ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ
কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের সন্নিকটে হামলা চালিয়ে দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে জঙ্গি নামের দুর্বৃত্তরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলিতে এক গৃহবধূ ও এক জঙ্গি নিহত হয়। আহত হয় ছয় পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ১০ জন। ঈদের জামাত শুরু হওয়ার নির্ধারিত সময়ের সোয়া এক ঘণ্টা আগে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনরত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা।
সন্দেহ করা হচ্ছে, শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ছিলেন জঙ্গিদের লক্ষ্য। জঙ্গিবিরোধী ফতোয়া দেওয়ার জন্য তিনি ধর্মের ভেকধারী দুর্বৃত্তদের আক্রোশের শিকার হলেন। ঈদের জামাতে জঙ্গি হামলার ঘটনা প্রমাণ করেছে ধর্মের নামে যে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো হচ্ছে, তার সঙ্গে শান্তির ধর্ম ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। কোনো নিষ্ঠাবান মুসলমানের পক্ষে ঈদের জামাতকে হামলার টার্গেট করা সম্ভব নয়। তাছাড়া, সন্ত্রাসী হামলা কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। আর ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হত্যা কবিরা গুনাহ্র শামিল। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাউকেও অন্যায়ভাবে হত্যা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর অন্যায়। বিশ্বাসীদের ওপর হামলায় গুনার মাত্রা যে আরও বিস্তৃত হয় তা সহজে অনুমেয়।
অন্যদিকে গত ১ জুলাই গুলশান হামলায় নিহত পাঁচ জঙ্গির একজন মাদরাসার ছাত্র হলেও বাকি তিনজন ইংরেজি মাধ্যম এবং একজন সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। শোলাকিয়ায় হামলাকারী নিহত এক জঙ্গি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
পারিবারিক সূত্রে বলা হয়েছে, চার মাস ধরে সে নিখোঁজ ছিল। গুলশানের পর শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে জঙ্গি হামলা দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এ দুই হামলা শান্তির ধর্ম ইসলামের জন্যও বিড়ম্বনা ডেকে এনেছে। মাহে রমজানে রাসুল (সা.)-এর নামাঙ্কিত মদিনার পবিত্র মসজিদে হামলা চালিয়েছে জঙ্গিরা। এজন্য বেশকিছু পাকিস্তানিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। খেলাফত প্রতিষ্ঠা বা জিহাদের কথা বললেও কোনো মুসলমানের পক্ষে মসজিদে নববীতে হামলা চালানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। হামলাকারীরা মুসলিম পরিবারের সন্তান হলেও জঙ্গিবাদের মগজ যে অশুভ কোনো শক্তির কাছে বাঁধা তা সহজেই অনুমেয়। ইসলামের সুনামের স্বার্থেই বিশ্বাসী সব মানুষকে জঙ্গি নামের নোংরা দৈত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
আরেকটি বিষয়, দীর্ঘদিন নিখোঁজ যুবকদের খোঁজে দেরিতে হলেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এব্যাপারে তাদের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙার বিষয়টি অবশ্যই একটি সুখবর। গত তিন বছরে হঠাৎ করে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যাওয়া যুবকদের এক অংশ জঙ্গি সংগঠনের হয়ে কাজ করছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা। এই তরুণদের বেশিরভাগই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। মাদকাসক্তি ও রোমান্টিকতার যুগল ইন্ধনে এদের অনেকেই পা দিয়েছে জঙ্গিদের পাতা ফাঁদে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইতোমধ্যে ১০ জনের ব্যাপারে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। তাদের পাসপোর্ট নাম্বারও এখন পুলিশের হাতে। সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে অনুরোধ করা হয়েছে কারোর সন্তান হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গেলে তা যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়।
স্মর্তব্য, নিখোঁজ হওয়া কোনো কোনো তরুণের পরিবার এ বিষয়ে পুলিশকে যথাসময়ে জানালেও বেশিরভাগ পরিবারই বিষয়টি গোপন রাখে। গুলশানের রেস্তোরাঁয় জিম্মি উদ্ধার অভিযানে নিহত সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে রোহান ইবনে ইমতিয়াজসহ দুজন দীর্ঘসময় নিখোঁজ ছিলেন। তাদের পরিবার থানায় জিডিও করেছিল।
অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঘটনায় নিহত সন্দেহভাজন হামলাকারী আবির রহমান কয়েক মাস আগে নিখোঁজ হলেও জিডি করা হয়েছে হামলার আগের দিন। পুলিশ সদর দফতর সূত্রের বরাত দিয়ে একটি দৈনিকে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে অন্তত ৭৭ জন তরুণ নিখোঁজ হয়েছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, এরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে। তাদের পরিবারও এব্যাপারে উৎকণ্ঠায় ভুগছে। ওই তরুণদের সন্ধান পেতে এরই মধ্যে নানা তৎপরতা শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গিবাদ দমনে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। বাবা-মা সন্তানদের ওপর নজর রাখলে এ বিপদ খুব সহজেই এড়ানো সম্ভব। সন্তানরা কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে, সেদিকে নজর দিলেই তাদের অকাম্য রূপান্তরের বিষয়টি অনুধাবন করা সহজসাধ্য হবে। কারো সন্তান নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানো হলে তাদের কুপথ থেকে ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। জঙ্গিবাদ যেহেতু দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় অগ্রগতির জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে সেহেতু এই নোংরা ভুতকে ঠেকাতে সারা জাতিকে পরস্পরের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হবে।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন