগম ভাদুর তপদার বাড়ির বিল্ললা হোসেনের স্ত্রী। গত ৯ জুন দরবেশপুর ইউনিয়নের পূর্ব দরবেশপুর গ্রামের হানিফ ভূঁইয়া বাড়ি সংলগ্ন একটি ডোবার পাশে অজ্ঞাত একটি লাশটি পুঁতে রাখা হয়। গত ২৫ মে রামগঞ্জের চন্ডিপুর ইউনিয়নের মাসিমপুর গ্রামের মন্দারবাড়ি থেকে প্রিমা পাল (৯) নামের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। সে একই ইউনিয়নের মন্দারবাড়ি এলাকার নরেশ পালের মেয়ে এবং পূর্ব মাসিমপুর সরকারি  প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। গত ৮  ফেব্রুয়ারি দুপুরে রামগঞ্জ উপজেলার ভোলাকোট ইউপির এমবিএম ব্রিকস্ ফিল্ড সংলগ্ন ডোবা থেকে যুবলীগ নেতা মো. রাসেলের (২৫) লাশ উদ্ধার করেছে থানা পুলিশ। সে একই এলাকার মৃত নোয়াব আলীর ছেলে। গত ৭ জানুয়ারি সকালে রামগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম আঙ্গারপাড়া এলাকায় প্রবাসী বাচ্চু দেওয়ানের বাড়ি থেকে পুলিশ হাত-পা বাঁধা মুসলিম মিয়া (৩৫) নামক এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে। চোর সন্দেহে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সন্ত্রাস দমনে পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয় হলেও জেলার সর্বত্র অপরাধ কমছে না। পুলিশ প্রশাসন কখনো রাজনৈতিক অপরাধীদের ধমন করছে, কখনো ধমনে ব্যর্থ হচ্ছে। যার কারণে অপরাধ কমছে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন