“রাত আনুমানিক সাড়ে এগারটা। আমার পিসির প্রসব বেদনা ওঠে। রক্ত ভাঙা শুরু হয়। কিন্তু বাচ্চা প্রসব হইতেছিল না। তাই সবাই বলেন হসপিটালে নেওয়াই লাগবে। হসপিটালে নেওয়ার জন্য এত রাতে গাড়ি কোথায় পাব। চিন্তায় আমরা সবাই টেনসন করছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি পাই নাই। পরিচিত অনেক সিএনজি ড্রাইবারকে অনুরোধ করি, কোন লাভ হয়নি। তারা বলে এত রাতে যাইতে পারবে না। এমন সময় আমার প্রিয় বড় ভাই রাজু দেব লিটন (উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলে) আমাকে শ্রীমঙ্গল র্যাব বাহিনীর কমন্ডার, এএসপি আনোয়ার হোসেন শামিম সারের নাম্বার দেয়। তিনি নাকি সব মানুষকে সাহায্য করেন। বড় ভাইয়ের কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করি নাই। তবুও রিরুপায় হয়ে মোবাইলে কল দিলাম। ওনি বললেন ২ মিনিটের মধ্যে রওনা হইতেছেন। বিশ্বাস করি নাই। পরে দেখি ওনি ঠিক সময়মতো তারাতারি চলে এসেছেন। আমরা আশ্চর্য হইলাম, পিসির হেটে যাওয়ার অবস্থা ছিল না। ওনি মুখে কিছু না বলে পিসিকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে তোলেন। হাসপাতালে পৌছার পর শেষ হয়নি। পিসিকে কোলে নিয়ে আবার অপারেশন রুমে দিয়া আসছেন। আমারা আশ্চর্য হলাম, এই রুকম মানুষও কি পৃথিবীতে আছে! আমার পিসির গর্ভ থেকে এক ভাই আসে, দুইজনই সুস্থ আছে। সবার আশীর্বাদ চাই, ভগবান সাহায্যকারীকে পুরুষ্কার দিয়।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ট্যাটাসে উপরের উল্লেখিত কথাগুলে লিখেছেন প্রসবকালীন জটিলতায় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার শহরতলীর দক্ষিণ উত্তরসুর এলাকার গৃহবধূ শিল্পী রানীর বড় ভাইয়ের ছেলে নির্মল পাল। শিল্পী রানীর স্বামী রঞ্জিত দাস শ্রীমঙ্গল শহরের একটি সবজির দোকানে চাকুরি করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ঝর উঠেছে র্যাব কমান্ডার এক গর্ভবতী মাকে নিজের কোলে করে হাসপাতালে পৌছান। এ বিষটি জানার পর মানবতা নামের একটি বাক্যের প্রতিফলন ঘটেছে তা অনেকেই বিশ্বাশ করতে পারলেন। আর এ মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন শ্রীমঙ্গল র্যাব-৯ ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার এএসপি মোঃ শামীম আনোয়ার হোসেন।
করোনা ভাইরাস মহামারিতে যখন মানব সভ্যতা বিশ্বব্যাপী কম্পমান, দেশের প্রতিটি মানুষের মাঝে যখন করোনা আতঙ্ক, নিজেকে নিরাপদ রাখতে সবাই যখন ঘরমুখী তখন কে রাখে কার খবর।
পাশাপাশি সারাদেশের যানবাহন চলাচল সীমিত করা হয় তখন শ্রীমঙ্গল র্যাব ক্যাম্পের কমান্ডার এএসপি মোঃ আনোয়ার হোসেন ঘোষণা দেন, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ এলাকায় কোন গর্ভবতী মায়ের প্রসবকালীন জটিলতা নিয়ে যানবাহনের সমস্যা হলে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে ফোন করার জন্য। তাহলে তিনি নিজ দায়িত্বে সেই গর্ভবতী মাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য গাড়ীর ব্যবস্থা করবেন।
নির্মল পাল জানান, র্যাব সহযোগিতা দিবে বিষয়টি জানা ছিলনা। তার প্রিয় এক বড় ভাই উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলে রাজুর জানা ছিল। নির্মল পাল মুঠোফোনে রাজুর সহযোগিতা চাইলে, এ সময় রাজু র্যাব কমান্ডার আনোয়ার হোসেন শামিমের মুঠোফোন নাম্বার দিয়ে পরামর্শ দেন র্যাবের কাছে ফোন দেয়ার জন্য। র্যাবের এই কর্মকর্তার কাছে ভয়ে ফোন দিতে চায়নি নির্মল। পরে অন্য কোন উপায় না পেয়ে নিজের ভেতরে ভয় ও আতঙ্ক নিয়েই র্যাব কর্মকর্তাকে ফোন করে তার পিসিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানান। ফোন পেয়ে দ্রুত চলে আসেন র্যাব কর্মকর্তা, এই করোনা মহামারির মধ্যে ঝুকি নিয়ে কোলে করে তার পিসিকে গাড়ীতে তোলেন ও হাসপাতালে নিয়ে নিয়ে যান, রাত তখন ১২টার কাছাকাছি। হাসপাতালে ২৭ এপ্রিল রাত অনুমান ৩টার দিকে স্বাভাবিকভাবে ভূমিষ্ট হয় এক পুত্র সন্তান। দেখতে পেল নবজাতকটি পৃথিবীর নতুন আলো। পরদিন দূপুরে শ্রীমঙ্গল উপজেলা হাসপাতাল থেকে সুস্থ অবস্থায় মা ও নবজাতক সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরেন। নবজাতক এই শিশুটির নাম রাখেন সচিন চন্দ্র দাস। র্যাব কামান্ডার শামিম ১ মে বিকেলে শ্রীমঙ্গল উপজেলার দক্ষিণ উত্তরসুর গ্রামের গৃহবধূ শিল্পী রানী পাল ও তার শিশু সন্তান সচিনের খোঁজ খবর নিতে যান।
এ বিষয়ে র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের কামান্ডার সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ আনোয়ার হোসেন বলেন, করোনার কারনে মানুষ এখন ঘরবন্দি ও কর্মহীন। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আমরা নিজেদের উদ্যোগে খাদ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। আইনশৃংখলা রক্ষা এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবিক এ কাজগুলো করার চেষ্টা করছি। মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার প্রায় হাজার খানেক মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্প থেকে।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সৃষ্টির পর র্যাবের সহকারী সিনিয়র পুলিশ সুপার মোঃ আনোয়ার হোসেন শামীম তার মানবিক কাজের মাধ্যমে ইতোমধ্যেই আলোচনায় এসেছেন। তিনি ৩৪ তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা। তার গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলাধীন উত্তর বড়বিল গ্রামে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন