শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

জাতির পিতার ছেলেবেলা

আহমেদ উল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০২০, ১২:০৩ এএম | আপডেট : ৮:০০ পিএম, ১৭ মার্চ, ২০২১

১৯২০ সালের ১৭ মার্চে বনবীথির ছায়াঘেরা নিবিড় মধুমতি আর ঘাগোর নদীর তীরে, হাওড়-বাওড়ের স্নিগ্ধ সম্মিলনে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক পরিবেশে আমোদিত গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও তার সহধর্মিনী সায়রা খাতুনের ঘর তথা গোটা ভারত বর্ষ আলোকিত করে যে সূর্যসন্তানের জন্ম হয়েছিল পরবর্তীতে তিনিই হয়েছেন বাঙালি জাতির কর্ণধার ও স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জন্মের পর বাবা-মা আদর করে তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘খোকা’।
শৈশব থেকেই খোকা ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। গ্রামের মাটি ও মানুষ তাকে যেমনটা আকর্ষণ করতো, তেমনি তিনিও গ্রামের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসেছিলেন পরম মমতায়। পক্ষান্তরে তাকেও সবাই আপন সন্তানের মতো বিশ্বাস করতো ও ভালোবসতো। গ্রামের শ্যামল ছায়ায় শেখ মুজিবের ছেলেবেলা কেটেছিল দুরন্তপনায়; তিনি ছিলেন ওই সময়ের বালকদের রাজা। মধুমতির মৃদু ঢেউয়ে সাঁতার কাটা, দলবেঁধে ফুটবল, ভলিবল খেলায় মাতিয়ে রাখতেন গ্রামময়।
শৈশব থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন অত্যন্ত মানবিক হৃদয়ের অধিকারী। তিঁনি মানুষকে যেভাবে ভালোবাসতেন, তেমনি বিভিন্ন পশু-পাখিকেও স্নেহের আচলে জড়িয়ে রাখতেন। বিশেষ করে দোয়েল ও বাবুই পাখি অত্যন্ত ভালোবাসতেন, এমনকি বাড়িতে শালিক ও ময়না পাখি, বানর ও কুকুর পুষতেন শেখ মুজিব; মানুষের পাশাপাশি পাখি ও জীবজন্তুর প্রতি ছিল কিশোর শেখ মুজিবের গভীর হৃদয়ের ভালোবাসা।
দশ বছর বয়সেই তিনি নিজের গায়ের জামা খুলে অন্যকে দান করে কিশোর শেখ মুজিব মানবতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেন। নদী, খাল-বিলের ধার ঘেঁষে তিনি ঘুরে বেড়াতেন মুগ্ধমনে! মূলত: তার শৈশব কেটেছে মেঠোপথের ধুলোবালি গায়ে মেখে আর বর্ষা ও বৃষ্টির কাদাজলে গা ভিজিয়ে। শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন পরোপকারী ও অন্যায়ের প্রতিবাদী। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখলেই তিঁনি যেমন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, তেমনি কোনো অন্যায় অবিচার দেখলেই প্রতিবাদ করতেন। তেরো বছর বয়সেই তিনি প্রতিবাদের যে উজ্জ্বল দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করেছেন, তা তার নেতৃত্ব ও দূরদর্শীতার ইঙ্গিত লক্ষ করা যায়। ওই সময়ে গোপালগঞ্জে স্বদেশী আন্দোলনের এক জনসভায় জনতার ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ দেখে বিক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়ে ওঠেছিলেন কিশোর শেখ মুজিব। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তিঁনিও যোগ দিয়েছিলেন। পুলিশ ফাঁড়িতে কিশোর শেখ মুজিবের ইট-পাটকেল নিক্ষেপের সাহসিকতা দেখে থানার পুলিশের বড় অফিসার রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিলেন।
টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ির কাছারি ঘরের পন্ডিত মশাই ও মৌলবিগণের কাছেই ছোট্ট বঙ্গবন্ধুর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। বিশেষ করে শেখ পরিবারের গৃহশিক্ষক মৌলবি সাখাওয়াৎ উল্লাহ্র হাতেই শিশু বঙ্গবন্ধুর পড়াশোনার হাতেখড়ি।
গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯২৭ সালে বঙ্গবন্ধুর একাডেমিক পড়াশোনা শুরু হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল সাত। ১৯৩১ সালে বঙ্গবন্ধুর বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তাদার, অর্থাৎ হিসাব রক্ষক। তাঁর কর্মস্থল ছিল গোপালগঞ্জে। স্বপরিবারে তার কর্মস্থল গোপালগঞ্জে চলে আসায়, খোকাকে ভর্তি করানো হয়েছিল গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে, চতুর্থ শ্রেণিতে। চৌদ্দ বছর বয়সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন হঠাৎ খোকা আক্রান্ত হয়ে পড়েন বেরিবেরি রোগে। এই বেরিবেরি রোগ থেকেই বঙ্গবন্ধুর চোখে ‘গ্লুকুমা’ নামক জটির রোগের সৃষ্টি হয়। বাবা লুৎফর রহমান অস্থির হয়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চোখের অপারেশনের মাধ্যমে সুস্থ হলেও ডাক্তার তাকে নিয়মিত চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। চক্ষু সমস্যার কারণে দু বছর তাঁর পড়াশোনা বন্ধ ছিল; সুস্থ হবার পর তিঁনি পুনরায় স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু যখন মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশনারি হাই স্কুলের ছাত্র তখন থেকেই একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। মুজিব যখন নবম শ্রেণির ছাত্র ওই সময়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেয়ার সময় মিথ্যা অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হলেও ছাত্রদের প্রচন্ড চাপের মুখে পড়ে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ওই সময়ে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ ওই সময়ের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গিয়েছিলেন স্কুল পরিদর্শন করতে। তখন শেরেবাংলার সামনে দাঁড়িয়ে সকল ছাত্রদের পক্ষে স্কুলের ভাঙা ছাদ মেরামতের দাবি উত্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে ওই দাবি পুরণ করতে বাধ্য হয়।
শৈশব থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল- বাংলার স্বাধীনতা, বাঙালির অধিকার ও জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালি বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক এই আদর্শ চেতনায়ই বঙ্গবন্ধু বড় হয়ে ওঠেন।
তৎকালীন সমাজ জীবনের জমিদার, তালুকদার ও মহাজন কর্তৃক প্রজাদের ওপর অত্যাচার, অবিচার, শোষণ-প্রেষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন দেখে কিশোর শেখ মুজিব ব্যথিত হয়ে ওঠতেন। শৈশব থেকেই মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম ভালোবাসার অনন্য গুণ তাঁর চরিত্রে ছিল সুস্পষ্ট; শীতার্ত মানুষকে দেখে তাদের গায়ে নিজের চাদর খুলে পরিয়ে দেয়া, স্কুলে বৃষ্টিভেজা বন্ধুকে দেখে নিজের ছাতা দিয়ে দেয়া এমনকি গ্রামের দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষকে ডেকে এনে বাবার গোলা থেকে ধান-চাল বিলিয়ে দেয়ার যে মানবিকতার দৃষ্টান্ত তিঁনি রেখে গেছেন; তা বাঙালি শিশু-কিশোরদের জন্য মানবিক শিক্ষার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে।
প্রতিবেশী দরিদ্র, অসহায় ও দুখি মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে আজীবন সাধারণ মানুষের আন্তর্নিহীত ভালোবাসায় সিক্ত করেছে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। গ্রামের হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস এবং সামাজিক আবহ থেকে কিশোর শেখ মুজিব অসম্প্রদায়িকতার দীক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে এশটি অসম্প্রদায়িক রাস্ট্র গঠনের চেষ্টায় মরণপণ লড়াই করে গেছেন।
১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে শেখ মুজিব কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর কক্ষে অবস্থান করে পড়াশোনা করতেন। এখান থেকেই ১৯৪৪ সালে শেখ মুজিব আই.এ এবং ১৯৪৭ সালে বি.এ পাশ করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসে মোগলটুলির কর্মীক্যাম্পে অবস্থান করেন। বাবার ইচ্ছানুযায়ী আইনজীবি হওয়ার লক্ষে ১৯৪৭ সালের শেষদিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই অভিযোগে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুনরায় পড়াশোনার সুযোগ দিতে রাজি এই শর্তে যে, ভবিষতে ভালো হয়ে চলার ‘বন্ড’ স্বাক্ষর করা এবং পনেরো টাকা জরিমানা প্রদানের বিনিময়ে। কিন্তু তিঁনি কোনোটিই করতে রাজি হননি; বহিস্কৃত হওয়ার পর তিঁনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫২ সালের শেষ সময় পর্যন্ত বন্দিজীবন অতিবাহিত করেন।
মহান ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সকল আন্দোলনেই তিঁনি অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন।
টুঙ্গিপাড়ার ওই দুরন্ত কিশোর বালক খোকাই একসময় তার দূরদর্শীতা, অসীম সাহস ও মানুষের অন্তর্নিহিত ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বাঙালির মুক্তির দিশারী হিসেবে আবির্ভূত হন বাঙালির মেঘবিষণ্ণ আকাশে। টুঙ্গিপাড়ার সেই দুরন্ত কিশোর শেখ মুজিব অবশেষে এসে কেবল টুঙ্গিপাড়ায়ই সীমাবদ্ধ থাকেননি, পরিণত বয়সে তিনি হয়ে ওঠেন গোটা বাংলা, ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত গণমানুষের নেতা, স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীনতার স্থপতি এবং বাঙালি জাতির জনক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
Parthoprotim Ghosh pritom ১৬ মার্চ, ২০২১, ৮:৩৩ পিএম says : 0
ভালো
Total Reply(0)
Sanjidul islam sanju ১৭ মার্চ, ২০২১, ৩:৪৫ পিএম says : 3
একটি ভুল রয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, ১৯৪৭ এর শেষের দিকে। কিন্তু এখানে দেওয়া ১৯৭৪ সাল। যেটি, কোনো ভাবেই সম্ভব নয়।উপরিউক্ত ভুলটি শুদ্ধ করে দেওয়া উচিত বলে মনে করছি।
Total Reply(0)
Md Rafsan ৭ মার্চ, ২০২২, ৯:৪২ এএম says : 0
Ami apnar opor sontosto
Total Reply(0)
জয় ১১ আগস্ট, ২০২২, ১:৫৯ পিএম says : 0
১৫ই আগস্টের জন্য একটি বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা রচনা চাই
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন