বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

‘মোড়কীকরণ হলে সাধারণ, বাঁচবে জীবন’

প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এম রফিকুল ইসলাম মিলন
এ বছর এ বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল এবঃ ৎবধফু ভড়ৎ চষধরহ চধপশধমরহম. যার ভাবানুবাদ ‘মোড়কীকরণ হলে সাধারণ, বাঁচবে জীবন’। সারা বিশ্বই ধূমপানের কারণে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুরোধে সোচ্চার হওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক একটি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যচুক্তি ঋৎধসবড়িৎশ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঞড়নধপপড় ঈড়হঃৎড়ষ (ঋঈঞঈ) প্রণয়ন করেছে। এই চুক্তিতে এ পর্যন্ত ১৬৮টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশও এ চুক্তির প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। এ চুক্তির বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাতদ্রব্য (ব্যবহার) নিয়ন্ত্রণ আইন এবং ২০০৬ সালে এর বিধি প্রণয়ন করেছে। পরবর্তীতে আইনটি আরও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে সরকার ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধনের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করেছে। একই সাথে ২০১৫ সালে আইন অনুযায়ী বিধিও সংশোধন করা হয়েছে। ফলে তামাক ব্যবসায়ীদের নানা কূটকৌশল ও অপকৌশল ক্রমান্বয়ে সীমিত হয়ে আসছে। সংশোধিত আইনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে তামাকজাতদ্রব্যের সকল প্যাকেটে ৫০% জায়গাজুড়ে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান।
ইতোমধ্যে ১৯ মার্চ ২০১৬ থেকে তামাক কোম্পানীগুলো তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের প্যাকেটে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান শুরু করেছে। আইন অনুযায়ী মোট ৮টি সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের বিধান রয়েছে যা প্রতি ৩ মাস অন্তর অন্তর তামাক কোম্পানী কর্তৃক পরিবর্তন করতে বাধ্য থাকবে। “একটি ছবি হাজার শব্দের চেয়েও অধিক শক্তিশালী” যারা পড়তে জানে না, তাদের কাছে এ ধরনের সতর্কীকরণ ছবি অধিক কার্যকর। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদানের ফলে তামাকের ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশেও এ কার্যক্রমের ফলে তামাকের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে বলে সকলেই আশান্বিত। এ ধরনের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী একজন ধূমপায়ীকে যেমন প্রতিনিয়ত সতর্ক করছে তেমনি একজন অধূমপায়ীকে অথবা অধূমপায়ী পরিবারকে অথবা অধূমপায়ী যুব-কিশোরদেরকে বিনা খরচে সরকার কর্তৃক সতর্ক করা হচ্ছে।
কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে তামাক কোম্পানী কর্তৃক বিজ্ঞাপন, স্পন্সর বা সামাজিক দায়বদ্ধতা নামক নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা কূটকৌশলে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হতো তাও সীমিত হয়ে এসেছে। ফলে বর্তমানে তামাক কোম্পানী তাদের বিক্রয়কেন্দ্রে (চড়রহঃ ড়ভ ঝধষবং) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা কৌশলে প্যাকেটের বাহারী মোড়কীকরণের মাধ্যমে ধূমপায়ীকে আকৃষ্ট করার কার্যক্রমে লিপ্ত রয়েছে। যদিও পৃথিবীর অনেক দেশেই পয়েন্ট অব সেলসে সম্পূর্ণভাবে সিগারেটের বিজ্ঞাপন বা সিগারেট প্যাকেট সাজিয়ে রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে যা বাংলাদেশে এখনও সম্ভব হয়নি। আইনের ফাঁকফোকড় দিয়ে তামাক কোম্পানী বিভিন্ন সময় আইনের অপব্যাখ্যা দিয়ে পয়েন্ট অব সেলসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার অব্যাহত রেখেছে। যদিও সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তা অপসারণ বা বন্ধ করার কার্যক্রম চালু রয়েছে। সারা পৃথিবীতে ক্ষতিকরদ্রব্য বা ক্ষতিকর বস্তু বিক্রয়ের প্যাকেট বা মোড়ক অত্যন্ত দর্শনীয় হয়ে থাকে। উল্লেখযোগ্য যেমন, মদের বোতলের মোড়কীকরণ, আগ্নেয়াস্ত্রের মোড়কীকরণ ও সিগারেটের প্যাকেটের মোড়কীকরণ। বাংলাদেশে আগ্নেয়াস্ত্র এবং মদ সরাসরি সাধারণের কাছে বিক্রি করা কঠোর বিধি নিষেধ আছে কিন্তু সিগারেট সাধারণের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে এ ধরনের কঠোর বিধিনিষেধ নেই। অর্থাৎ বিড়ি-সিগারেট উন্মুক্তভাবে প্রাপ্তবয়স্ক সবার কাছে বিক্রি নিষিদ্ধ নয়। এর ফলে সে কারণে বাংলাদেশের তামাক কোম্পানীগুলো তাদের সিগারেট মোড়কীকরণে রঙিন এবং দর্শনীয় করার লক্ষ্যে মোড়কীকরণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। তামাক কোম্পানী ধূমপায়ীদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে তাদের ব্র্যান্ডের প্যাকেট বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কালারের মাধ্যমে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এসব কোম্পানী একদিকে যেমন তামাকের মোড়কীকরণের সুদৃশ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে অন্যদিকে তাদের পয়েন্ট অব সেলসগুলিতে সিগারেট প্যাকেট প্রদর্শনসহ সমগ্র পয়েন্ট অব সেলসকে নানা রঙে রঙিন করে জনসাধারণের প্রলুব্ধ করণে নানা কৌশল অবলম্বন করছে। সারা বিশ্বে তামাক কোম্পানীর এ সকল অপকৌশল নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বছর সকল ধরনের তামাকের প্যাকেটে একটি কমন বা সাধারণ বা অভিন্ন আঙ্গিকে রাখার আহ্বান জানিয়ে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে। এ প্রতিপাদ্য অনুযায়ী প্রতিটি দেশ এফসিটিসি’র আর্টিকেল ১১ ও ১৩ অনুযায়ী স্ব-স্ব দেশে উৎপাদিত সিগারেটের মোড়কীকরণ, কালারবিহীন বা সাধারণ বা অভিন্ন হয় তাহলে তামাক কোম্পানীর প্যাকেটের সুদৃশ্য করার যে প্রতিযোগিতা তা প্রতিহত হবে ফলে সাধারণ মানুষ ধূমপানে আসক্তি হওয়ার যে প্রবণতা সৃষ্টি হবে তা থেকে রক্ষা পাবে। ফলে অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা পাবে।
এবারের প্রতিপাদ্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকেই সাধারণ ও অভিন্ন মোড়কীকরণের বিষয়ে আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশও এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে। ভবিষ্যতে তামাক নিয়ন্ত্রণে ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যাতে ২০৪১ সালে প্রধানমন্ত্রী তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে তা বাস্তবায়নের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নে সহায়ক কার্যক্রম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাক ব্যবহারের কারণে অনাকাক্সিক্ষতভাবে যে ৯০ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে এবং ৩ লক্ষ ৮২ হাজার লোক পঙ্গুত্ব বরণ করে তা প্রতিরোধে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য প্রতিপালিত হলে এ অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু রোধে তামাকজাতদ্রব্যের অভিন্ন বা সাধারণ মোড়কীকরণ অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখবে। আশা করি সরকার গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি বিবেচনা করবে।
ষ লেখক : বোর্ড অব ট্রাস্টি, বাংলাদেশ তামাকবিরোধী জোট ও অনারারি টেকনিক্যাল এডভাইজার, মানবিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন