যে সতর্কতা সরকারের দায়িত্বে পড়ে, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় ও প্রশাসনের নানা বিভাগ যে কাজটি সাধারণত করে থাকে সে প্রস্তুতি বা ভ‚মিকা আমাদের দেশে কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন করাই যেতে পারে। মাত্র ৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও আল্লাহর রহমতে এ মুহূর্তে দেশ করোনামুক্ত। তিনজনই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পেরেছেন। প্রথম থেকেই বিমানবন্দরে যথেষ্ট থার্মাল স্ক্যানার ছিল না। ছয়টির মধ্যে পাঁচটিই ছিল অচল। একটি দিয়ে কোনোরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল পরীক্ষার কাজ। একদিন সেটিও অচল হয়ে যায়।
খবর বেরোয়, কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সহজ পদ্ধতি নিয়েছেন। বিদেশ থেকে এসে পাঁচশত টাকা দিলে তিনি জীবাণুমুক্ত। টাকা দিতে রাজি না হলে ১৪ দিনের জন্য জীবাণুমুক্তকরণ ক্যাম্পে আটকে রাখা হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি চাউর হয়ে গেলে ‘বৈজ্ঞানিক’ এ পদ্ধতি ব্যর্থ হয়। এরপর জানা গেছে, সামিট গ্রæপ বেশ কয়েকটি স্ক্যানার দান করেছে। এদেশে টাকা ছাড়া ঝরা পাতাটাও ওড়ে না। আবার টাকা দিলে শুধু বাঘের চোখ নয়, করোনা থেকেও মুক্তির সনদ পাওয়া যায়।
মন্ত্রণালয় ও প্রশাসন আলাদা বাজেট না পেলে নিঃশ্বাসটিও ফেলতে পারে না। শোনা যাচ্ছে, এক মন্ত্রণালয় করোনা পারপাসে ১০০ কোটি টাকা পেয়েছে। আরেক বিভাগ ৫০ কোটি টাকা চেয়েছে। নানা ছুঁতোয় বড়রাও চাঁদা কালেকশন শুরু করবেন। কাজের কাজ কী হবে আল্লাহই ভালো জানেন। তবে, টাকা হয়তো জনগণের গাঁট থেকে খসানোই হবে। কাজ কতটুকু হবে তা নিয়ে জনগণের মনে সন্দেহ ষোলআনা। এক রসিক লোক বললেন, আল্লাহর রহমতে সারা দুনিয়া কাঁপা শুরু হলেও গরিবের এই দেশে করোনার থাবা যথেষ্ট দুর্বল। যেটুকু বাতাস লেগেছে তা বহিরাগত। নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। করা গেছে বলার চেয়ে আল্লাহ করে দিয়েছেন বলাই সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত। কারণ, মুখে বড় বড় কথা ছাড়া আমরা যে খুব বেশি একটা কিছু করতে পারি না তা ডেঙ্গুর সময়ে বোঝা গেছে। বিপদের তিন মাস ওষুধ আনাই সম্ভব হয়নি কর্তৃপক্ষের।
বলছিলাম রসিক লোকের কথা, তার মূল কথাটি হলো, এবারকার করোনা বাংলাদেশে আল্লাহর রহমতে এখনো সবল হয়নি। তবে এখানে ভাইরাসের রূপটি ভিন্ন। এই করোনা রোগীকে হত্যার চেয়ে গায়েব করে দেয় বেশি। তার দৃষ্টিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের দুই মেয়রকে নাকি করোনায় গায়েব করে দিয়েছে। একথা শুনে আমরা অবশ্য বলেছি, এমন অলক্ষুণে কথা না বলাই ভালো। আল্লাহর রহমতে তারা সুস্থ আছেন, ভালো আছেন। সময়ে ভূমিকাও নেবেন। ভয় হচ্ছে, করোনা আক্রান্ত কিছু নেতা-মন্ত্রী, আমলা, বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে। তারা এমন কিছু তৈলাক্ত কথাবার্তা বলছেন, যা জনগণকে হাসাচ্ছে না কাঁদাচ্ছে সে বিষয়ে তারা ভাবছেন না।
একজন বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী আছেন বলেই করোনা কিছু করতে পারছে না। আমার মনে হয়, এ ধরনের তৈলাক্ত কথাবার্তায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও খুবই বিরক্তবোধ করেন। এই মুহূর্তে এমন রাজনীতি ও তেলনীতি বাদ দিয়ে হয়তো তারা নিরব থাকুন অথবা আল্লাহর সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করুন। বাজে কথা বলে শব্দ ও পরিবেশ দূষণ করবেন না।
যে বিদেশী বলেছিলেন, বাংলাদেশে এসেই আমি নাস্তিকতা ছেড়ে আল্লাহতে বিশ্বাসী হয়েছি। এ দেশটি যে চলছে তাতেই প্রমাণ হয়, আল্লাহ একজন আছেন। এ কথাটি নাস্তিকের জন্য এক হিসেবে ঠিক আছে, তবে আমরা যারা ঈমানদার মুসলমান তারা সবকিছু দেখেই আল্লাহর অস্তিত্ব ও কুদরতের প্রমাণ পাই। চীন বিশাল বিপর্যয়, কঠিন সংগ্রাম ও সংশোধনের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠেছে প্রায়। লাখো রোগীর মধ্য থেকে সর্বশেষ সাতজন এখন আক্রান্ত আছে। সারাদেশ নিয়ম মেনে সর্বশেষ উহান প্রদেশে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট গিয়ে পৌঁছার মতো পরিবেশ তৈরি করেছেন তারা। একশভাগ রোবট দিয়ে হাসপাতাল চালাচ্ছে। এখন ঘোষণা দিয়েছে, সব অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল হবে। চীন থেকে আর বিপদ বাইরে যাবে না। বরং অন্য যে কটি দেশ আক্রান্ত সেখানকার লোক যাতে চীনে ঢুকতে না পারে সে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে অনেক অগ্রসর দেশ এখন বিপদ মোকাবেলায় ব্যস্ত। ইতালিতে সব জনগণ কোয়ারেন্টাইনে। অর্থাৎ সারাদেশই স্বেচ্ছাবন্দি। প্রতিদিন গড়ে দু’শ করে মরছে মানুষ। বিশ্বের বড় বড় নেতা আশঙ্কা ও ছোঁয়ায় আক্রান্ত। ঘরে বসে রাষ্ট্র চালাচ্ছেন তারা। অনেক দেশ ধর্মকর্ম বাড়িয়ে দিয়েছে। ইউরোপের মানুষ যারা এতদিন অধার্মিক জীবন কাটাতো তারা গির্জামুখী হচ্ছে। আমেরিকায়ও রেড এলার্ট। কাজকর্ম বন্ধ। পৃথিবীর বহু দেশে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি। গণসমাবেশ বন্ধ। বড় সুপার মার্কেট ও পাবলিক প্লেস জনশূন্য। কিছু আরব দেশ জুমার নামাজও সীমিত করে দিচ্ছে। সময় বেঁধে দিচ্ছে ১৫ মিনিটে সব সারতে হবে। কুয়েতে আজানের মধ্যে ঘোষণা হচ্ছে, নামাজ ঘরেই পড়–ন। এটি এক ধরনের বাড়াবাড়ি। সতর্কতা ও পরিচ্ছন্নতা জরুরি। তবে, আল্লাহমুখী হওয়া আরো বেশি জরুরি। ইবাদত-বন্দেগী, দোয়া-দরূদ বাড়াতে হবে। সাবধানতা ও স্বাস্থ্যনীতি মেনে চলা আর মানুষের বিপদ মুহূর্তের ইবাদত-বন্দেগী কমিয়ে দেয়া এককথা নয়।
বাংলাদেশে আল-হামদু লিল্লাহ সবচেয়ে প্রশংসনীয় ভ‚মিকা রাখছেন মসজিদের ইমাম, খতিব ও আলেমগণ। শুরু থেকেই তারা মানুষকে বোঝাচ্ছেন, আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না। মহামারি বা ব্যাপক রোগ-বালাই সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা তারা জাতিকে জানান দিচ্ছেন। মহানবী সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সম্পর্কে মানব জাাতিকে যা বলেছেন, সেসব কথা ও দোয়া তারা মানুষকে শিক্ষা দিচ্ছেন। প্রতিটি মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নিয়মিত নামাজ হচ্ছে। জুমার বয়ানে খুতবা ও দোয়ায় এ বিষয়টিই ছিল প্রধান আলোচ্য। রাজধানীর অনেক মসজিদে ওযুখানায় কর্তৃপক্ষ কিংবা এলাকাবাসী সাবানের ব্যবস্থা করেছেন। বিনে পয়সায় টিস্যু, রুমাল সরবরাহ করছেন।
এসব নতুন কথা নয়, সারাদেশের প্রায় পাঁচ লাখ মসজিদে প্রায় প্রতি জুমা, বয়ান, তালিম ও তাফসিরে এসব বলাই হয়। করোনার জন্য বিজ্ঞানীরা এখন যেসব সতর্কতার কথা শোনাচ্ছেন, ইসলাম দেড় হাজার বছর ধরেই মানব জাতিকে সেসব শিখিয়েছে। পাঁচবার ভালো করে ওযু করা, পারলে সারাক্ষণই ওযু অবস্থায় থাকা, বার বার দুই হাত উত্তমরূপে ধোয়া, কুলি করা, গড়গড়া করা, নাকে পানি দেয়া, দুই হাত কনুই পর্যন্ত ধোয়া, মাথা মাসেহ করা, পা ধোয়া এসবই মুসলমানের দৈনন্দিন কাজ। হালাল খাদ্য গ্রহণ, আল্লাহ প্রদত্ত নিয়মে পশু জবাই করা, স্বাস্থ্যসম্মত পরিচ্ছন্নতা বিধান, পঁচা-বাসি ক্ষতিকর খাবার না খাওয়া, খাওয়ার মধ্যে মেহমানকে শরিক করা, পরিবার-পরিজনকে সযত্মে খানায় শামিল রাখা, একসাথে বসে সুন্নাহসম্মতভাবে খানা খাওয়া, খাওয়ার আগে দুই হাত উত্তমরূপে ধোয়া, এতিম-বিধবা, অতি বৃদ্ধ, অথর্ব লোকদের খানা দেয়া, অসহায় মুসাফির ও অভাবী মানুষকে আন্তরিকভাবে খানা খাওয়ানো ইত্যাদি ব্যবহারিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে পূর্ণ খেয়াল রাখার কারণে মুসলমানরা নানা রোগব্যাধি ও বালা-মুসিবত থেকে নিরাপদ থাকে।
নারীদের হিজাব ও নেকাব পরা তাদের চিরস্থায়ী প্রটেকশন ব্যবস্থা। হাঁচি হাত বা রুমাল দিয়ে আড়াল করা। জনসম্মুখে হাই না তোলা, হাই উঠলে হাতের পিঠ দিয়ে তা আড়াল করা। মানুষের চলাচলের পথে পেশাব-পায়খানা তো দূরের কথা, কফ-থুথু, কাগজ, ময়লা বা অন্যান্য কষ্টদায়ক বস্তু না ফেলা। পড়ে থাকলে তা দূর করা- এসব ইসলামের মৌলিক হুকুম, ঈমানের অঙ্গ।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী গণমাধ্যম হচ্ছে মসজিদ ও মাহফিলের প্ল্যাটফরম। মানুষকে ইফেক্টিভ সচেতনতা দানে ইমাম ও আলেমগণের কোনো বিকল্প নেই। তাদের সেবা কোনোরূপ খরচ ছাড়াই সরকার পাচ্ছে। কৃতজ্ঞতা কিংবা স্বীকৃতি কতটুকু আছে তা মানুষ নিজেরাই ভেবে দেখুক। এ প্ল্যাটফরম থেকে দেশ ও জাতি যে সার্ভিসটুকু জীবনভর লাভ করছে তা ইসলামেরই সুফল। আল্লাহ ও রাসূল (স.)-এর নির্দেশনায় ধর্মীয় দায়িত্বশীলরা এ ধরনের কল্যাণকর বিশাল খিদমত দিয়ে যাচ্ছেন।
মুসলিম বিশ্বে অনেক সমস্যা। বহু দেশ এমনও আছে, যেখানে মৌলিক সুবিধাগুলো মানুষ পায় না। উন্নত দেশের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা নাই বললেই চলে। বহু দেশ এমনও আছে, যেখানে গত দশ-পনের বছর যাবত নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। বিমান হামলায় বিধ্বস্ত বহু ভবনের নিচে দাফন না হওয়া হাজার হাজার লাশও মুসলিম বিশ্বের নানা শহরে আছে। কিন্তু এ পর্যন্ত সেসব যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুর্ভিক্ষকবলিত, অপরিচ্ছন্ন, মানবেতর অঞ্চলে করোনা পৌঁছার খবর পাওয়া যায়নি। অতি সুরক্ষিত রাজপ্রাসাদ ও সভ্য উন্নত নগরীতে এ মুসিবত পৌঁছে গেছে। গোটা চীনে একজন মুসলমানও আক্রান্ত হয়নি। এটি দেখে দুনিয়ার মানুষ কিছু শিক্ষা নিবে কি?
আমাদের বাংলাদেশ এই সমস্যার কাছাকাছি অঞ্চল হয়েও যে বিশেষ কারণে বেশ নিরাপদ সেটি মানুষ অনুধাবন করবে কি? এক্ষেত্রে মসজিদের ভ‚মিকা যেমন বোঝা দরকার, মসজিদমুখী হওয়াও দরকার। বাংলাদেশে যে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সঙ্কটে আমরা সতের-আঠারো কোটি মানুষ জীবন কাটাই এখানে বাহাদুরি করার সুযোগ কম। কেউ বাগাড়ম্বর করে বড়াই করেন, এসব ঠিক না। আল্লাহর রহমতে মানুষ নিজেদের বিশ্বাস, এবাদত, ক্ষমাপ্রার্থনা, অনুশোচনা, দোয়া, মুনাজাত, কান্নাকাটি দিয়ে পরিবেশ বজায় রাখে, আল্লাহ রহমত করেন। এ অবস্থার ওপর আরো মজবুত থাকা দরকার। যারা এসব না মানেন, না বোঝেন, তাদের উচিত নিরব থাকা। বেফাঁস মন্তব্য ও বেয়াদবি না করা।
আল্লাহ যখন সর্বশক্তিমান তখন ক্ষমতা, টাকা-পয়সা, বুদ্ধি ও কৌশল কিছুই তার সামনে টিকে না। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। অন্তত বিশ্বব্যাপী বর্তমান ও চলমান করোনাভাইরাস আতঙ্ক থেকে এসব মাথামোটা লোকের শিক্ষা নেয়া উচিত। মসজিদে নামাজিদের উপস্থিতি এবং ঘরে ঘরে আল্লাহমুখী হওয়ার এ সুযোগ ঈমানদাররা নেয়ামতরূপে কাজে লাগান। মৃত্যু পূর্বনির্ধারিত। তওবা ও ঈমানের সাথে যে কোনো অছিলায় চলে যাওয়া দুঃখের কিছু নয়। বেঈমান হয়ে মহামারীতে মরাই চিরদুর্ভাগ্যের কারণ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন