মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী থাকবে কি থাকবে না এ নিয়ে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বছরের ছয় মাস চলে গেছে। হঠাৎ শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিলেন প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম থেকে বর্ধিত করে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হলো। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা হবে না। পরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নতুন কিছু নয়। এটা ২০০৯ থেকে চলে আসছে। শিক্ষার্থীরা এই পরীক্ষায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মান উন্নয়ন হয়েছে। আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক দায়সারাভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতেন, তারা যেমন মনোযোগী হয়ে উঠেছিলেন, তেমনি পড়াশোনার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ বেড়েছিল। পরীক্ষা নামক ভীতি তারা কাটিয়ে উঠেছিল। নিঃসন্দেহে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত ছিল এই সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। এই পরীক্ষার কারণে শিক্ষা থেকে ছাত্রছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার কমেছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্র্থীদের সংখ্যা বেড়েছিল। মোদ্দাকথা প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। প্রশ্ন হলো, কেন এই সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের প্রশ্ন উঠল। বাতিল করলে সুফলই বা কি? বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে। আসলে কি তাই।
২০০৯ থেকে এই সমাপনী পরীক্ষা হচ্ছে। এত দিন পড়ে মনে পড়ল চাপের কথা! এই পরীক্ষাকে শিক্ষার্থীরা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে। বাড়তি চাপ অনত্র। সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয়েছে। দুর্বেধ্য এই পদ্ধতিই যেন শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি বোঝা। কারণ শিক্ষার্থীরা তো বটেই। যারা শিক্ষাদান করেন, সেই শিক্ষকরাই এই পদ্ধতি কতটা বুঝে উঠতে পেরেছেন? সেটা একটা প্রশ্ন। নিজে না বুঝলে তারাই বা শিক্ষার্থীদের কী বুঝাবেন। হুট করে শিক্ষার স্তর পরিবর্তন কতটা বাস্তবসম্মত কে জানে। কারণ দেশে এক লাখ প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় তেষট্টি হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক শিক্ষা যদি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত হয়, তাহলে এসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। বাড়াতে হবে তিনটি ক্লাস। সাথে অনুসষিক সুবিধা যেমনÑ খেলার মাঠ, টয়লেট, ছেলেমেয়েদের কমন রুম ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো কি ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এমনিতেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে জায়গার অভাব প্রকট। পর্যাপ্ত ক্লাস রুম নেই। ছাত্রছাত্রীরা খোলা আকাশের নিচে ক্লাস করে। এমন খবর সংবাদপত্রে হরহামেশা দেখা যায়। আবার এই পরিবর্তন করতে শত শত কোটি টাকার দরকার। দরকার সময়ের ও। এসব কীভাবে সম্ভব হবে? শিক্ষকদেরও মান উন্নয়নের প্রশ্ন আছে। যে শিক্ষক ক্লাস ফাইভ অবধি পড়ান, সে ক্লাস এইট অবধি পড়াতে পারবেন কিনা সেটাও প্রশ্ন। দেশের অধিকাংশ স্কুলে জুনিয়র সেকশন রয়েছে। তারা এক রকম দ্বৈত শাসনের মধ্যে পড়ে যাবেন। বলা হচ্ছে, অষ্টম শ্রেণীর পরে শিক্ষার্থীরা বিভাজন হয়ে যাবেন। কেউ মানবিক, কেউ বিজ্ঞান, কেউ ব্যবসায় প্রশাসন বেছে নেবেন। এই বিভাজন শিশুদের মনোবিজ্ঞান সম্মত নয়। ২০০৩ সালে ড. মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে যে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল সেখানে দশম শ্রেণী থেকে বিভাজনের কথা বলা হয়েছিল। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রথম থেকে পঞ্চম, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম, নবম থেকে দশম এবং একাদশ থেকে দ্বাদশÑ এই চারটি স্তর বিদ্যমান। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে এই স্তর বিন্যাস করা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত, অষ্টম শ্রেণী অবধি প্রাথমিক শিক্ষাকে বর্ধিত করাÑ এসবের পেছনে কোনো রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা আদৌও করা হয়েছে কি? শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। নাকি কিছু দিন পর আবার পরিবর্তন করা হবে।
শিক্ষাক্রমে এমন ঘন ঘন পরিবর্তনের সুফল কি? কোন দেশেই কি এমনটা করা হয়? পিএসসি পরীক্ষার কারণে অভিভাবকরা অনেক সচেতন হয়েছেন। সন্তানদের পিএসসি পরীক্ষার জন্য যোগ্য করে তুলেছেন। কারণ এটা বোর্ড পরীক্ষা। এর গুরুত্ব অনেক। ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি শিখতে পেরেছে। শিক্ষার ভিতটা তাদের মজবুত হয়ে গড়ে উঠেছিল। এখন পিএসসি না থাকলে আগের অবস্থা হবে। যেনতেনভাবে ছেলেমেয়েরা শিক্ষা গ্রহণ করবে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সবার পড়াশোনা হয় না। বিশেষ করে যারা গ্রামের দরিদ্্র পরিবারের সন্তান।
সংসারে যাদের নুন আনতে পানতা ফুরোয় তারা পঞ্চম শ্রেণী বা ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে ঝরে পড়লে তাদের আর প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন হলো কই? পিএসসি, জেএসসি, এসএসসিÑ এই তিনটি পরীক্ষা পদ্ধতি এখন বহাল আছে। বেশ ভালোভাবেই শিক্ষার্থীরা এগুলো দিয়ে আসছিল। নিজেদেরকে তারা পরিণত,পরিপক্ব, যাচাই-বাচাই করতে পারছিল এই পরীক্ষাগুলো দিয়ে। অসুবিধার কিছুই ছিল না। কোচিং বাণিজ্য তো শিক্ষার সব স্তরেই হচ্ছে। সেখানে পিএসসি শিক্ষার্থীদের দোষ দিয়ে কি লাভ?
ষ লেখক : গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন