মিযানুর রহমান জামীল
খাদ্য মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার অবলম্বন। আবার এ খাবারই মানুষের মৃত্যুর কারণ। একদিকে যেমন পানির অপর নাম জীবন অপরদিকে এই পানিই হতে পারে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ। পানি নিয়ে আমাদের সাথে সাধারণত ভারতের একটা বিভাজন থাকে। বর্ষা এলে যা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক তুলকালাম ঘটে। সংলাপ ইত্যাদিও চলে অবিরাম। বর্ষা গেলে আবার সব ভুলে যেতে হয়। বিপক্ষের মোকাবিলায় পানি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উক্তি আর যুক্তির তুফান আজ পর্যন্ত বাংলাদেশকে পানি আগ্রাসন থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। কিন্তু এই পানি দিয়ে তারা যেভাবে আমাদের আক্রান্ত করে থাকে তার মতো আমরাও এ পানি দিয়ে আমাদের জীবনকে আক্রান্ত করে থাকি।
মিরপুর কাজীপাড়া, ফার্মগেট, শাহাবাগ, পল্টন, গুলিস্তান, বাংলাবাজার সদরঘাট, এমন কোনো স্পট বাকি নেই যেখানে সাধারণত বাইরের খাবারের সুব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ধরনের পানীয় সামগ্রী পাওয়া যায় না। গোটা শহরজুড়ে একজন লোককে স্বাভাবিকভাবে নগদঅর্থে বাইরে বিক্রি করা তরলজাতীয় যে কোনো খাদ্যের জন্য বেগ পেতে হয় না। বিশেষ করে পানি জাতীয় কোনো শরবত, মাঠা, দুধ বা অন্য তরলের স্বাদে গন্ধে তৈরি করা চিত্তাকর্ষক জিনিসগুলো মানুষের চাহিদাকে কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দেয়। মন না চাইলেও যেন ‘একটু খেয়ে নিই!’ এ অবস্থায় অনেককেই পড়তে হয়।
এগুলো কতটুকু জীবাণুমুক্ত খাওয়ার উপযোগী তা জানা সত্ত্বে¡ও মানুষ নির্বিঘেœ গিলছে। তার হিসাব কষতে গেলে কোনো ডাক্তার বা দলিল ছাড়াই খালি মুখে বলতে হবে ধুলা-বালি মিশ্রিত এসব জিনিস কখনও খাওয়ার উপযোগী বা শরীরের জন্য ইতিবাচক হতে পারে না। অনুপযোগী হিসেবে এসব পানিতে ফলফলাদির রস মিশ্রণও স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
কিছুদিন পূর্বে একজন ব্রিটিশ নাগরিক বাংলাদেশে এসে রাস্তায় রাস্তায় খাবারের আয়োজন দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন, ডযধঃ রং ধ পঁষঃঁৎব? ‘এটা কেমন নীতি?’ আমাদের দৈনন্দিন খাবারের তালিকা এগুলোকে কোনোক্রমেই উপযোগী খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। কারণ মানবিক জীবনে বেঁচে থাকার মূল উপকরণ যদিও পানি বা পানির অপর নাম জীবন হলেও সেই পানিকে নিয়ে কালোবাজারি শুরু করেছে একশ্রেণীর নি¤œমধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীরা। এসব জায়গায় চায়ের কাপেও প্রচ- ঝড় বয়ে চলে। আর যাই কিছু হোক অন্তত শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই মিলে সেখানে মোটামুটি একটি মিনি সমাবেশ হয়ে যায়। রাজনৈতিক আলাপ থেকে সব আলাপই হয়। বাদ যায় কেবল চায়ের অপকারিতা ও বিষাক্ত নেশাদ্রব্যমিশ্রণ ‘পাউডার’ (চা ব্যবসায়ীদের একান্ত পরিভাষা) এর কথা। ফলে কেউ জেনেও মেনে নিতে চায় না এসব অপকারিতার বিষফল। যার কারণে রোগ-ব্যাধি ইত্যাদির কবল থেকে মানুষের মুক্তি পাওয়া এক প্রকার কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আখের রস যদিও শরীরের জন্য উপকারী কিন্তু মেশিনের মাধ্যমে এটাকে যেভাবে রস নিংড়ানোর আধুনিক সিস্টেম চালু করা হয়েছে, সেটা কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত? এগুলো সাধারণত শক্ত খোষা পৃথক করার পর বাইরের ধুলাবালির অদৃশ্য ছোঁয়া লেগে প্রকৃত স্বাদের পরিবর্তে কয়েকগুণ বিষাক্ত হয়ে ওঠে। যা মানুষের রুচির সামনে গোপন থেকে সেবনের কারণে শরীরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকাকে দুর্বল করে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।
ফল-ফলাদি মেশানো শরবতের পানিও জীবণুমুক্ত নয়। ১ গ্লাস ২০ টাকা করে দেদার বিক্রি হচ্ছে। এটা বিক্রেতার ফল বিক্রির মতোই। অবলম্বন এমন হওয়ার পেছনে বাইতুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটস্থ একজন শরবত ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করে জানা যায়Ñ মানুষের শরবতের প্রতি ঝোঁকটা একটু বেশি বিধায় তিনি এটাকে ফল-ফলাদি মিশ্রণে আপ্যায়ন করছেন। যখন এটার সাথে মেশানো হয় ইশপগুল, তোকমা, খেজুর, আপেল, চিনিসহ মিষ্ট জাতীয় নানান ফলফলাদি তখন পানির মূল গন্ধ এগুলোর মাঝে লুকিয়ে যায়, আর জীবণুগুলো সাময়িক পর্যায়ে ঘুমিয়ে যায়। আর এটা রাস্তার পাশে থেকে গ্লাসের ভেতরে দেখলে সুন্দরই দেখা যাবে কিন্তু পানিগুলো কোনো নদীর সেটা নিয়েই সন্দেহ। কারণ চক চক করলে সোনা হয় না। মাঠা যদিও রাস্তার পাশে বিক্রি হয় না কিন্তু এর ভেতরে দুধের সর প্রমাণের জন্য টিস্যুর টুকরো ছড়ানো থাকে। মেয়াদ উত্তীর্ণ বোতলের গায়ে নতুন মেয়াদ বসিয়ে ফ্রিজের সাহায্যে তাজা রাখার অপচেষ্টাও কম চলে না। আর কমল পানীয় ‘হৃৎপি-ের আণবিক দুশমন’ জলন্ত সিগারেটের মতো মানুষকে অদৃশ্য শোষণের মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
তাৎক্ষণিক রুচি বৃদ্ধির জন্য বোরহানি একটি অন্যতম খাবার অনুসঙ্গ। উপস্থিত রুচি বৃদ্ধি ঘটালেও পরবর্তী সময়ে এটাই মানুষের জীবনে অরুচির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যার কারণে পরবর্তী সময়ে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হয়। ঠিক তেমনিভাবে গ্রীষ্মে লেবুর শরবত দিয়ে চলে জমজমাট ব্যবসা। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় করার জন্য একদিকে কাজ করে ভিট লবণ অন্যদিকে টেস্টি স্যালাইন। সমস্যা হলো সেখানেও পুরাতন লেবুর ব্যবহার বেশি, যেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় নষ্ট অ্যাসিড বলে অভিহিত করা হয়। এসব শরবতে বরফগলিত পানির আসল রূপ প্রকাশ পায় সেবনের দু’একদিন পর। বিশেষজ্ঞদের মতে মাথাব্যাথা ও বিভিন্ন অসুস্থতার পেছনে এগুলো বেশিরভাগই দায়ী।
সুতরাং মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত জীবন ধারণের ক্ষেত্রে ভালো খাবার মানুষকে সুস্থ রাখে। কেননা রাস্তার পাশে অযতনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রলি, ভেন ও টেবিলের নষ্ট, পুরাতন ও ঠান্ডা খাবারের চেয়ে বাড়িতে বা হোটেলে তৈরি তাজা, নতুন ও গরম খাবার স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপযোগী। অনুপযুক্ত খাবার জীবনের জন্য অনেক বড় অ্যাকসিডেন্ট। এর থেকে মুক্তির জন্য জনসচেতনতার পাশাপাশি রাস্তার পাশের ওপেন খাবারের আসরগুলোকে ধুলাবালিমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন রাখা অপরিহার্য। এদিকে সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় এবং জীবন বিধ্বংসী পানীয় সেবনের পথকে রুদ্ধ করা বাঞ্ছনীয়। প্রকাশ থাকে যে, ডাবের পানি আসল-নকল বা বিষাক্ত হওয়ার ব্যাপারে পথিককে-ই লক্ষ্য রাখতে হবে।
ষ লেখক : সম্পাদক, কলমসৈনিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন