বঙ্গবন্ধু সময় পেয়েছিলেন সাড়ে তিন বছরেরও কম। তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য দিনরাত্রি এক করে ফেলেছিলেন। সর্বক্ষণ চিন্তা ছিল কীভাবে বিধ্বস্ত দেশটাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে এমন একটা পর্যায়ে আনা যায়, যেখানে মানুষ দু’মুঠো খেয়ে বাঁচতে পারে এবং মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে বিশ্বসমাজে সমাদৃত হতে পারে। অদম্য সাহস নিয়ে শুরু করেছিলেন কর্মযজ্ঞ। এগিয়েও ছিলেন বহুদূর একেবারে পুরোপুরি একটা ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু শেষ করতে পারলেন না; বলা যায়, শেষ করতে দেয়া হলো না তাঁকে। সপরিবার তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া হলো একেবারে ঠান্ডা মাথায়। করলো তারা, যারা স্বাধীনতা চায়নি আর কুচক্রীদের সাহায্য করেছে তারা, যারা স্বাধীন বাংলাদেশকে গ্রহণ করতে পারেনি। দেশীয় আর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে দেশটাকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার প্রয়াস পেলো। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট স্তব্ধ হয়ে গেলো বাংলাদেশের এগিয়ে চলা। ক্ষমতা চলে গেলো সেনানিবাসে; শুরু হলো উন্নয়নের আকাশে উল্টো হাওয়া। খাল কেটে আনা হলো কুমির। উন্নয়ন আর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলে গেলো পাতালের অন্ধকারে। মুখ থুবড়ে পড়লো দেশের গণতন্ত্র। লাঞ্চিত হলো সংবিধান। সাম্প্রদায়িকতা চেপে বসলো বাংলার বুকে। সৃষ্টি হলো সারা দেশ জুড়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ। বঙ্গবন্ধুকে খুইয়ে জাতি হারালো একজন নিখাঁদ দেশপ্রেমী, দেশবাসীর মুক্তির অগ্রদূত আর জনমানুষের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর ভরসা।
অথচ বঙ্গবন্ধু কী না করেছেন দেশের জন্য? ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু তার স্বদেশভাবনা। যখন কলকাতায় ছিলেন তখনই তার মনে দানা বাঁধতে থাকতে একটি জাতি-রাষ্ট্রের ভাবনা, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। এই ভাবনার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সেই যে তার পথচলা তা শেষ হয়নি লক্ষ্যার্জন পর্যন্ত।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ২৫ দিন পর, হানাদারদের বন্দিখানার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে হাতে তুলে নেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের বিশাল চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনকালেও স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের মতো একটা বিশেষ গোষ্ঠি বিরোধিতা করতে থাকে, দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতায় লিপ্ত হয়, অরাজকতা সৃষ্টি করে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টায় ব্রতী হয়। কেউ তাদের পরিচয় দিতো ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কায়েমকারী হিসেবে, কেউ ছিল সর্বহারা, কেউ ছিল স্রফে ক্ষমতা দখলের ধান্ধায়। এমনতরো পরিস্থিতিতেও তিনি স্থৈর্য্য আর ধৈর্য্যে ছিলেন অটল। সব কিছু সামাল দেওয়ার সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কার এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডে। যখন চারদিকে শুধু নাই নাই আর তছনছ হয়ে যাওয়া প্রশাসনিক কাঠামো, তেমন অবস্থায় তিনি তাঁর মোহনীয় নেতৃত্বে সাহসিকতার সাথে কর্মদ্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একই সাথে রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক উদ্যোগও রাখেন অব্যাহত।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত সময়ে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে আর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশ পুনর্গঠনের এক কঠিন ও বহুমাত্রিক সংগ্রামে। অবিভক্ত ভারত বিভাগের পর নবসৃষ্ট পাকিস্তান (যার অংশ ছিল বাংলাদেশ, পূর্ব পাকিস্তান নামে) আমলে তিনি সেই যে কলকাতার বেকার হোস্টেলে থেকে শুরু করেছিলেন একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা, সেটি অব্যাহত ছিল স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশ আমলে যেভাবে শোষিত হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষ, তার চেয়েও অনেক বেশি আর বহুমাত্রিক শোষণের শিকার হচ্ছে পাকিস্তান আমলে। আর এও বুঝেছিলেন যে, প্রতিরোধ করা না হলে এরূপ শোষণ আরো বহুগুণ বেড়ে ভয়ঙ্কর রূপ নেবে ভবিষ্যতে। ত্রিকালদর্শী এ মহান নেতা অনুধাবন করেছিলেন, অতীতের মতো বর্তমানে সংঘটিত শোষণ-নিপীড়ন যদি অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে, তবে বাঙালির ভবিষ্যত হয়ে যাবে একেবারেই অরক্ষিত, এ জাতি সারাটা কাল বঞ্চিত জাতি হিসেবেই অন্যদের গোলামী করবে। তাই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা মাথায় রেখে বাঙালিদের জন্য একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছেন নিজের সব সুখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে। তিনি তাঁর ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা আর সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়ে বাঙালিদের নিকট একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য (স্বাধিকার অর্জন) তুলে ধরে এটিকে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপন করেছিলেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পেয়ে গণমুখী নেতৃত্ব দিয়ে দলটির ভেতর বহুবিধ গুণগত পরিবর্তন আনয়ন করে দলটিকে তৃণমূলে গণমানুষের হৃদয়ে প্রোথিত করে দেন। তিনি কখনও ক্ষমতার জন্য কিংবা বিশেষ কোনো গোষ্ঠির জন্য রাজনীতি করেননি; করেছেন গণমানুষের মুক্তির জন্য, দেশপ্রেম আর মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে শোষণহীন সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে। পাকিস্তানি শাসকদের কোনো প্রলোভন কিংবা হুমকিধমকি তাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম সাফল্য অর্জিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। দ্বিতীয় সাফল্যের জয়য়াত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যখন তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের হাল ধরেন এবং দেশ পুনর্গঠনের উদ্যোগ বাস্তাবায়িত করতে থাকেন। এমন একটা সময়ে তিনি দেশের হাল ধরেন যখন বিশাল জনগোষ্ঠির ক্ষুধার্ত পেট ছাড়া সত্যিকার অর্থেই দেশে কিছু ছিল না। চারদিকে লন্ডভন্ড অবস্থা। মজুদহীন খাদ্যগুদাম, ভাঙ্গা রাস্তাঘাট, বিধ্বস্ত পুল-কালভার্ট, উপড়ে ফেলা রেললাইন, পুড়িয়ে ফেলা বাস-ট্রাক, আগুনে পোড়া শস্যক্ষেত, জ্বালিয়ে দেওয়া বাড়িঘর, লুটপাট করে নিঃশেষ করে দেওয়া ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দুমড়েমুচড়ে ফেলা অর্থনৈতিক সিস্টেম, গতিহারা ব্যবসা-শিল্প, ধ্বসনামা বৈদেশিক বাণিজ্য আর শূন্যের কোঠায় বৈদেশিক মুদ্রা, শত্রুদের পোতা মাইনে অচল চট্টগ্রাম আর মোংলা বন্দর। এতো নাই নাই-এর মধ্যেও একটুও না ঘাবড়ে গিয়ে তিনি তাঁর ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্ব দিয়ে মাত্র সাড়ে তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশের জন্য সংবিধান তৈরিসহ ভৌত অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা বাহিনী, পুলিশবাহিনী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
শুধু কি তাই? এ সময়ের মধ্যেই তিনি জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জনসহ ১৩৪টির বেশি দেশের স্বীকৃতি আদায় করেন, যা ছিল দেশ পুনর্গঠনের জন্য অতীব জরুরি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের ভারতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির পুনর্বাসনে ভারতের সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেন। ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি, সীমান্ত চুক্তি, পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি, আকাশপথ চুক্তি এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে ছয় লক্ষ বেল কাঁচাপাট রপ্তানির চুক্তিতে আবদ্ধ হন। ভারতের সাথে আলোচনার মাধ্যমে কয়েকটা ছিটমহল আদায় করেন। রাশিয়ান বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে বন্দরগুলোর মাইন সরিয়ে ব্যবহারযোগ্য করার উদ্যোগ নেন আর ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি শরণার্থীকে দেশে এনে পুনর্বাসন করেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে সর্ব পর্যায়ে তিনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকাঠামো নির্মাণসহ হানাদার বাহিনীর হাতে লাঞ্চিত কয়েক লক্ষ মা-বোনের পুনর্বাসন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের সরকারকে চৌকস নেতৃত্বের গুণে ‘মাঠ সরকার’ (মাঠে জনগণের সাথে কাজ করার সরকার) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তৃণমূলে শেকড় গেড়ে বসা শক্তিশালী দলটিকে গণমানুষের দলে পরিণত করেন। আওয়ামী লীগের দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের নিয়ে তিনি প্রশাসনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন দেশের নতুন সরকার প্রথম বছরেই অনেকগুলো যুগান্তকারী গণমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে: বাজেটে নতুন কর আরোপ না করা, বকেয়া কৃষিজমির খাজনাসহ ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির খাজনা মওকুফ, শহরের বাড়ির ট্যাক্স মওকুফ, ইজারা প্রথা বাতিল, কৃষি আয়ের উপর থেকে কর প্রত্যাহার, শিক্ষা আর সমাজকল্যাণে প্রতিরক্ষার তুলনায় বেশি প্রাধান্য প্রদান, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এক কোটি টাকার বই বিনামূল্যে বিতরণ, সকল শিক্ষার্থীর যুদ্ধকালীন নয় মাসের বেতন মওকুফ, শিক্ষাকে গণমুখী করার লক্ষ্যে কুদরত-ই-খুদা কমিশন গঠন এবং আরো অনেক জণকল্যাণমুখী কর্মকান্ড। এ সব উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি অচল দেশটাকে সচল করে তোলেন। উচ্চশিক্ষার উন্নয়নের প্রতিও তাঁর নজর ছিল প্রশংসাযোগ্য। তাঁর আমলেই ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৬২’র কালাকানুন বাতিল করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ’ (১৯৭২) জারিসহ বাংলাদেশের জন্য প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করা হয়।
যখন অকুতোভয়ে তিনি তিল তিল করে দেশকে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন, বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টায় সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখনই বিশ্বাসঘাতক স্বাধীনতা-বিরোধী হায়েনারা তাকে সপরিবার নিঃশেষ করে দেয়। এ দেশ হারায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে, দেশের স্থপতি স্বাধীনতার ঘোষক জাতির পিতাকে, বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ককে।
বঙ্গবন্ধু ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন এবং একই সাথে নিজেই ইতিহাস হয়ে সারা বিশ্বে নিজেকে মৃত্যুর পরও জিন্দা রেখেছেন। কেউ তাঁকে হারাতে পারেনি, পারবেও না। মরেও থাকবেন অমর। শেখ মুজিব, শেখ মুজিবই। যতদিন বাঙালি জাতি আপন ঈমানে বলীয়ান হয়ে থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু এদেশের মাটিতে-আকাশে জলে-স্থলে অদৃশ্য তারকার মতো আলো দিতে থাকবেন।
লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন