জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশের এত বছরের পথচলা নেহাত কম সময় নয়। বিক্ষোভ, বিতৃষ্ণা, বিবমিষার স্যাতসেঁতে দগদগে ঘায়ে প্রতিনিয়ত সংক্রমিত হচ্ছে অবর্ণনীয় ত্যাগ, সাধনা, সংগ্রাম, কষ্ট-ক্লেশে অর্জিত আমাদের স্বাধীন ভূখন্ড। আমাদের রয়েছে অগণন রক্তাক্ত অতীত, স্মৃতি, আছে ইতিহাসের অনেকগুলো কালিমালিপ্ত অধ্যায়। ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও তৎপরবর্তী রাজনীতি জাতি হিসেবে আমাদের বিভক্তির দেয়ালকে অনতিক্রম্য উঁচু করে দিয়েছে। যারা সেদিন হত্যাকারী অপরাধী চক্রকে সংকটের ত্রাতায় পরিণত করার চেষ্টা করেছিল, ক্ষমতার চোখ রাঙিয়ে ইতিহাসকে রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছিল, ইতিহাসের পুনর্বয়ান, পুনর্লিখন ও পুনর্মূল্যায়নে তাদের মুখোশ আজ প্রায় উন্মোচিত। আমরা এখন জানি কাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে, কাদের পরোক্ষ মদদে এ জঘন্যতম, নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটেছিল। ইতিহাসের এ পর্বের কে মীর জাফর, কে মিরণ, কে সেনাপতি ইয়ার লতিফ- এ সত্য দিবালোকের মতো পরিষ্কার।
বেদনাবিধূর ও কলঙ্কের কালিমায় কলুষিত বিভীষিকাময় সেই ১৫ আগস্টে নরপিশাচ ঘাতক দল অদম্য রক্তপিপাসু। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান ১০ বছরের শিশু রাসেল, শিশু আরিফ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ রিন্টু কেউই তাদের বীভৎস ছোবল থেকে রেহাই পাননি। রেহাই পাননি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, আরজু মণি, বেবি সেরনিয়াবাতের মতো ঋজু, দৃঢ়, সাহসী, ক্রীড়ামোদী, সংস্কৃতিবান নারী। এখনও এখানে একুশে আগস্ট ঘটে। এখনও আইভি রহমানসহ অনেকের প্রাণের প্রদীপ নিভে যায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বর্বর হামলায়। এখনও অসংখ্য রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে থাকে মিছিলের সারি বিস্তৃত করে। এখনও বারুদ ঠাঁসা গ্রেনেড পিছু তাড়া করে ফেরে আমাদের রক্তমূল্যে অর্জিত গণতন্ত্রকে। বীরের বীরত্বগাঁথার পাশাপাশি বাংলার ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতারও। বারবার এখানে অবাঞ্ছিত সত্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। রক্তাক্ত অতীতের প্রতি এক ধরনের আচ্ছন্নতা সরকারে, বিরোধী দলে আমাদের সমঝোতার সেতু তৈরির প্রধান বাধা। আমাদের এখানকার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল, সেনা অরাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠে ভালো-মন্দের অবিমিশ্রিত কল্যাণকামী জাতীয় সংগঠন না হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানের সেনানায়কদের মতো নিষ্ঠুর নৃশংস ভিলেন থেকে গেছে। তাই এখানকার প্রতিযোগিতা, প্রতিরোধ নায়কে-নায়কে না হয়ে নায়কে-ভিলেনে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট থেকে ২০০৪-এর ২১ আগস্ট ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় একই সুতায় গাঁথা। অতীত কাতরতার এ রক্তাক্ত ট্র্যাজেডি কি ভোলা যায় অবলীলায়?
বঙ্গবন্ধুর শিশুতোষ সারল্য, বাংলার মানুষের প্রতি অগাধ আস্থা-বিশ্বাস, তার সব সুকৃতি, তার অসামান্য জনপ্রিয়তা, তার আদর্শের ধ্রুবতা, তার প্রশ্নাতীত সততা সত্তে¡ও বিংশ শতাব্দীর কৌটিল্য কূটবুদ্ধি তাকে বাসন্তীর জালে জড়িয়ে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত করে সিঁড়িতে গড়িয়ে দেয়। আর তিনি নদী, মাঠ-ক্ষেত ভালোবেসে আবার ফিরে আসেন, রয়ে যান সব ধানসিঁড়ি নদীর তীরে।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর পরই পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী শক্তি দেশ ও বিদেশে তৎপর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখায় আরব দেশগুলো বাংলাদেশের পক্ষে কোনো প্রকার সহানুভূতি দেখায়নি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সমাজতন্ত্রী দেশ সম্পর্কে যেসব দেশ ভিন্নমত পোষণ করত তারা প্রায় সবাই পাকিস্তানকে সমর্থন করে। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে সাহায্য করায় চীন তার মিত্র পাকিস্তানকে পুরো সমর্থন দেয়। জনসংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হলেও মুসলিম বিশ্বে তার অবস্থা ছিল চরমভাবে উপেক্ষিত। সেই মুসলিম বিশ্বের স্বীকৃতির সঙ্গে বিবদমান পক্ষ পাকিস্তানের স্বীকৃতি নিয়ে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার উদ্বেগে থাকা স্বাভাবিক। স্বাধীনতার পর পরই সব ভারতীয় সৈন্যের ফিরে যাওয়া এবং ’৭৪-এ বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তান সফরের পর পাকিস্তানের স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও ঐক্যবুদ্ধির পরিচয় দেয়। দীর্ঘমেয়াদি কৌশল এবং বাংলাদেশের জনগণের শান্তি ও স্বস্তির কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধুকে অনেক আপাত বিতর্কিত অথচ দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমরা কোনো উদ্যোগ বাদ দেইনি এবং সবশেষে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে ক্ষমা প্রদর্শন করিয়া আমরা চূড়ান্ত অবদান রাখিয়াছি। এ সকল যুদ্ধবন্দি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক অপরাধ করিয়াছে। ইহা হইতেছে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ও উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ শান্তি ও স্থায়িত্ব গড়িয়া তোলার পথে আমাদের অবদান। এ কাজ করিতে গিয়া আমরা কোনো পূর্বশর্তারোপ অথবা কোনো দরকষাকষি করিনি। আমরা কেবলমাত্র আমাদের জনগণের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের কল্পনায় প্রভাবিত হয়েছি। পাকিস্তানের স্বীকৃতির পরই বাংলাদেশ সম্পর্কে সউদী আরবসহ মুসলিম বিশ্ব এবং চীনের অবস্থান। নমনীয় হয়। দুটি রাষ্ট্রেরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলতে থাকে। যদিও এ দুটি রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রানুরাগী ছিলেন। নজরুল ছিলেন তার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্রোহের মডেল। জেল জীবনে তিনি প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তেন। গাইতেন : ‘নাই নাই ভয়/হবে হবে জয়’, ‘আমার সোনার বাংলা...’, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ জাতীয় গান। নজরুলের কারার ঐ লৌহ কপাট, ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে’ তাকে ব্যাপক আলোড়িত করত। তার রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রবিনির্মাণের সাধনা শুধু যে এসব কাব্যসঙ্গীত প্রেরণানির্ভর ছিল তা নয়; বাঙালির সেকুলার সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রসাধনা সম্পর্কে তিনি ছাত্রজীবনেই আলোড়িত হন। আকৃষ্ট হন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র যখন কুখ্যাত হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলন করেন, সেই আন্দোলনের অন্যতম সাহসী সৈনিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, ফকির মজুন শাহ, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীন, নূরল দিন, সূর্যসেন, চারণকবি মুকুন্দ দাশ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, আবুল হাশিম, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুও তার প্রেরণা ছিল। বংশ, বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিত্তের ওপর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকটা নির্ভর করে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে এসবের বিশেষ ভূমিকা ছিল না। বংশ এবং বিত্তে তিনি টুঙ্গিপাড়ার উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান নয়। সে সময়ের হিসেবে মধ্যবিত্ত। বুদ্ধির চেয়েও তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল বিস্ময়কর। একবার নাইজেরিয়ার জেনারেল ইয়াকুবু গাওয়ান বঙ্গবন্ধুকে বলেন, অবিভক্ত পাকিস্তান একটি শক্তিশালী দেশ, কেন আপনি দেশটাকে ভেঙে দিলেন। উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, “শুনুন মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনার কথাই হয়তো ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়তো শক্তিশালী ছিল, তার চেয়েও শক্তিশালী হয়তো হতো অবিভক্ত ভারত। কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হতে সংঘবদ্ধ এশিয়া। আর মহাশক্তিশালী হতো একজোট এ বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়?
বিদ্যার্জনে বঙ্গবন্ধু বারবার বাধা পান। অসুস্থতায় পাঠ বিরতির ফলে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন বিলম্বে। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে রাজনীতিতে জড়িয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য ও আবুল হাশিমের ভাবশিষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৪৭-এ ইংরেজ উপনিবেশ বিমুক্তি তথা দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু ভাষার অধিকারের সংগ্রামে সভা-সমিতি এবং শোভাযাত্রা-হরতাল সংগঠনের অভিযোগে ১৯৪৮ এর মার্চ ও সেপ্টেম্বরে দু’বার তাকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধস্তন কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে ১৯৪৯ সালে মার্চ মাসে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সে সময় কয়েকজন আন্দোলনকারী ভবিষ্যৎ সৎ আচরণের মুচলেকা দিয়ে তাদের বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করলেও বঙ্গবন্ধু কোনো মুচলেকা না দেওয়ায় তার বহিষ্কারাদেশ বহাল থাকে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক তৎপরতার কোনো বিরতি ছিল না। পাকিস্তান সরকারের ২৩ বছর শাসনকালে তাকে ১৮ বার কারাগারে বন্দি রাখা হয়। তার এ বন্দিত্বের সময়সীমা ১২ বছরেরও বেশি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তার প্রাণদন্ড হওয়ার কথা ছিল।
তবে আইয়ুব-ইয়াহিয়া যা পারেনি স্বাধীন বাংলাদেশে ঘাতক বাঙালিরাই তা সাধন করেছে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে। ভিক্টর হুগো বলেছেন, নতুন সময় নতুন চিন্তাকে অনিবার্য করে তোলে। তাই সবকিছুর পরও সব অবিশ্বাসসংশয়ের দেয়াল সরিয়ে আমাদের সমঝোতার পথে, ঐক্যবুদ্ধির পথে চলতে হবে। কেননা অপার ক্ষমাশীল বঙ্গবন্ধু সবকিছুর পরও এ পথেই চলতে চেয়েছেন। আলিঙ্গন করেছেন মৃত্যুকে। এখনও তিনি বাংলার দুর্জয় তারুণ্যের হিমালয়, দুর্যোগের অমানিশায় উজ্জ্বল বাতিঘর। যতদিন এ বাংলার চন্দ্র-সূর্য উদয় হবে ততদিন ভোরের শুকতারার মতোই বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বঙ্গবন্ধু আমাদের রোল মডেল। (সংকলিত)
লেখক: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন