মো. হাবিবুল্লাহ, নেছারাবাদ (পিরোজপুর) থেকে
ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানার শাখা খালের জলে ও ডাঙ্গায় কয়েক যুগ ধরে বসে আসা মৌসুমভিত্তিক চাঁই ও নৌকার হাট। উপজেলার সন্ধ্যা নদীর বুক চিরে থানার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যাওয়া শাখা খালের আটঘরে জলে ডাঙ্গায় সপ্তাহের শুক্র ও সোমবার দু’দিন বসে বৃহৎ চাঁই ও নৌকার হাট। অত্র উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি উপজেলা ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা সহস্রাধিক ক্রেতা-বিক্রেতা এবং উৎসুক মানুষের সমাগমে কয়েক যুগ থেকে বসা নয়নাভিরাম এ চাঁই ও নৌকার হাট নেছারাবাদের মানুষের কাছে অন্যতম একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। সপ্তাহের শুক্র ও সোমবারে বসা চাঁই এবং শুক্রবারে নৌকার হাট মিলিয়ে প্রায় কোটি টাকা বিকিকিনি হতো এ ভাসমান নৌকা ও চাঁই হাটগুলোতে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্টি জনিত নানান কারণে বাংলা বছরের চৈত্র থেকে শুরু করে আশ্বিন অর্থাৎ ছয় মাস পর্যন্ত বসা এ বৃহৎ হাট দুটি আজ ক্রমেই ক্রেতা শূন্যতায় হুমকির মুখে পড়েছে। ক্রমেই পেশা ছেড়ে ভাগ্য বদলে অন্য পেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে বংশ পরম্পরার ব্যবসায়ীরা। ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ। এ দেশের প্রতিটি ঋতুর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নানা মৌসুমভিত্তিক ব্যবসায় জড়িত হয়ে যুগ যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। তদ্রুপ নেছারাবাদেও নেই এর কোনো ব্যতিক্রম। এখন বর্র্ষাকাল। খাল-বিল টইটুম্বর হয়ে উঠবে বর্ষা ও জোয়ারের নতুন পানিতে। পানিতে ছোটাছুটি করবে দেশীয় ছোটবড় হরেক প্রজাতির মাছ। আর এ মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহের লক্ষ্যে বরাবরের মতো এবছরও উপজেলার আটঘরের জলে-ডাঙ্গায় পাশাপাশি বসে জমে উঠছে বিখ্যাত চাঁই ও নৌকার হাট। হাটে চাঁই ও নৌকা বিকিকিনিতে মহাব্যস্ত হয়ে উঠবে অত্র উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা নৌকা ও চাঁই বিক্রেতারা। আর সেই বেচা-বিক্রির লক্ষ্য নিয়েই এবারও আটঘরের বিদ্যালয় সংলগ্ন মানপাশা বাজারের খাল ও প্রধান সড়কের পাশে জমে উঠেছে দৃষ্টি নন্দিত চাঁই ও নৌকার হাট। হাটে উঠেছে মনহরণকারী বাহারি নামের চাঁই ও চাম্বল, রেইনট্রি কাঠের পেনিস নৌকা। প্রতি হাটে উপজেলার বলদিয়া ও পার্শ্ববর্তী নাজিরপুর ও সীমান্তবর্তী নাজিরপুর থেকে বিক্রির উদ্দেশে ট্রলার বোঝাই করে হাটে আসছে চাঁই। তবে প্রতিবারের মতো ভালো বেচা-বিক্রির আশায় বিক্রেতারা পুঁজিপাতি খাটিয়ে হাটে চাঁই ও নৌকা নিয়ে আসলেও ক্রেতা শূন্যতায় মলিনমুখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছেন ব্যবসায়ীরা। সরেজমিনে কথা হয় হাটে আসা চাঁই বুননকারী কয়েকজন বিক্রেতার সাথে। হাটে ১০ বছর থেকে কলারদোয়ানিয়া থেকে আসা মো. বাবুল (৫১) জানান, ৬৫-৭০ টাকা একটি চাঁই বুননে তার খরচ পড়ে। বিক্রির উদ্দেশে হাটপর্যন্ত আসতে তার প্রতি চাঁইয়ে খাজনা ও খরচ মিলিয়ে চাঁইটির খরচ দাঁড়ায় ৭৫ টাকা। হাটে ক্রেতাসমাগম ঘটলে প্রতি চাঁই বিক্রিতে তার লাভ হত ২০-২৫ টাকা। তিনি আরো জানান, এ হাটে তিনি ২১২টি চাঁই নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ক্রেতাশূন্যতায় বাবুল মিয়া ঋণের চাপে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন। শাহলম মোল্লা (৩০) নামে হাটে আসা এক ফড়িয়া জানান, প্রতি বছর মৌসুম শুরু হওয়ার আগে তিনি নাজিরপুর ও উপজেলার বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁই সংগ্রহের জন্য কারিগরদের অগ্রিম টাকা দিয়ে আসেন। সিজনে সেসব চাঁই সংগ্রহ করে তিনি হাটে নিয়ে আসেন বিক্রির জন্য। শাহলম মিয়া বলেন, এবছর স্থানীয় সমিতি থেকে ১ লাখ টাকা নিয়ে তিনি কারবারে নেমেছেন, বেচা-বিক্রি মন্দায় তিনি কেনা দামেও হাটে আনা চাঁইগুলো বিক্রি করতে পারছেন না। ঋণের বোঝার ভয়ে তারও মলিন হয়ে উঠছে মুখ। বেচা-বিক্রির মন্দাভাব জানতে চাইলে একাধিক বিক্রেতা ও ক্রেতারা জানান, খালে অবাধে বিষ দিয়ে মাছ নিধন, বাধা জাল, পলি জমে নালা খাল ভরাট ও দিন দিন অবৈধ দখলদারে খাল মরে যাওয়ায় মরা খালে মাছ না মেলায় চাঁই বিক্রির এ করুণদশা। অপরদিকে, অত্র খাল এলাকার মানুষের মাছ ধরা, কুড়িয়ানার আপেলখ্যাত পেয়ারা বেচা-বিক্রি, গো-খাদ্য সংগ্রহ, নদীপথে মানুষের চলাচলসহ নানান প্রয়োজনীয় কাজে জলে ডাঙায় বিক্রেতারা বেচার উদ্দেশে নৌকার পসরা সাজিয়ে রাখলেও একই মন্দাভাব যাচ্ছে নৌকা বেঁচা-বিক্রিতেও। উপজেলার ১০ ইউনিয়নের ১১টি গ্রামের প্রায় দেড় সহ¯্রাধিক পরিবার উপরিউক্ত প্রয়োজনীয় কাজে নৌকা তৈরি ও বিক্রি করে বংশ পরম্পরায় জীবিকা নির্বাহ করে আসলেও নৌকা বিক্রিতে মন্দাভাবে আশানুরূপ দাম না মেলায় তাদের মুখেও রয়েছে হতাশার ছাপ। বানারীপাড়া উপজেলার গাভা থেকে হাটে নৌকা নিয়ে আসা মো. নাদির হোসেন (৬৭) জানান, ১০ হাতি একটি চাম্বলের নৌকা তৈরিতে সব মিলিয়ে তার খরচ পড়ে ৩৫শ’ টাকা। বেচা-বিক্রি ভালো হলে প্রতি নৌকায় তার ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা লাভ থাকবে। নাদির হোসেন বলেন, ১৯৭৪ সাল থেকে এ হাটে তিনি নৌকা নিয়ে আসেন। উপজেলার বলদিয়া থেকে আসা মো. আসলাম (৪২) বলেন, তিনি ১১-৭ হাতি মাপের, ১৫টি নৌকা নিয়ে এসেছেন। ১১ হাতি একটি চাম্বলের নৌকা তিনি ৩ হাজার টাকায় ক্রয় করে ৩৮০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকেন। তবে এবছর বেচাকেনা খুবই খারাপ যাচ্ছে। হাটের ইজারাদার ও ব্যবসায়ীরা জানান, আগে প্রতি হাটে নৌকা ও চাঁই বিক্রি মিলিয়ে ৭৫-৮০ লাখ টাকা বিক্রি হতো। এখন নানা সমস্যাজনিত কারণে বেচা বিক্রি এসে দাঁড়িয়েছে ২৫-৩০ লাখ টাকায়। আবার কোনো কোনো হাটে এ বেচা-বিক্রিও অনেক নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। তারা আরো জানান, ধার-দেনা করে প্রতি বছর ব্যবসায়ীরা হাটে চাঁই ও নৌকা নিয়ে আসেন। এভাবে বেচা-বিক্রি দিন দিন কমে গেলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের গ্রাম-বাংলার প্রতিচ্ছবি উপজেলার ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন