১৫ই আগস্টের পর আমাদের কাছে অশ্রু-বেদনা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। দেশে ফিরতে পারব কি পারব না, ৩২ নম্বরের বাড়িটির কী অবস্থা, টুঙ্গিপাড়ায় যেতে পারব কি না, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কখনো কখনো মনে হতো যে, এভাবে কি সারা জীবন কেটে যাবে? তবুও কোথায় যেন একটা সাহস বা আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ছিল যে, না, একদিন দেশে ফিরতে পারব। এত কষ্টের বাংলাদেশ আর আমরা বিদেশে থাকব পড়ে! এটাতো হতে পারে না, বাংলার জনগণ তো এটা সহ্য করতে পারবে না। পিতা-মাতা, ভাই-বোন সব হারিয়ে এত বড় শোক সামলানো খুব কঠিন। চোখ ভেসে যেত, মন ভেঙে যেত, বয়সও অল্প ছিল, কীভাবে নিজেদের সামলাতাম! আমরা দু’বোন দু’বোনকে ধরে কাঁদতাম, কাঁদতে কাঁদতে অনেক সময় পার করেছি, দু’জন দু’জনকে সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করেছি। তারপর আপা যখন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হয়ে দেশে ফিরলেন, আমাদের স্বপ্ন ছিল একটাই- আব্বার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করা। ’৮১ সালে আপা যখন দেশে ফেরেন আপাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয় নাই, ৩২ নম্বরে ঢুকতে দেয়া হয় নাই। বাড়ির সামনে রাস্তায় বসেই তিনি দোয়া-দরুদ পড়তে বাধ্য হন। এই বাড়িতে আমাদের কত স্মৃতি, ৬ দফা, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই বাড়িতে কত মানুষ আসত, কত সভা হতো, লোকে-লোকারণ্য থাকত, সে বাড়ি আজ নির্জন, নিস্তব্ধ, শূন্যতায় ভরা। বুকের ভেতর সব ব্যথা-বেদনা চেপে রাখতে হতো, কাউকে কিছু বলতে পারতাম না, নিজেকে নিজে শক্ত করে রাখতাম, সান্ত¡না খুঁজে বেড়াতাম। ’৮৩ সালে আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি। এসে ঐ বাড়িতে প্রবেশ করতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে, বুক ভেঙে গেছে। আমাদের ভাগ্যে ছিল আব্বার হাতের এই স্মৃতি এবং এটাই আমাদের জীবনের একটা অমূল্য সম্পদ।
আমাদের পরিবারে পারিবারিক একটি মূল্যবোধ ছিল। জন্ম থেকেই আমরা আব্বাকে দেখে আসছি জেলে জেলে, আমরা মায়ের কাছে শিক্ষা পেয়েছি বড়দের কীভাবে সম্মান করতে হয়, অনুমতি ছাড়া তাদের জিনিসপত্র ধরা বা দেখা উচিত না। আব্বার লেখা খাতাগুলো মা খুব যতœ করে গুছিয়ে রাখতেন তার প্রিয় জিনিসপত্রের সঙ্গে, আমরা দূর থেকেই দেখতাম কিন্তু ধরা বা দেখা বা পড়ার সাহস হতো না বা তখন এত বুঝতেও পারিনি যে এর ভেতরে এত কিছু লেখা থাকবে এবং এটা যে আমাদের পরম সম্পদ, সেটা তখনও বুঝতে পারিনি, অনেক ছোট ছিলাম। আমরা দূর থেকেই দেখতাম। ইতিহাসের একটা প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠবে এটা, তখনও বুঝতে পারিনি।
আব্বার জীবন কত বিচিত্রভাবে চিত্রিত, কত দুর্লভ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিজেকে গড়ে তোলার পাশাপাশি সে সময়ের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতেন, সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন, বাবা-মার কথা ভাবতেন, তিনি তার সময়ে একান্ত একজন বিশ্বস্ত ও আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ ছিলেন। তারুণ্যের অদম্য সাহস, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগের মহিমা, দুর্দান্ত দূরদর্শিতার অধিকারী ছিলেন। সহজ-সরল মুখের ভাষায় নিজের জীবনের সব কথা বলেছেন।
বিশেষ করে তিনি যখন দিল্লিতে গেছেন কীভাবে, টিকিট ছাড়া- উনি ওটাও লুকাতে চেষ্টা করেননি। প্রথমে পড়তে পড়তে একটু খটকা খেলাম যে আব্বা টিকেট ছাড়া! চিন্তা করে ওনার বয়সটা বের করলাম। ঐ বয়সে ঐটা সাজে, কারণ তখনতো ওটা কোনো দোষের ছিল না। ঐ বয়সে তো ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু করে। উনি তো একটা সামান্য টিকিট, একটা টিকিট নিয়ে তিনজন চলেছিলেন। ওটাও লুকাতে চেষ্টা করেননি যে, ওটা কোনো ঘটনাই ঘটেনি বা কিছু। এই যে সব সহজ সরল ব্যাপারটা কীভাবে লিখে গেলেন? সেটা বঙ্গবন্ধু বলেই সম্ভব। অনেকে হয়তো লিখতেন আমি কখনো অন্যায় কাজ করিনি। পড়তে পড়তে আমাদের মনে হয়েছে সেই তরুণ বয়সের কথা, এই গ্রন্থের পাতায় পাতায় রয়েছে তার সাধারণ জীবনের সাক্ষী। আমি এবং আপা পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার স্মৃতির ঘ্রাণ খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি। একবার না কতবার যে আমরা পড়েছি। প্রথম প্রথম ভয় লাগতো। কিন্তু তারপরে কখনো খারাপ লাগলে কোনো সময় ওখান থেকে একটা লাইন পড়ে নিজেদের শক্তি সাহস আমরা জোগাড় করতাম, এটাই আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। কারণ এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন বুঝতে পারিনি তো। আমাদের হয়তো কিছু বলতেন, দিক-নির্দেশনা দিতেন। ওখানেই পড়ে মনে হতো আব্বা বোধহয় চাচ্ছেন এখন এটা করি বা ওটাই আমাদের মনে হতো। এখানো আমরা পড়ি, কোনো কিছু মনে হলে ওখান থেকেই আমাদের উদ্দেশ্য বলা হচ্ছে, হয়তো আব্বা আপার মাথায় হাত রেখে বলছেন- ‘হাসু তুমি এটা করো, দেশের কল্যাণের জন্য এটা করো।’ আপা বোধহয় ওখান থেকেই এত সাহস বা এত কাজ করার উৎসাহ পান।
এই আত্মজীবনী বাঙালি জাতির সংগ্রামী ইতিহাসের একটি শ্রেষ্ঠ অধ্যায় হয়ে রবে। এই ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয়, দেশপ্রেমের উজ্জ্বল শিক্ষা হয়ে রবে, সামনে চলার সাহস যোগাবে।
বাংলার মানুষ ছিল তাঁর প্রিয়। তিনি এই বাঙালি জাতির জন্য একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। এই দেশের কল্যাণের জন্য সারা জীবন আত্মত্যাগ করে গেছেন। খাতাগুলো হাতে নিয়ে মনে হয়েছে, সাধারণ রুলটানা খাতা, কারাগারের ভেতরে বসে তিনি সাধারণ একটি কলম দিয়ে লিখে গেছেন তাঁর জীবনস্মৃতি, তাঁর লেখা ডায়েরির পাতাগুলো পড়লে মনে হয় কী দুঃসহ কষ্ট সহ্য করেছেন, তবুও তিনি ছিলেন তাঁর বিশ্বাসে অটল। এ কারণেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, দুঃখী মানুষের নয়নমণি।
(আব্বার আত্মজীবনীর মতো) আমাদের দুই বোনের জীবনটাও যেন অসমাপ্ত, এটাও আরেক ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। আমাদের ধর্মে মানুষের মৃত্যুর সময় দোয়া-কালাম পড়ানো হয় বা তাদের প্রিয়জন চলে গেলে তাদের মুখ দেখানো হয়, কবরে দেয়ার সময় তাদের শেষ দেখা দেখানো হয়। এটা আমাদের ধর্মে, এটা আমাদের সবকিছুতে। কিন্তু আমরা তো সেই সুযোগ থেকেও বঞ্চিত এবং এই জন্যই আমাদের সবসময়, আমাদের সবকিছুই অতৃপ্ত অসমাপ্ত রয়ে যাবে।
(জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শততম স্মারক গ্রন্থ থেকে)
লেখক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠা কন্যা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন