শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মার্চের স্মৃতি এবং একজন রাজনৈতিক কর্মীর আত্মোপলব্ধি

মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকায়, একটা সুনির্দিষ্ট নিউজ-আইটেম থাকে এই মর্মে যে, ‘আজকের দিনে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা’। অনুরূপভাবে, এই মার্চ মাসে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে, দেশে দেশে কী কী হয়েছিল যেকোনো আগ্রহী পাঠক পত্রিকা মারফত বা ইন্টারনেট থেকে জানতে পারবেন। ব্যক্তিগতভাবে এবং বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে মার্চ মাস ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম মহানগরী লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস হয়েছিল। প্রস্তাবের উপস্থাপক ছিলেন তৎকালীন বাংলার অন্যতম রাজনৈতিক মহানায়ক শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। ১৯৪৭-এর মার্চ রাজনৈতিকভাবে উত্তাল ছিল; ব্রিটিশরা যাবে তো বটেই, কোন দিন যাবে সেটিই ছিল বিবেচ্য বিষয়। ১৯৭১-এর মার্চ অনেক ঘটনায় উত্তাল। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ বাঙালি জাতিকে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার পথে প্রথম পদক্ষেপ নেয়ার জন্য। ১৯ মার্চ ১৯৭১ আজকের গাজীপুর জেলার সদর দফতরে (তথা তৎকালীন ঢাকা জেলার জয়দেবপুর থানার সদরে ভাওয়াল রাজাদের রাজবাড়ির মাঠে এবং নিকটস্থ জয়দেবপুর বাজার রেলক্রসিং-এ), দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং জয়দেবপুরের সংগ্রামী জনগণ একাত্ম হয়ে, পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার সাত দিন আগেই জয়দেবপুরের জনগণ এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জন্য মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল ১৯ মার্চ ১৯৭১ থেকে। এই মার্চ মাসেই আমাদের স্বাধীনতা দিবস। ২৫ মার্চ রাত ১২টার অল্প কয়েক মিনিট পর তথা ২৬ মার্চের প্রথম ঘণ্টার প্রথম অংশের ঘটনা। চট্টগ্রাম মহানগরের প্রায় কেন্দ্রস্থলের একটি জায়গার নাম ষোলোশহর। এখানে আবাসিত অষ্টম বেঙ্গলের সৈনিকদেরকেসহ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করত মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন মেজর জিয়াউর রহমান। ২৭ মার্চ ১৯৭১ তখনকার আমলের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে, প্রথমে নিজের নামে, দ্বিতীয়বারে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কানে যায়। ৭ মার্চের ভাষণ এবং ২৭ মার্চের ঘোষণা পরস্পরের পরিপূরক। তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বর্তমান প্রজন্মের কাছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম হিসেবেই সমধিক পরিচিত ও প্রিয়।

আমার জীবনেও মার্চ মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৮ সালের মার্চে আমি ছিলাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর কলা বিভাগের ছাত্র, এক মাস পর এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত এবং পরীক্ষা শেষে ক্যাডেট কলেজের ছয় বছর জীবন শেষ করে কঠিন শীতল পৃথিবীতে প্রবেশ করব সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন। ১৯৬৯ সালের মার্চে আমি ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথমবর্ষের (বর্তমানের) সূর্যসেন হলের একজন আবাসিক ছাত্র। ১৯৭০ সালের মার্চে ছিলাম পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুল-এর ‘২৪তম ওয়ার কোর্স’-এর একজন জেন্টলম্যান ক্যাডেট বা প্রশিক্ষণার্থী। ১৯৭১-এর মার্চ মাসে আমি ছিলাম দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে (সংক্ষেপে : সেকেন্ড বেঙ্গল) কর্মরত কনিষ্ঠতম অফিসার তথা কনিষ্ঠতম বাঙালি অফিসার। সেকেন্ড বেঙ্গলের অবস্থান বা আবাস ছিল ঢাকা মহানগর থেকে ২০-২১ মাইল উত্তরে অবস্থিত জয়দেবপুর নামক একটি গ্রামে। ইতিহাসখ্যাত ভাওয়াল রাজাদের যেই রাজপ্রাসাদ, সেটিতেই সেকেন্ড বেঙ্গল থাকত।

জীবনের ৭১ বছর বয়সে, ২০২০ সালের মার্চকে স্বাগত জানাচ্ছি। দেশ ও জাতি একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। ইতিহাস চর্চা হবে, ঘটনাবলির পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন হবে। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আলাপচারিতা হবে, আশা বা হতাশা উভয় প্রকারের অনুভূতিই ব্যক্ত হবে। অনেকেই আতঙ্ক বা অনিশ্চয়তার অনুভূতি নিয়ে উদ্বেগে দিন কাটাবেন। আমার অনুভূতি হলো এই যে, দিন কারো জন্য থেমে থাকে না। ইতিহাসে কোনো যতি চিহ্ন (বাংলায় দাড়ি বা ইংরেজিতে ফুলস্টপ) নেই। কোনো পরিবারে যদি পিতা বা মাতা মারা যায়, সন্তানরা যারপরনাই কান্নাকাটি করেন, অশ্রুসিক্ত নয়নে সুউচ্চ কণ্ঠের রোদনে পিতা বা মাতাকে কবরে শায়িত করেন, মাটিচাপা দেন, তাৎক্ষণিক সম্মিলিত মুনাজাতে অংশ নেন, অতঃপর বাড়িতে আসেন। বিষণ্ণ চিত্তে ক্লান্ত বদনে খেতে বসেন। ঘুম না এলেও রাতে ঘুমাতে যান। পরের দিন পৃথিবীর নিয়মেই দিন শুরু হয়। অন্য আরেকটি উদাহরণ দিই। ৯ মাস গর্ভধারণের পর কোনো দিন প্রত্যুষে কোনো একজন মহিলা যখন সন্তান প্রসব করেন, ওই মহিলার আনন্দ পৃথিবীর অন্য সবার আনন্দ থেকে ভিন্ন মাত্রার। সেই শিশু পরের দিন প্রত্যুষেই এক দিনের পুরনো হয়ে যায়। হাসপাতালে যদি সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে শিশুটির জন্ম হয়ে থাকে, তাহলে চার দিনের মাথাতেই রোগীকে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক প্রস্তুত হতে হয়। সামর্থ্য থাক বা না থাক হাসপাতালের খরচ মিটাতে হয়। শিশু পাওয়ার আনন্দ যেমন সত্য, হাসপাতালের বিল দেয়ার জন্য দরিদ্র পরিবারকে গয়না বিক্রি করতে হয়, এটাও সত্য। তাই আনন্দে বা বেদনায় কোনো দিনই সীমা লঙ্ঘন করতে নেই। বিশেষত মন্দ কাজে সীমা লঙ্ঘন করা মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে সর্ব অবস্থাতেই অপছন্দনীয়।

২০২০ সালের মার্চ মাসে এসে, মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের একজন মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে, অতীত নিয়ে স্মৃতিচারণ করাটাই স্বাভাবিক। না করাটা অস্বাভাবিক। তবে শুধু স্মৃতিচারণেই নির্ভরশীল হয়ে বসে থাকা বা স্মৃতিচারণ নিয়ে ব্যস্ত থাকাটা মোটেই কাম্য নয়। তাই ন্যূনতম শব্দে ৪৯ বছর আগের মার্চ মাস এবং আজকের মার্চ মাসের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করলাম এই কলামের মধ্যে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা, রচনা হয়েছিল তাদের সামরিক বাহিনী কর্তৃক। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র পরোক্ষ মনস্তাত্তি¡ক ও সাংস্কৃতিক আক্রমণের শিকার ছিল বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত নামক রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের দু’টি প্রদেশের মধ্যে সম্পদ বণ্টন ও উন্নয়ন কর্ম বাস্তবায়নে ন্যায্যতা ছিল না। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ভাষাগত আঙ্গিকে, অর্থনৈতিক আঙ্গিকে, মানবিক মূল্যায়নের আঙ্গিকে ছিল বঞ্চিত, অবমূল্যায়িত এবং নিপীড়িত। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ ছিল অতি সঙ্কীর্ণ। এরূপ পরিবেশের বা পরিস্থিতির পরিবর্তনের লক্ষ্যে মধ্য ষাটের দশকের বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংগ্রাম করছিলেন। সেই সংগ্রামের পুরোধা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একপর্যায়ে ১৯৭০ সালের শেষে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ থেকেও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী, গণতন্ত্রের রেওয়াজ অনুযায়ী, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনভার যাওয়া উচিত ছিল নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের হাতে এবং সেই জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিল আওয়ামী লীগ; কিন্তু যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে অবমূল্যায়ন করত, তাই তারা নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদকে কার্যকর হতে দেয়নি। অর্থাৎ, ১৯৭১-এর মার্চ মাসে তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল; জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ কর্তৃক দেশ শাসনের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। বাঙালি জনগণের সামনে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটাই মাত্র রাস্তা খোলা ছিল। যথা: সশস্ত্র সংগ্রাম। বাঙালি জাতি তাই করেছিল। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিম অংশে, পূর্ব অংশে এবং অন্যত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে আলাদা আলাদা স্বাধীন দেশ হবে; কিন্তু ১৯৪৬ সালে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সেই প্রস্তাবনা সংশোধিত হয়েছিল। ফলে একটি পাকিস্তান হয়েছিল, যার মাঝখানে ছিল বিশাল ভারত। ১৯৭১-এ এসে সেই ১৯৪০ সালের কল্পনাটি হুবহু বাস্তবায়ন না হলেও আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয় মার্চে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। তাই মার্চ মাস আসলে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ইবরাহিম স্মৃতিকাতর হতেই পারে। কিন্তু ১৯৭১-এর মার্চে প্রধানতম চেতনা ছিল গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার। ২০২০ সালে এসে সেই চেতনার কত কাছে অথবা কত দূরের অবস্থানে আছি, সেই বিশ্লেষণ করার আহবান আমি সম্মানিত পাঠক সম্প্রদায়ের কাছে রাখছি।

গণতান্ত্রিক চেতনা বা গণতন্ত্রের চর্চা বলতে শুধু ভোট দেয়ার অধিকারকে বোঝায় না। আদর্শ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য এক দিকে প্রয়োজন সচেতন নাগরিক সমাজ বা ভোটার সম্প্রদায় এবং অপর দিকে প্রয়োজন বিবেকবান শিক্ষিত নেতৃত্ব। আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বহাল রাখার জন্য প্রয়োজন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, দলীয় প্রভাবমুক্ত বিচার বিভাগ এবং প্রশিক্ষিত বিচার বিভাগ। কোনো একটি রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি সমর্থন থাকা এক বিষয় আবার ওই আদর্শ বাস্তবায়নের রাজনৈতিক কর্মী হওয়া আরেক বিষয়। বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক কর্মী মুক্ত রাখাটা একান্ত কাম্য, আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশের স্বার্থে। আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের পারস্পরিক সম্মানবোধ ও পারস্পরিক মূল্যায়ন অতি গুরুত্বপূর্ণ। আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য একটি ভারসাম্যমূলক সাংবিধানিক ক্ষমতার বিন্যাস গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রয়োজনীয়। আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য কোনো একজন ব্যক্তিকে বা নেতাকে অপরিহার্য (ইংরেজি পরিভাষায় ইনডিসপেনসিবল) মনে করা ক্ষতিকর ও অগণতান্ত্রিক। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা পেরেছিলেন বলতে যে আমি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হবো না; ফিলিপাইনের কোরাজন অ্যাকুইনো বলতে পেরেছিলেন, আমি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হব না; মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ অথবা সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ পারেন, সক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও ক্ষমতা ছেড়ে দিতে। এরূপ না বা হ্যাঁ বলার জন্য সাহসী বিবেক, অহংবোধ বিবর্জিত চিন্তা এবং দেশপ্রেমিক ভাবনা লাগে। আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীন মতপ্রকাশে আগ্রহী ও সক্ষম মিডিয়া প্রয়োজন। আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশেই গণতন্ত্র নিরাপদ থাকে। অপর ভাষায় বলতে গেলে গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য আদর্শ পরিবেশ প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক পরিবেশকে আদর্শ অবস্থায় রাখতে গেলে, অবশ্যই সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণকে সাহস নিয়ে অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হয়; অপর ভাষায় সৎ ব্যক্তিগণ যদি সাহসী না হয়, তাহলে অসৎ ব্যক্তিদের সাহস প্রাধান্য পায়।

২০২০ সালে বাংলাদেশে সেই পরিবেশ নেই। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও তাদের দেশের ভেতরের ও বাইরের বন্ধুপ্রতিম রাজনৈতিক শক্তি অতি সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকারি ক্ষমতার বাইরের রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের দূরদৃষ্টির সীমাবদ্ধতার কারণে, ক্ষমতাসীনদের পথকে মসৃণ করেছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনো ভারসাম্য নেই। এরূপ ভারসাম্যহীন রাজনৈতিক অঙ্গন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ক্ষতিকর, বাংলাদেশের বৃহৎ মাপের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য ক্ষতিকর, আগামী দিনের বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর, আগামী প্রজন্মের বাংলাদেশিদের জন্য ক্ষতিকর। ভারসাম্যহীন রাজনীতি কুপ্রভাবের জ্বলন্ত উদাহরণ অনেক দেশেই আছে- যথা লিবিয়া, কঙ্গো, সুদান (বা উত্তর সুদান) এবং আংশিকভাবে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ইরাক, রোমানিয়া। বাংলাদেশে এই ভারসাম্যহীন রাজনীতির ক্ষতি থেকে উদ্ভূত দায় রাজনৈতিক সহায়ক শক্তিগুলোকেও নিতে হবে যারা জেনে বুঝে বা না জেনে না বুঝে, ব্যক্তিস্বার্থে বা গোষ্ঠিস্বার্থে এই ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টিতে ‘অবদান’ রেখেছেন। এই ক্ষতির দায় সমসাময়িক সব রাজনৈতিক শক্তিকে ও নেতৃত্বকে গ্রহণ করতে হবে। আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এ দায় আমার কাঁধেও বর্তাবে। কেউ দায়ী হবেন: ক্ষমতালিপ্সার জন্য, সম্পদের প্রতি অতি লোভের জন্য, জনগণ কর্তৃক অর্পিত বিশ্বাস ভঙ্গের জন্য, প্রতিহিংসার রাজনীতি চালু করার জন্য, দেশের সীমানা পার হয়ে ভিন দেশের প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শনের জন্য। কেউ দায়ী হবেন: নির্লিপ্ততার জন্য, জনসচেতনতাকে অবমূল্যায়ন করার জন্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অদূরদর্শিতার জন্য, অত্যাচারীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধহীনতার জন্য। কেউ দায়ী হবেন: সুবিধাবাদিতার জন্য, নিরপেক্ষতার নামে অন্যায় ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়ার জন্য, জনগণের কাছ থেকে সত্যকে গোপন রাখার জন্য। অনেকেই দায়ী হবেন: দেশবিরোধী পরিকল্পনার জন্য, অর্থনৈতিক লুটপাটে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এবং বহির্বিশ্বে তথা পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে একপেশে করা জন্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ভারসাম্যহীনতা দূর করতে বিচক্ষণ, সংগ্রামী বিবিধমুখী অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতৃত্ব প্রয়োজন। সেই সম্ভাব্য নেতৃত্ব অনেক দূরেও নয়, অনেক কাছেও নয়। সেই সম্ভাব্য নেতৃত্ব রাজনীতি, সমাজ, ব্যবসাবাণিজ্য সব জায়গাতেই আছে; কিন্তু সমন্বয়ের অভাব, সুযোগের অভাব, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াগত সীমাবদ্ধতার কারণে তারা অসংগঠিত। এসব নেতৃত্বকে নিজ নিজ পেশাগত ক্ষেত্রের বাইরে একটি সমন্বিত রাজনৈতিক ধারায় আনতে হবে। এই অভিজ্ঞতাগুলো অতি পরিচিতও নয়, আবার একদম অপরিচিতও নয়। এমন একটি প্রক্রিয়া প্রয়োজন, যার মাধ্যমে বর্তমান ও আগামী দিনের প্রজন্ম থেকে বাংলাদেশের জন্য নতুন নেতৃত্ব পরিচর্যা পাবে, পুষ্টি পাবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক: চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
নূরুল্লাহ ১৪ মার্চ, ২০২০, ২:৪৬ পিএম says : 0
বেদনার কথামালা, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞ বোধির মূল্যায়ন হোক, পাঠকমাত্র আশাবাদী।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন