কামরুল হাসান দর্পণ
‘ভুল সবই ভুল, এ জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সব ভুল’, বিখ্যাত এ গানটি এখন অনেকেরই মনে পড়তে পারে। মনে পড়তে পারে গুলশানের রেস্টুরেন্টে ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহের অদূরে জঙ্গি হামলায় অংশগ্রহণকারী জঙ্গিদের পরিচয় জেনে। বহুদিন ধরে কিছু বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন সময়ে টেলিভিশনের টকশোতে বলে আসছিলেন দেশে জঙ্গি হামলা ও জঙ্গি সংগঠনের সাথে যারা জড়িত তাদের বেশিরভাগই মাদ্রাসার ছাত্র। কেউ কেউ এমনও বলেন, মাদ্রাসাগুলো হচ্ছে জঙ্গি উৎপাদনের আখড়া। তারা ইনিয়ে বিনিয়ে এমন পরামর্শও দেন মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়া উচিত। কেউ কেউ মাদ্রাসা শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে বলেন। অনেকটা অসাম্প্রদায়িক আদলে। সেই তাদেরই কেউ কেউ গুলশান হামলায় ইংলিশ মিডিয়াম ও নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা এবং বিত্তবান পরিবার থেকে উঠে আসা তরুণদের জড়িত দেখে চমকে উঠেছেন। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। এ কী করে সম্ভব! কয়েক দিন আগেও যেখানে মাদ্রাসা শিক্ষা ও ছাত্রদের তুলোধুনো করা হয়েছে সেখানে এ কী! এমন একটা ভাব নিয়ে তারা তিনশ’ ষাট ডিগ্রী ঘুরে নতুন করে অ্যানালাইসিস শুরু করে দিয়েছেন। হামলায় অংশগ্রহণকারী তরুণরা কেন জঙ্গি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়েছে এবং হচ্ছে এ নিয়ে বিশ্লেষণের যেন শেষ নেই। সাধারণ মানুষ দেখছে, কীভাবে ঐসব তথাকথিত নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবীরা রাতারাতি বোল পাল্টে নতুন করে কথা বলা শুরু করেছেন। অথচ দিনের পর দিন মাদ্রাসায় পড়ুয়াদের নিয়ে তাদের বিষোদগারের সীমা ছিল না। এর ফলে জনমনেও এক ধরনের দ্বিধার জন্ম হয়েছিল। রাস্তাঘাটে মাদ্রাসার ছাত্র বা দাঁড়ি-টুপি পরিহিত লোক দেখলেই মনে করত এরা হয়তো জঙ্গি। অনেকে বক্র দৃষ্টি নিয়ে তাদের দিকে তাকাত। গুলশানের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় এখন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে, ঐ সকল সুবিধাবাজ নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী এতদিন চিবিয়ে চিবিয়ে মনগড়া যা বলেছে তার পুরোটাই ভুল। এবং ‘ভুল সবই ভুল’। এতে অবশ্য একটা উপকার হয়েছে, সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছে এসব নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী এখন যাই বলুক না কেন, তা আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন যেমন প্রকাশিত হয়েছে, ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে মিলে ইরাক ধ্বংসে যুক্তরাজ্যের অংশগ্রহণের বিষয়টি ছিল পুরোপুরি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে। এই ভুল যে পৃথিবীর কত বড় ক্ষতি করে ফেলেছে তা তো আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। এই ক্ষতির মুখোমুখি এখন আমাদের দেশকেও হতে হচ্ছে। আর বুঝে হোক না বুঝে হোক, এই ক্ষতিকে চরম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার কাজটি করে ফেলেছে আমাদের সরকারের কেউ কেউ এবং কিছু নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী যারা অনবরত জঙ্গি দমন ও আইএসের উপস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন। এখন সরকারও ব্যাকগিয়ারে গিয়ে আইএসের কথা আর বলছে না। ঐসব নিরাপত্তা বিশ্লেষকও তাদের সুর বদল করে ফেলেছেন।
দুই.
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারপারসন এমরানুল হক চৌধুরী গুলশানে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে ফুল দিতে এসে বলেছেন, ‘আমাদের ধারণা ছিল যারা মাদ্রাসায় পড়ে, তাদের দিয়েই এসব ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো সম্ভব। কিন্তু গুলশানের ঘটনা সে ধারণা পাল্টে দিয়েছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেরা ছাড়া বিমান, রেলের মতো প্রযুক্তিনির্ভর যানবাহন চালিয়ে কাউকে জিম্মি করা সম্ভব নয়। এজন্য সন্ত্রাসীরা ধনী ঘরের সন্তানদেরই মগজধোলাই করছে।’ তার এ উপলব্ধি যে যথার্থ তা এখন অনেকটাই পরিষ্কার। মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ওপর এতদিন ধরে কিছু নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী যে কলঙ্ক লেপন করে আসছিলেন, তার এ কথা থেকে কিছুটা হলেও মাদ্রাসা পড়ুয়াদের সান্ত¡না মিলতে পারে। আরও সান্ত¡না মিশনে পারে, সম্প্রতি যে শতাধিক তরুণ নিখোঁজ হয়েছে বলে বলা হয়েছে এবং তাদের জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশই উচ্চবিত্ত পরিবারের ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এদের মধ্যে মাদ্রাসা পড়ুয়া নেই বললেই চলে। প্রশ্ন হচ্ছে, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা কেন জঙ্গি সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে? এ নিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্লেষকরা নানা বিশ্লেষণ করেছেন এবং করছেন। এর মধ্যে একটি বিশ্লেষণ হচ্ছে, সন্তানের প্রতি পরিবারের অভিভাবকদের উদাসীনতা ও যথাযথভাবে খেয়াল না রাখা। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, কার সঙ্গে মেলামেশা করছে এ ব্যাপারে অভিভাবকরা কোনো খেয়াল রাখছেন না। দ্বিতীয় বিশ্লেষণ হচ্ছে, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা কখনো অভাব-অনটন দেখেনি। যখন যা চেয়েছে, তাই পেয়েছে। তাদের পাওয়ার অবশিষ্ট কিছু থাকে না। ফলে তারা এক ধরনের শূন্যতার মধ্যে পড়ে। হতাশা গ্রাস করে। এ পরিস্থিতি নতুন কোনো আইডিয়া বা অ্যাডভেঞ্চারাস কিছু সামনে হাজির হলে তা ব্যতিক্রম মনে হওয়ায় লুফে নেয়। এ সুযোগে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের ব্রেনওয়াশ শুরু করে। পারিবারিক ও নিয়মতান্ত্রিক ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে ন্যূনতম কোনো ধারণা না থাকায় তাদের কাছে বিষয়টি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও লোভনীয় হয়ে ধরা দেয়। অনেকটা খেলনা দিয়ে শিশুকে প্রলুব্ধ করার মতো। অ্যাডভেঞ্চার এবং প্রলুব্ধ হওয়া থেকেই উচ্চবিত্ত ঘরের এসব সন্তান ভয়ংকর পথে পা বাড়ায়। অন্যদিকে মাদ্রাসায় যেসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে, তারা একটি নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী জীবনের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠে। তারা ভাল করেই জানে ইসলামে কোনটি সিদ্ধ আর কোনটি নিষিদ্ধ। ইসলামে জিহাদ বলতে কী বোঝায়। বৃহৎ পরিসরে বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা বলছেন, আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিভাজন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা সমাজকেও বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, সমাজ থেকে গণতান্ত্রিক মত প্রকাশ উঠে যাওয়া, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য, দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং আইনের শাসনের অভাব জঙ্গি তৎপরতাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করছে। তাদের মতে দেশে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের মূল কারণ রাজনৈতিক সংকট। দেশে কার্যকর বিরোধী রাজনীতি না থাকা এবং সরকার সে সুযোগ সীমিত করে ফেলায় ফাঁকা মাঠে তৃতীয় অপশক্তি হিসেবে জঙ্গি গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ এখন রাজনৈতিক কোনো দল নয়। জঙ্গি গোষ্ঠীই প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। এ নিয়েই সরকারকে বেশি মাথা ঘামাতে এবং বিচলিত হতে হচ্ছে। তার প্রধান প্রতিপক্ষ সংসদের বাইরে থাকা বৃহৎ বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন ও নির্যাতন করে কোণঠাসা করে ফেলায় তাকে নিয়ে সরকারের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। উল্টো জঙ্গি হামলার ঘটনার দায় বিরোধী দলের উপর চাপিয়ে দিয়ে কোণঠাসা অবস্থাকে ধরে রাখার কৌশল অবলম্বন করছে। দেশের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে এ ধরনের আচরণ মোটেও উচিত নয়। ব্লেম গেইমের সময় এটা নয়। অথচ এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এবং পরিস্থিতি আরও গভীর সংকটে নিপতিত হওয়ার আগেই বিরোধী দলগুলোকে সাথে নিয়ে বারবার জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছেন দেশের সচেতন মহল ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরা। অন্যদিকে সরকারপন্থী কিছু নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী টকশোতে বিভিন্নভাবে বলে চলেছেন দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিকে বাইরে রেখে ঐক্যবদ্ধ হতে। এসব নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বুদ্ধিজীবী ক্ষমতাসীন দলের প্রতি এতটাই অবসেসড যে, তারা মনে করছে ক্ষমতাসীন দলই যেন পুরো বাংলাদেশ। এর বাইরে আর কোনো দল নেই। জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ একটি দৈনিককে বলেছেন, ‘জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় আওয়ামী লীগও ঐক্য চায়। সে লক্ষ্যে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল কাজও করে যাচ্ছে। দেশের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকার জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করবে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত তথা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে ঐক্যের কোনো সুযোগ নেই। কেননা তারাই এদেশে জঙ্গিবাদের ধারক এবং বাহক।’ মাহবুব-উল-আলম হানিফের এ বক্তব্যে প্রতীয়মান হয়, দেশ বলতে কেবল সরকার ও তার জোট। তিনি বলেছেন, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যবদ্ধ করে সরকার জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করবে। দেশের মানুষ তো জানে সরকারের দাবি মোতাবেক তাদের কাক্সিক্ষত জোটই ক্ষমতায়। তারা তো ঐক্যবদ্ধই আছে। তাহলে জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করতে পারছে না কেন? আর ভোটের অংকের হিসাব যদি করা হয় তবে এ কথা তো সবারই জানা, বিএনপি নামক দলটির গড়ে শতকরা ৪০ ভাগ ভোট রয়েছে। আওয়ামী লীগেরও একই রকম রয়েছে। এর বাইরে রয়েছে ২০ ভাগ। এ হিসাব ধরে নিলে তো ক্ষমতাসীন দলের বাইরে ৬০ ভাগ মানুষ রয়েছে। তাহলে ৪০ ভাগ বা ৬০ ভাগ মানুষকে বাদ দিয়ে সরকার কিভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে? এই বিপুলসংখ্যক মানুষ তাহলে কি?
তিন.
এ কথা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট, বিশ্বে জঙ্গিবাদ সৃষ্টির মূল কারিগর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো। কিছু দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ইরাকে হামলা চালানো হয়েছিল। এখন ইরাক যুদ্ধ সংক্রান্ত চিলকট রিপোর্টে বলা হয়েছে, আজকে যে আইএস সংকটকে দুনিয়াব্যাপী এক মহাসংকট হিসাবে দেখা হচ্ছে তা ইঙ্গ-মার্কিন অপশক্তির সেই আগ্রাসী যুদ্ধেরই ফল। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইরাকে হামলায় যুক্তরাজ্যের যৌক্তিকতা অনুসন্ধান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সরকারের ভূমিকা তদন্তে ২০০৯ সালে স্যার জন চিলকটকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ সাত বছর পর ঐতিহাসিক এই প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। চিলকটের নাম অনুসারেই এ রিপোর্টকে চিলকট প্রতিবেদন বলা হচ্ছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরাক হামলায় যুক্তরাজ্যের অংশগ্রহণে কোনো যৌক্তিক ভিত্তি ছিল না। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ইরাকে হামলা চালানোর দায়ে এখন তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন। টনি ব্লেয়ারের উপপ্রধানমন্ত্রী জন প্রেসকটও বলেছেন, ইরাকে আক্রমণ ছিল অবৈধ। এখন এ কথাও বলা হচ্ছে, ইরাক হামলায় সাদ্দামের অনুসারীদের যে নির্মূল প্রক্রিয়া চলে তার কারণেই আইএস সৃষ্টি হয়েছে। সাদ্দামের বেশিরভাগ অনুসারীদের নিয়েই আইএস গঠিত হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, আইএস সৃষ্টির মূল কারণ ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা এবং এ হামলায় তারাই আইএস সৃষ্টির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এর জের এখন বিশ্বকে টানতে হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইএস বলে কিছু নেই। এটা একটি প্রতিরোধ শক্তি। এ নামে না হোক অন্য কোনো নামে হলেও এর আত্মপ্রকাশ ঘটত। কারণ যারা এতে যোগ দিয়েছে তারা ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার যেসব দেশে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা চালিয়েছে তার বিরুদ্ধেই একটা প্রতিরোধ শক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছে। বলা বাহুল্য, নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো কোনো কিছুকে আঘাত করলে সেও সমান শক্তিতে তা প্রতিরোধ বা বল প্রয়োগ করে। অর্থাৎ ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া থাকবেই। এ হিসেবে অতি দুর্বল শ্রেণীকে যদি শক্তিধর কেউ আঘাত করে, তবে সমানভাবে না হলেও তার যতটুক শক্তি আছে তা দিয়ে প্রতিরোধ করে। আইএস মূলত সেই ক্রিয়ারই একটি প্রতিক্রিয়া। ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসী শক্তি যদি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক হামলা না করত, তাহলে হয়তো আজকের এই আইএস সৃষ্টি হতো না। কারণ ইরাক হামলার বিপক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বেশিরভাগ সদস্যই রাজি ছিল না। তারা চেয়েছিল হামলা না চালিয়ে সাদ্দাম হোসেনের প্রতি চাপ অব্যাহত রাখতে। ইঙ্গ-মার্কিন চক্র এসব কথায় কান না দিয়ে গোয়ার্তুমি করেই হামলা চালায়। ইরাক নামক সমৃদ্ধ একটি দেশ তছনছ করে দেয়। গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত করে তোলে। তাদের আগ্রাসী পরিকল্পনা বিস্তৃত করে। আরব বসন্তের ধোঁয়া তুলে স্বৈরাচারা সরকার হটানোর নামে লিবিয়া, সিরিয়া, তিউনিসিয়াসহ আরব বিশ্বে ঝড় তোলে। লিবিয়ার মতো একটি সমৃদ্ধ দেশ যার মাথাপিছু আয় ছিল ৪০ হাজার ডলার, সেই দেশটিকে তছনছ করে সেখানের জনগণকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করে। শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব উস্কে দিয়ে যুদ্ধ বাধিয়ে সমৃদ্ধ দেশগুলোকে বিরান করে দেয়। দেশগুলোর লাখ লাখ মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। এর ঢেউ লাগে ইউরোপের দেশগুলোতে। উদ্বাস্তু এসব মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে মরণ সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের দিকে ধাবিত হয় এবং হচ্ছে। অন্যদিকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলা প্রতিরোধে কথিত জঙ্গি সংগঠন শক্তি সঞ্চয় করে। তারা ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে একের পর এক চোরাগোপ্তা বা আত্মঘাতী হামলা শুরু করে। এই সন্ত্রাসী হামলা যে ইঙ্গ-মার্কিন হামলারই প্রতিক্রিয়া তা বোধ করি বিস্তারিত ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে ইঙ্গ-মার্কিন চক্র হামলা চালিয়ে এবং নিজেদের পছন্দের সরকার বসিয়ে কি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? পারেনি। বরং পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। অবশ্য এতে তাদের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। কারণ বিশ্বে কোথাও যদি যুদ্ধ-বিগ্রহ না থাকে, তবে তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের উৎপাদিত অস্ত্র বিক্রি হবে না। কাজেই অস্ত্র বিক্রি করতে হলে যুদ্ধ বাধাতেই হবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ইঙ্গ-মার্কিন চক্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার যে কথা বলছে তা ¯্রফে ভ-ামি ছাড়া কিছু নয়। বরং তারা এই সন্ত্রাসবাদকে জিইয়ে রেখেছে এবং তাদের অপছন্দের বা তাদের কথা মতো চলে না এমন দেশগুলোর বিরুদ্ধে এক ধরনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। এখন নজর দিয়েছে বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশে আইএস নামক জঙ্গি সংগঠনটিকে ব্যবহারে উঠেপড়ে লেগেছে। বিগত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিক সিলেক্টিভ কিলিং এবং গুলশান ও শোলাকিয়ায় যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তাতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা সরকারের তরফ থেকেও বলা হয়েছে। এ কথার যে ভিত্তি রয়েছে তা এখন একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারছে। বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য অনেক দিন ধরেই ইঙ্গ-মার্কিন চক্র চেষ্টা চালাচ্ছে এমন একটি ধারণাও বিশ্লেষকরা করছেন। সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা নিয়ে এ চক্রের অতি উদ্বেগ প্রকাশ, সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলে অতি উৎসাহ দেখানো এবং যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর থেকে একটি বিষয় যদি কারো কাছে প্রতীয়মান হয়, ‘সর্প হয়ে দংশন, ওঝা হয়ে ঝাড়া’- তবে তা একেবারে অযৌক্তিক হবে না।
চার.
আমরা মনে করি, বাংলাদেশকে ইঙ্গ-মার্কিন চক্রের ফাঁদে পা দেয়া থেকে সতর্ক থাকতে হবে। কোনো ধরনের ভুল করা চলবে না। কারণ অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে, এই চক্র তার অভিলাষ পূরণে এখন আগের চেয়ে বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের একটি ভিত্তি দেয়ার জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সচেতন মহল থেকে ইতোমধ্যে জাতীয় ঐকমত্যের দাবি উঠেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের একার পক্ষে কঠিন। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক সংকটের কারণেই দেশে উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটছে। এটা বিদেশি চক্রের দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রের ফসল। দেশকে অস্থিতিশীল করতে নেপথ্যে থেকে তারা এ কাজ করছে। দুই প্রধান দলকে দু’রকম বার্তা দিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভ্রান্ত করেছে, এখনও করছে। এ ক্ষেত্রে চক্রটি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন থেকে বিএনপিকে বাইরে রাখতে পেরে বড় সাফল্য অর্জন করে। রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকেও দলটিকে বাইরে রাখতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে সরকারও জনসমর্থনের বাইরে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। প্রধান প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে তাকে সংকুচিত করে ফেলে। এর ফলে রাজনীতির মাঠে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয় সেখানে বিদেশি ঐ চক্রটির মিশন ‘জঙ্গি গোষ্ঠী’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখন তা আশঙ্কা ও আতঙ্কের পর্যায়ে পৌঁছেছে। যে ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ঘটে চলেছে তা সাধারণ কোনো আইনশৃঙ্খলাজনিত অবনতি নয়। ফলে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে এ ধরনের ঘটনা সামাল দেয়া সহজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য। এক্ষেত্রে জেদ ও গোয়ার্তুমি করা হবে ভুলের নামান্তর। এ সময়ে ভুলেও ভুল করার সুযোগ রাখা উচিত নয়। সরকারকে এ বিষয়টি বুঝতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন