মেহেদী হাসান পলাশ
২০১৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। এ অধ্যায় গৌরবের নয়, লজ্জার, পরাজয়ের। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের বুকে পরিচিত করিয়ে দেবার লক্ষ্যে এক কাপুরুষোচিত হামলার জন্য ইতিহাসে এই দিনটি চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দিনে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে পরিচালিত সন্ত্রাসী হামলায় ২০ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানী, ১ জন ভারতীয় ও ৩ জন বাংলাদেশী রয়েছেন। এ ছাড়াও ৩০ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা ও নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো কয়েকজন। হামলা শুরুর ৯ ঘণ্টা পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ইউনিট অভিযান চালিয়ে হামলাকারী সন্ত্রাসীদের হত্যা করে জীবিত জিম্মিদের উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। গুলশানের এই হামলার ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই ৭ জুলাই ২০১৬ উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের সিকিউরিটি চেকপোস্টে হামলা করে সন্ত্রাসীরা। এদিন তাদের হামলায় ২ পুলিশ, ১ হামলাকারী ও ১ গৃহবধূ নিহত হন।
সন্ত্রাসবাদ বর্তমান বিশ্বের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের কোনো দেশই এই সন্ত্রাসবাদের কবল মুক্ত নয়। কাছাকাছি সময়ের মধ্যে প্যারিসে দুইবার বৃহৎ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটলো। হামলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, টার্কিতে। ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের কথা না বললেও চলে। দেশগুলোর কোনো কোনোটিতে বিগত দুই দশক ধরে যুদ্ধ চলছে।
গুলশানের হামলার পর বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো শুরুতে হামলার ঘটনা লাইভ সম্প্রচার করলেও পরে র্যাব মহাপরিচালকের অনুরোধে লাইভ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। তবে সিএনএন, বিবিসি, এনডিটিভিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিউজ চ্যানেলগুলো প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে গুলশান হামলার ঘটনা লাইভ সম্প্রচার করে। শোলাকিয়ার হামলা বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো লাইভ সম্প্রচার না করলেও বিদেশী টিভি চ্যানেলগুলো ঘটনাকালে লাইভ সম্প্রচার ও লাইভ এক্সপার্ট অপিনিয়ন সম্প্রচার করে। আন্তর্জাতিক বহুল প্রচারিত গণমাধ্যমগুলো যদি লাইভ সম্প্রচার অব্যাহত রাখে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর লাইভ সম্প্রচার বন্ধ রেখে কতোটুকু ফায়দা হাসিল সম্ভব তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, গুলশান হামলাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যেভাবে নিউজ করছে তা বিদেশের মাটিতে সংঘটিত অনেক হামলার তুলনায় অনেকের কাছেই বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। এ ঘটনায় আমাদের টিভি ও অনলাইনের চেয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে এডভান্স খবর অনেক বেশী প্রকাশ করতে দেখা গেছে। কাজেই গণমাধ্যমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত যদি গ্রহণ করতেই হয় তবে দেশীয় গণমাধ্যমের আগে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
হামলার দায় আইএস স্বীকার করেছে। বিদেশী শক্তিগুলো বিশেষ করে পাশ্চাত্যের শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আইএসের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে এসে এই অভিযোগ অস্বীকার কবে বলতে শুরু করেছে যে, বাংলাদেশে কোনো আইএস সন্ত্রাসী নেই। এখানে যেসব সন্ত্রাসী তৎপরতা সংঘটিত হচ্ছে তা হোম গ্রোন টেরোরিস্ট বা স্থানীয় সন্ত্রাসীদের কাজ। কিন্তু গুলশানকা-ের পর আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো তাদের প্রচারণার পালে জোরালো বাতাস পেয়েছে। অনেকের মতে, বাংলাদেশে আইএস থাক বা না থাক, তার প্রভাব থাকতে পারে। গুলশানে হামলাকারীরা স্থানীয় সন্ত্রাসী তবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ থেকে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকতে পারে। আইএস প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, আইএসের পূর্ণ নাম ইসলামিক স্টেট। আইএসের আরো একটি নাম আছে ইসলামিক স্টেটস অব ইরাক এন্ড সিরিয়া (আইএসআইএস) অথবা ইসলামিক স্টেটস অভ ইরাক এন্ড দ্য লেভান্ট (আইএসআইএল)। আরব বসন্তের আবসানের পর ২০১৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যে এই গোষ্ঠীর জন্ম। কারা এর জন্মদাতা? এ ব্যাপারে আমরা পাশ্চাত্যের রাজনীতিবিদদের বক্তব্য উল্লেখ করতে পারি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জানিয়েছেন, ইরাকে বুশ প্রশাসনের সামরিক অভিযানের ফলেই জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ (আইএস)-এর দ্রুত উত্থান ঘটেছে। অবশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলেছেন রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী স্যান্টোরাম। আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ওরল্যান্ডোতে রিপাবলিকান দলের এক সভায় স্যান্টোরাম বলেন, সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে আইএস সৃষ্টির জন্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন দায়ী। কিউবার সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো আইএসের উত্থানের পেছনে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন। আলোচিত ও পলাতক সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা এডওয়ার্ড স্নোডেন বলেছেন, ব্রিটিশ, আমেরিকা ও ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা একত্রে আইএস সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন, ইরাক যুদ্ধের পর দেশটির সেনাবাহিনী থেকে বাথ পার্টির সমর্থকদের সরিয়ে দেওয়ার মার্কিন পরিকল্পনাই ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর উত্থান ঘটিয়েছে। পাশ্চাত্যের এরকম আরো অনেক রাজনীতিবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মন্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়া যায়। যাতে দেখা যায়, পাশ্চাত্যের ‘ভুল নীতির’ কারণেই আইএসের জন্ম। প্রশ্ন হচ্ছে, পাশ্চাত্যের ‘ভুল নীতির’ কারণে সৃষ্ট আইএসের দায় মুসলিম বিশ্ব কেন নেবে? মুসলিম বিশ্বে আজ এমন শক্তিশালী নেতৃত্বের বড়ই অভাব যারা পাশ্চাত্যের মুখের উপর এই প্রশ্নটি জোরালোভাবে রাখতে পারে?
তবু প্রশ্ন থাকে, আইএস সৃষ্টি কি আসলেই পাশ্চাত্যের ‘ভুল নীতি’? নাকি মুসলিম বিশ্বকে দলনের জন্য ইসলামবিরোধী শক্তিগুলোর সৃষ্ট একটি ফিতনা এটি- পরিকল্পিতভাবে পাশ্চাত্য যার নাম দিয়েছে আইএস। আইএস বা ইসলামিক স্টেট মুসলমানদের জন্য একটি অতি আকাক্সিক্ষত, আদরণীয় ও আদর্শ বিষয়। কিন্তু ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো ইসলাম ধ্বংসকারী একটি ফিতনাকে আইএস বা ইসলামিক স্টেটস নাম দিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যাতে পাশ্চাত্য তো বটেই, মুসলিম দেশগুলোও এখন আইএসকে গালি দিচ্ছে। নিজেকে, নিজেদের সন্তানদের আইএস থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। দুর্ভাগ্য হলো, আইএস সৃষ্টি ও পরিচালনায় তারা মুসলিম সন্তানদের সফলভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে। অবশ্য এর কারণগুলোও তাদের সৃষ্টি করা। খিলাফতের অবসানের পর থেকে ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বের উপর নানাভাবে উপনিবেশবাদ, দুঃশাসন, নিপীড়ন চাপিয়ে দিয়েছে। যা মুসলিমদের ক্ষুব্ধ হবার ও ইসলামবিরোধী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ায় ইন্ধন জুগিয়েছে। এই প্রতিবাদী শক্তির একটি অংশকে বিভ্রান্ত করে ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো সন্ত্রাসবাদী কাজে লিপ্ত করেছে।
আইএস সৃষ্টির আরো একটি কারণ রয়েছে যা অর্থনীতি- যুদ্ধ অর্থনীতি। মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির নিয়ন্ত্রণ, আইএস অধিকৃত এলাকাগুলো তেল সম্পদ অল্প দামে ক্রয় করা ও আইএসের কাছে অস্ত্র বিক্রিও এগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক প্রতিবেদনে ইসলামিক স্টেট (আইএস)-কে ২০টি দেশের ৫১টি প্রতিষ্ঠানের সামরিক রসদ সরবরাহ করার বিষয়টি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে, ‘কনফ্লিক্ট আর্মামেন্ট রিসার্চ’ (সিএআর) নামের একটি সংস্থার পরিবেশন করা তথ্যের ভিত্তিতে৷ ২০টি দেশের তালিকায় তুরস্ক, ভারত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, রোমানিয়া, রাশিয়া, নেদারল্যান্ডস, চীন, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া আর চেক প্রজাতন্ত্রের মতো দেশের নামও রয়েছে। সিএআরের এই তালিকা থেকে দেখা যায়, একমাত্র টার্কি ছাড়া বাকি সকল অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ অমুসলিম। আইএসকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রসদ সরবরাহ করার সঙ্গে জড়িত ভারতীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭টি। গুলশানে হামলাকারীরাও তাদের ভয়ানক যুদ্ধাস্ত্র একে-২২ অটোমেটিক রাইফেল ভারতের বিহার থেকে সংগ্রহ করেছিল। বাংলাদেশে এই সন্ত্রাসী হামলারও অর্থনৈতিক দিকটিও উপেক্ষণীয় নয়। গুলশানের হামলায় ৭ জাপানী ও ৯ ইতালীয় নাগরিক নিহত হয়েছে। বাংলাদেশে আগেও জাপানী ও ইতালীয় নাগরিক এই সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়ে নিহত হয়েছে। দুইটি দেশই প্রশ্ন তুলেছে, বারবার কেন তাদের দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদী হামলার শিকার হতে হবে? জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে উন্নয়ন সহযোগী দেশ। তারাই সবচেয়ে বেশী নিঃশর্ত বা সহজশর্তে ঋণ অনুদান দিয়ে থাকে বাংলাদেশকে। অন্যদিকে ইতালী বাংলাদেশের প্রধান রফতানী খাত গার্মেন্টস পণ্যে অন্যতম বায়ার। ইউরোপীয় মার্কেটের গার্মেন্টস পণ্যের অর্ডার ইতালীয় বায়াররা বাংলাদেশে নিয়ে আসে। গুলশানে হামলার পর এই দুটি দেশ ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তাদের নাগরিকদের ভ্রমণ সঙ্কুচিত করেছে। ব্যবসা সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। গুলশানের হামলা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক রেমিট্যান্স আয়ের জনশক্তি খাতও প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশী জনশক্তি প্রশ্নবিদ্ধ ও সদ্বিগ্ধ হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে জনশক্তি মার্কেটেও। শুধু তাই নয়, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় সেক্টর হিসাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিপুল পরিমাণ ছাত্রছাত্রী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে যাদের অনেকেই হয়তো বিদেশের মাটিতে লেখাপড়া করতে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এতে শুধু মেধা পাচার রোধ বা দেশীয় মুদ্রাই সাশ্রয় হতো তাই ই নয়, এসব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশী ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করতো যার মাধ্যমেও বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। গুলশান হামলা সরাসরি বাংলাদেশে অর্থনীতির এই সেক্টরগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আর এর ফায়দা লুটবে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো।
আইএস সৃষ্টির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম শক্তি ও ইসলামী তৎপরতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ সরকার যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছে তার বেশিরভাগই ইসলামকে টার্গেট করে। অথচ বাংলাদেশের ইসলামী শক্তি কোন দিনই সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি। জেএমবি থেকে শুরু করে আনসারুল্লাহ বাংলাটিম কোন শক্তিই বাংলাদেশের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতার কাছে প্রশ্রয় পায়নি। জেএমবিকে হীনবল করতে পারার মূল কারণ এখানেই। বাংলাদেশের সমাজে ঠাঁই না পেয়ে জেএমবি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এ দৃষ্টান্ত সকলের জানা থাকা সত্ত্বেও গুলশান হামলার জন্য বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের দিকেই। বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের সাথে বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার সম্পর্ক ক্ষীণ। জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, তার ভাই আতাউর রহমান সানী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সেকেন্ড ইন কমান্ড বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। তারপরও বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সন্ত্রাসবাদ গবেষকরা জঙ্গিবাদ দমনে মাদ্রাসা শিক্ষাকেই টার্গেট করেছে। তাদের দাবী মেনে সরকার ইসলামী শিক্ষাকে যতটা সম্ভব সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তিত করেছে। সেখানে এখন মহানবীর জীবনীর পরিবর্তে শ্রীকৃষ্ণ ও রামের জীবনী পড়ানো হয়। কিন্তু আবারো দেখা গেল সন্ত্রাসীরা মাদ্রাসায় নয়, আইবিএ, নর্থ সাউথ, ব্র্যাকের মতো নামকরা ও ব্যয়বহুল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তারপরও সরকারের নজরদারি মসজিদের উপর, নিয়ন্ত্রিত হলো জুমার খুতবা। বিশ্বের কোনো অমুসলিম দেশও উইকলি জুমার খুতবা নিয়ন্ত্রণ করেনি। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, এখানে এখন দিল্লী শাহী মসজিদের আবদুল্লাহ বুখারী কিংবা আসাদ উদ্দীন ওয়াইসির মতো ইমাম ও নেতা দৃশ্যমান নয়। সন্ত্রাসবাদ আতঙ্কে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে মুসলিম জনগোষ্ঠী ভয়ে সিটিয়ে থাকে কখন কে কার গায়ে সন্ত্রাসী তকমা লাগিয়ে হয়রানির মুখে ঠেলে দেয়। ফলে তারা গুটিয়ে নিয়েছে তাদের স্বাভাবিক তৎপরতা।
গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর বিদেশী শক্তিগুলো বাংলাদেশকে সহায়তার নামে সেদেশের সেনাবাহিনী পাঠাতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল-আলম হানিফ গণমাধ্যমে এর সত্যতা স্বীকারও করেছেন। তবে সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এ জন্য যে, সরকার শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বিদেশী বাহিনীকে বাংলাদেশে ঢোকার অনুমোদন দেয়নি। অবশ্য এ দুটি হত্যাকা- তদন্তে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশের তদন্তকারী দলের সাথে যৌথভাবে কাজ করছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে। সেটিও অস্বাভাবিক নয়। কারণ গুলশান আক্রমণে বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিক মারা গেছেন। এ ছাড়াও অতীতে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বড় সন্ত্রাসবাদী ঘটনায় আমরা বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের দাবীর সাথে তাল মিলিয়ে এফবিআই, স্কর্টল্যান্ড ইয়ার্ড, ইন্টারপোলের মতো সংস্থাগুলোকে তদন্ত করতে দেখেছি। তবে এসব তদন্তে তারা কি পেয়েছে তা জাতি আজো জানতে পারেনি। তাছাড়া জঙ্গিবাদ এখন আন্তঃসীমান্ত সমস্যা। ভারতের পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখতে পাচ্ছি, গুলশান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ভারতে অবস্থান করছেন। এই হামলার অস্ত্র ভারত থেকে এসেছে। হামলাকারীদের অনেকেই হামলার আগে ভারতে অবস্থান করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের মিসিং আরো অসংখ্য তরুণ ভারতে অবস্থান করছে। কাজেই সন্ত্রাসবাদ সমস্যা মোকাবেলা কোনো একক শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বাস্তবতা। তবে তা অবশ্যই দেশীয় সার্বভৌমত্বের নিরিখে হওয়া উচিত।
আইএসের স্বীকারোক্তির ফলে যদি বাংলাদেশে বিদেশী সৈন্যের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা থাকে তাহলে অস্বীকার করাকে সমর্থন না করার কোনো কারণ নেই। অনেক সময় আমরা দেখি, বাইরের লোকের হাতে সন্তান অপমানিত হওয়ার চিন্তা করে পিতামাতা প্রকাশ্যে বা জনসমক্ষে সন্তানের দোষ গোপন করে থাকে। কিন্তু বাড়িতে এনে সন্তানকে শাসন করে থাকে। সরকারকেও বাংলাদেশে আদৌ আইএস সন্ত্রাসী আছে কিনা তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। জেএমবির উত্থানকালে বিএনপি-জামায়ত সরকার জেএমবিকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে উপেক্ষা করেছিল। কিন্তু ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি সারাদেশে বোমা হামলা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল তারা কি ভীষণভাবে বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল। আইএসের ক্ষেত্রেও এমন দৃষ্টান্ত পুনঃস্থাপিত হোক এমনটা কেউ প্রত্যাশা করে না। সে কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের অস্তিত্ব খুঁজতে জোরালো তৎপরতা থাকা উচিত। রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়িতে সময় অতিবাহিত না করে আইএস তৎপরতা বাংলাদেশে আদৌ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। বাংলাদেশে সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের লালনের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশীদের কাছে উপস্থাপন করেছে। এক পক্ষ অন্যের দিকে আঙুল তুলে বলেছে তারা সন্ত্রাসবাদের সাহায্যে ক্ষমতায় যেতে চায়, অপরপক্ষের অভিযোগ ক্ষমতায় থাকতে সরকারই সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টি করেছে। বিদেশীদের দরজায় এই কাদা ছোড়াছুড়ির সুযোগই নিয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো। কাজেই এখন উচিৎ বিভেদ বিসম্বাদ ভুলে জাতীয় দুর্যোগের দিনে ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাসবাদের ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষা করা। ক্ষমতায় থাকা ও ক্ষমাতায় যাওয়ার হিসেব তুলে রেখে দেশকে ভয়াবহ দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করা। কেননা দেশ না থাকলে কেউই ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না, ক্ষমতায় যেতেও পারবেন না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে পেশাজীবী ও আমলাদেরও ভূমিকা রাখতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি একসাথে বসতে অপারগ হয় তবে পেশাজীবীদের এগিয়ে এসে রাজনীতিবিদদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যেন তারা একসাথে বসতে বাধ্য হন। সন্ত্রাসী হামলা দেশের অর্থনীতির উপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। কাজেই দেশের বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো থেকে দুই রাজনৈতিক গ্রুপের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যান্য সামাজিক শক্তিগুলোকেও দুই জোটের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যেন তারা একসাথে বসে ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় এই মহাদুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম হয়। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ যদি ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয় কেবল তাহলেই এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। এর সাথে অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে, দেশের মধ্যে কার্যকর গণতন্ত্র, জনগণের ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা চর্চার সুযোগ দিতে হবে, যেন অধিকার ক্ষুণœ মানুষ অধিকার ফিরে পেতে চরমপন্থার আশ্রয় না নেয়। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক উপায়ে তারা তাদের সাংবিধানিক ও মানবাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়।
সম্প্রতি কাশ্মীরে নিহত হিজবুল মুজাহিদীন নেতা বুরহান উদ্দীন মুজাফ্ফর ওয়ানির জানাজায় কারফিউ উপেক্ষা করে কাশ্মীরের হাজার হাজার জনতা শরিক হয়। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও শোলাকিয়ায় নিহত সন্ত্রাসী আবিরের লাশ নিতে তার বাবা-মা অস্বীকার করায় কিশোরগঞ্জের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। আবিরের জানাজায় মাত্র একজন অংশ নেন এবং তিনি হলেন কবরস্থানের তত্ত্বাবধায়ক। গুলশানের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সন্ত্রাসীদের লাশ এখনো হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে। তাদের পরিজনরা লাশ নিতে আসেনি। এটাই আসল বাংলাদেশ- যার নজির বিশ্বে বিরল। সন্ত্রাসবাদের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব চরমভাবে এই দুটি ঘটনায় ফুটে উঠেছে। এই বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা কখনই সফল হবে না যদি আমরা বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি। আমাদের রাজনীতিবিদরা সেই সুযোগ দেবেন কি?
email:palash74@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন