কামরুল হাসান দর্পণ
কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা কেউই পছন্দ করে না। আবার কর্তৃত্ববাদ না থাকলে কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সবকিছুই বেসামাল হয়ে যায়। কর্তৃত্ববাদের নামে যদি কর্তৃত্বকারীর আচরণ এমন হয় যে, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামত তোয়াক্কা না করে একক সিদ্ধান্ত দেবেন তবে তা কারো কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায় না। কর্তৃত্বকারী স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যায়িত হন, যার গণতন্ত্রের প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। এমনও দৃষ্টান্ত রয়েছে, যিনি নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে জাহির করেন, অথচ আচরণ করেন কর্তৃত্ববাদী বা স্বৈরাচারের মতো। এ ধরনের কর্তৃত্ববাদী সরকারের সাথে জনগণের সম্পৃক্ততা খুব কম থাকে। সরকার জনগণের চিন্তাভাবনাকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। সে মনে করে, দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকা- চলছে, অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, কাজেই জনগণের কথা বলার প্রয়োজন নেই। তারা শুধু খাবেদাবে আর ঘুমাবে। তবে আমাদের দেশের জনগণ শুধু খেয়েদেয়ে ঘুমানোর এই সরল সমীকরণের মধ্যে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না। তারা কথাও বলতে চায়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখতে চায়। এতে যদি একবেলা কমও খাওয়া লাগে, তাতে তাদের আপত্তি নেই। আমাদের জনগণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এমনই। তা না হলে আইয়ুব খান উন্নয়ন করেও কেন জনগণের মন পায়নি? এরশাদও তো কম উন্নয়ন করেননি। তারপরও জনগণ কেন তাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে এবং নামিয়েই ছাড়ে? এর কারণ হচ্ছে, জনগণ কখনই গণতন্ত্রহীন উন্নয়ন পছন্দ করে না, করেওনি। আবার কিছু কর্তৃত্ববাদীর প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনও দেখা যায়। যেমন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তার বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদের অভিযোগ রয়েছে। তিনি কট্টরপন্থা অবলম্বন করে দেশ পরিচালনা করছেন এবং গণতন্ত্র চর্চা করছেন না বলে পশ্চিমারা অহরহ অভিযোগ তুলছে। অবশ্য কে কি বলল তাতে এরদোগানের কিছু আসে যায় না। জনগণ কী বলল, তাকেই তিনি গুরুত্ব দেন। জনগণ তার পাশে আছে কিনা, এটাই তার কাছে মুখ্য। তার এই মনোভাব যে কতখানি বাস্তব, তার প্রমাণ পাওয়া গেল গত শুক্রবার দেশটির সেনাবাহিনীর একাংশ যখন অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য ক্ষমতা নিয়ে নেয় তখন। ট্যাংক নিয়ে তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারার রাস্তায় নামে সেনাবাহিনীর একাংশ। রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মার্শাল ল জারির ঘোষণাও দিয়ে দেয়। এ পরিস্থিতিতে এরদোগান নিজের আইফোনের ফেস টাইম অ্যাপ ব্যবহার করে একটি বক্তব্য রেকর্ড করেন। ভিডিও বার্তাটি তার দেশের কোনো চ্যানেলে নয়, সিএনএনের তুর্কি ভাষায় প্রচারিত চ্যানেলে প্রচার করা হয়। এতে তিনি অভ্যুত্থান ঠেকাতে জনগণকে রাজপথে নেমে আসতে বলেন। সংক্ষিপ্ত বার্তায় তিনি বলেন, ‘জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, রাস্তায় নামুন এবং তাদের (অভ্যুত্থানকারীদের) জবাব দিন। তাদের কাছে ট্যাংক-কামান থাকতে পারে, কিন্তু জনগণের চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই।’ বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে! তার মুহূর্তের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাতের ঘুম হারাম করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, গোলাবারুদ নেই। আছে শুধু মনটা। এ নিয়েই ট্যাংক-কামানের সামনে শুয়ে পড়ে। গোলা ও গুলি খেতে বুক চিতিয়ে দেয়। কী অপরিসীম সাহস ও শক্তি! জনগণের এই সাহস-শক্তির কাছে মুহূর্তে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত অভ্যুত্থানকারীরা যেন বরফের মতো গলে যায়। তারা আত্মসমর্পণ করে। পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে যে মানুষটি গণতন্ত্রহীন এবং কর্তৃত্ববাদী হিসেবে পরিচিত, তার খুদে একটি বার্তায় সাড়া দিয়ে জনগণের এভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে এগিয়ে আসাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এই কর্তৃত্ববাদী ব্যক্তির প্রতি জনগণের এতো ভালোবাসা কেন? এ প্রশ্নের উত্তর সহজ। এরদোগান কর্তৃত্ববাদী। তবে তিনি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এবং অকুণ্ঠ ভালোবাসা ও সমর্থন কুড়িয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়েছেন। জনগণের কাক্সিক্ষত মতের ধারক হয়েছেন। এমনকি নিজ দেশে যারা তার কট্টর সমালোচক তারাও তার সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ জনগণের সম্মতিতে এবং জনগণই তাকে কর্তৃত্ববাদী হতে বলেছে। তিনি জনগণের কর্তৃত্বকারী হয়েছেন। জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে নিজ ইচ্ছামতো কর্তৃত্বের পথ বেছে নেননি। এমন কর্তৃত্ববাদের উদাহরণ বিশ্বে বিরল। এখন আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়েও কর্তৃত্ববাদের অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী দল ও সচেতন মহল প্রায়ই বলে, বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করে জনগণের সামনে উন্নয়নের বুলি আউড়িয়ে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে শাসক দল জোর গলায় বলছে, জনগণ তাদের সাথে আছে। অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদের সাথে আছে কি নেই, এটা বোঝারও কোনো উপায় নেই। একবার শুধু বোঝা গিয়েছিল ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বলে কিছু ছিল না। এমনকি শাসক দল আয়োজিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে দলীয় লোকজন ছাড়া সাধারণ মানুষের উপস্থিতি অতি নগণ্য থাকে। অবশ্য শাসক দলের মনোভাব দেখে এটা প্রতীয়মান হয় যে, তার কাছে তার নেতা-কর্মীই জনগণ এবং এ নিয়েই সে সন্তুষ্ট। এ ধরনের শাসক জনমত উপেক্ষিত কর্তৃত্ববাদের একটি উদাহরণ। আর জনমত সমর্থিত কর্তৃত্ববাদের উদাহরণ হচ্ছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান।
দুই.
তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। যে কোনো সংকটে অস্ত্র বা গোলাবারুদ যে শক্তি নয়, জনগণই বড় শক্তি, তা এ ঘটনা থেকে সহজে বোঝা যায়। আমরা এখন ভিন্ন ধরনের এক সংকটের মুখোমুখি, যা এর আগে কখনো দেখা দেয়নি। এই সংকট মোকাবেলায় সরকারও হিমশিম খাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কঠোর কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা দিয়েও তা মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। মাস দুয়েক আগেও সরকার তার কর্তৃত্ববাদী শাসনকে জায়েজ করার জন্য উন্নয়নের কথা বলেছে। বড় বড় প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া এবং এগিয়ে নেয়ার কথা এন্তার প্রচার করেছে। এখন ইতিহাসের ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হওয়ায় তা সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। সব উন্নয়নের কথা যেন এই সংকটের আড়ালে পড়ে গেছে। জনগণও নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তারা এখন এমন অবস্থার মুখোমুখি হয়ে যেন বলছে, ‘ভিক্ষা চাই না মা, জন্তুটিকে সামলাও।’ অর্থাৎ খাবার দেয়ার দরকার নাই, কোনো রকমে জানটি বাঁচলেই হয়। বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেই ফেলেছেন, ‘বিভিন্ন হামলার ঘটনায় আমরা আতঙ্কের মধ্যে বেঁচে আছি। আমরা স্বামী হারাচ্ছি, সন্তানহারা হচ্ছি। এরকম আতঙ্কের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য তো আমরা মুক্তিযুদ্ধ করি নাই।’ আক্ষরিক অর্থেই দেশের মানুষ শঙ্কিত। কোথাও যে স্বস্তিতে সময় কাটাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ঘরে-বাইরে কোথাও মানুষ নিরাপদ বোধ করছে না। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বিভিন্ন জায়গা ভরে ফেলেছে। রাস্তায় রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিপুল উপস্থিতি দেখে সাধারণ মানুষ ভড়কে যাচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও বলা হয়েছে, আরও হামলা হতে পারে। এর ওপর রয়েছে হামলার বিভিন্ন ধরনের গুজব। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে আতঙ্কের শেষ নেই। তাদের মনে হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করার যেন কোনো গ্যারান্টি নেই। একটি দেশের জনগণ কি এভাবে দিন অতিবাহিত করতে পারে? এর শেষ কোথায়? অন্যদিকে এই আতঙ্কজনক অবস্থার কোনো কূলকিনারাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করতে পারছে না। পারবে কী করে! জানা শত্রুর চেয়ে অদৃশ্য শত্রু যে বেশি ভয়ংকর। শত্রু জানা থাকলে তার মোকাবেলা করা সহজ। অদৃশ্য শত্রুকে মোকাবেলা করা দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজের একটি। এই কঠিন কাজ করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য সরকারের কতটা আছে, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলী পুরোপুরি উদঘাটন করতে না পারা থেকেই বোঝা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এ সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়ে কোনো একটি জটিল স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটকে গেছে। এক ধরনের ‘ডেডলক’ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়াই একমাত্র পন্থা। সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান বারবার জানানো হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণ কি ঐক্যবদ্ধ বা তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে সরকারের কি কোনো উদ্যোগ আছে? সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, জাতীয় ঐক্য ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। বলা হয়েছে, যাদের মধ্যে ঐক্য দরকার, যাদের সঙ্গে ঐক্য হলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল হবে, তাদের মধ্যে ঐক্য হয়েছে। সরকারের এ কথা থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে, ঐক্য বলতে সরকার তার ১৪ দলের জোটের কথাই বুঝিয়েছে। আর কারো সঙ্গে ঐক্য করার প্রয়োজন নেই। ক্ষমতাসীন জোটের বাইরে আরও যে দল ও বৃহৎ জোট রয়েছে, তা আমলে নিচ্ছে না। যে কথা আগেই বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল জনগণ বলতে যে শুধু তার দল ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শরিক দলকেই বোঝে, এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাই প্রতিফলিত হয়েছে। এর বাইরে যারা রয়েছে, তারা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। সরকারের এ মনোভাবের মাধ্যমে বুঝতে অসুবিধা হয় না, সরকার দেশের জনগণকে দুটি ভাগে দেখছে। এখন ক্ষমতাসীন দল যদি অনাগত ক্রাইসিস মোমেন্ট মোকাবেলায় এরদোগানের মতো জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানায়, তবে ধরে নেয়া যায় বরাবরের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও তার নেতাকর্মীদেরই রাস্তায় নামতে দেখা যাবে। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যাবে। কারণ সব সাধারণ মানুষ যে সরকারের সমর্থক এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আবার ক্ষমতাসীন দলের শতভাগ নেতা-কর্মী যে হুড়মুড়িয়ে রাস্তায় নামবে, এটা ভাবারও কারণ আছে বলে মনে হয় না। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের বাইরে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ রয়েছে, তাদের বাদ দিয়ে ঐক্য হয়ে গেছে বলা কতটা যৌক্তিক? আর সরকারের ভাষায় ‘ঐক্য হয়ে গেছে’ বলে যে কথা বলা হয়েছে, এই ঐক্য তো বিগত সাত-আট বছর ধরেই আছে। এই ঐক্যর মধ্যেই তো এতদিন ধরে চলে আসা সিলেক্টিভ কিলিং এবং গুলশান ও শোলাকিয়ার মতো ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এই ঐক্য কি এসব হামলা ঠেকাতে পেরেছে?
তিন.
সরকারের তরফ থেকে যে ঐক্য হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা কোনোভাবেই সর্বজনীন বা জাতীয় ঐক্য নয়। সরকারের এ কথায় ক্ষমতাসীন দল ও জোটের বাইরে যে বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম হওয়া স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীন দল ও তার জোটের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষকে যে আলাদা করে দেয়া হয়েছে, এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে। আরও পরিষ্কার হয়েছে, সরকার দেশের জনগণের এক অংশকে বেছে নিয়েছে এবং বিভক্তি সৃষ্টি করেই শাসন কাজ পরিচালনা করতে বদ্ধপরিকর। এর মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে যে কর্তৃত্ববাদী নেতিবাচক অভিযোগ করা হচ্ছিল, তা আরও ভিত্তি লাভ করল। সংকটকালে বিপুল সংখ্যক মানুষকে বাইরে রেখে সরকার তার কার্যক্রম কীভাবে এগিয়ে নেয়, সেটাই প্রশ্ন এবং দেখার বিষয়। ইতোমধ্যে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রপ্তানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্প ঝুঁকির মুখে। নিরাপত্তা সংকটের কারণে বায়াররা এখন বাংলাদেশে আসতে অনাগ্রহী হয়ে উঠেছেন। অনেক বায়ার অর্ডার বাতিল করেছেন। বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা আতঙ্কের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত চলতি মৌসুমে দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলারের অর্ডার হারাতে পারে। এ অশঙ্কা অমূলক নয়। আমরা দেখেছি, বিগত কয়েক বছরে অসংখ্য গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। শুধু গার্মেন্ট খাতই নয়, সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ঋণাত্মক প্রবণতার দিকে ধাবিত। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। টুকটাক যা হচ্ছে বা হওয়ার কথা, জঙ্গি হামলার কারণে তা আরও তলানিতে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশি ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের অন্যতম আবাসস্থল দেশের পাঁচতারকা মানের হোটেল ও অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলো ইতোমধ্যে ভয়াবহ ব্যবসায়িক মন্দার কবলে পড়েছে। হোটেলগুলোতে বিদেশি নাগরিকদের আগাম বুকিং ক্যানসেল করা হয়েছে। এ ছাড়া হোটেলগুলোর অন্যতম আয়ের উৎস সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ক্রেতার অভাবে অভিজাত অনেক রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানের ওপর। নতুন করে অসংখ্য কর্মজীবী বেকারের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। এরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়। দেশি-বিদেশি ব্যবসা-বাণিজ্যে যদি কর্মচাঞ্চল্যই না থাকে, তবে দেশের অর্থনীতি এগুবে কী করে? ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আপাত দৃষ্টিতে পরিস্থিতি শান্ত মনে হলেও এসব হামলা যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তার রেশ বহুদিন ধরে যে থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। সামনে যে আরও হামলা হবে না, তার কোনো গ্যারান্টি কেউ দিতে পারছে না। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যখন আরো হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, তখন দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশকে নিরাপদ ভাবার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনীতি এগোনোর আশা দূরাশা ছাড়া কিছুই নয়। আবার সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ কথাও সংবাদ সম্মেলনে স্বীকার করা হয়েছে, সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় দেশের ভাবমর্যাদা কিছুটা হলেও নষ্ট হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে আরও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা এবং দেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট হওয়ার কথা বলার অর্থ দেশের জন্য ভয়াবহ অশনি সংকতে। এই অশনি সংকেত থেকে সরকারের আংশিক ঐক্যে কীভাবে উত্তরণ ঘটবে, তা-ই দেখার বিষয়। এই সংকেত ও মহাসংকট নিয়ে সরকার তার উন্নয়ন কর্মকা- কীভাবে ও কতটা এগিয়ে নিতে পারে, তাও পর্যবেক্ষণের বিষয়। তবে সামনের দিনগুলো যে সুখকর হবে না, তা সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ সামাল দিতে দিতেই সময় পার হয়ে যাচ্ছে এবং আরও কত সময় লাগবে, তার নিশ্চয়তা নেই। সবচেয়ে বড় কথা, সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় দেশে যে আস্থা ও নিরাপত্তাহীনতার সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবেলা করে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকারকে অনেক সময় ব্যয় করতে হবে। ইতোমধ্যে বিশ্লেষকরা বলেছেন, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। আর সরকার ঐক্য হয়ে গেছে বলে যে কথা বলেছে, এই ঐক্য দিয়ে এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করা যে কঠিন, তা ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। দুঃখের বিষয়, সরকার তা করতে খুব একটা আগ্রহী নয়। এর কারণ, সরকার হয়তো মনে করতে পারে, এই ঐক্য করলে বিরোধী রাজনৈতিক জোট বড় ধরনের সুবিধা পেয়ে যাবে, আর সরকারের দুর্বলতাও প্রকাশ হবে এবং একচ্ছত্র আধিপত্য ও কর্তৃত্ববাদও খর্ব হবে। বাস্তবতা হচ্ছে, যে সরকার জনগণের ম্যান্ডেটের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতাসীন তার মধ্যে এ ধরনের শঙ্কা কাজ করা অস্বাভাবিক নয়। এর ফলে যা হচ্ছে, তা হলো, বিদ্যমান সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে।
চার.
সরকারের ঘোষিত ঐকমত্যের মধ্যে যে শুধু জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে, তা নয়। এই ঐক্যর মধ্যেই বড় বড় অনেক দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে, বিচারবহির্ভূত অনেক হত্যাকা- ঘটেছে এবং ঘটছে। আইনের শাসন এবং সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। দেশের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে প্রতিবেশী দেশের সব আবদার রক্ষা করা হয়েছে। ট্রানজিট-করিডোর দেয়া থেকে শুরু করে সুন্দরবন বিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিবেশীর স্বার্থে স্থাপন করা হয়েছে। দেশের স্বার্থ পরিপন্থী এসব ভয়াবহ ক্ষতিকর ঘটনা একটির পর আরেকটি ঘটেছে। আর এসব ঘটেছে এবং ঘটছে সরকারের ঐক্য জোটের শাসনামলের মধ্যেই। যে দলীয় ঐক্যের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব, জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধি পায় এবং দেশের স্বার্থ বিসর্জিত হয়, সেই ঐক্য কি জাতীয় ঐক্য হতে পারে? এসব ক্ষেত্রে কি জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজন নেই? পর্যবেক্ষকরা যদি মনে করেন, এটা একপেশে এবং সরকারের এক ধরনের গোয়ার্তুমি, তবে তা কি অযৌক্তিক হবে? জনগণের কাছেও কি তা গ্রহণযোগ্য হবে? আমরা মনে করি, দেশের এই সংকটকালে জাতীয় ঐক্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। যে ঐক্যের মধ্য দিয়ে জনগণকে ডাকলে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেবে। এর জন্য বিদেশি কোনো শক্তির কাছে ধরনা দেয়ার প্রয়োজন নেই। সরকারকে সরল বিষয়টি বুঝতে হবে, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া গঠিত সরকারের মেয়াদ গণতন্ত্রকে পেছনে ঠেলে বিভিন্ন কলাকৌশলে জোর করে কিছু দূর হয়তো নেয়া যেতে পারে, তবে টেনেটুনে এই নেয়ার ক্ষেত্রে যে সংকট ও জটিলতা দেখা দেয়, তা সামাল দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এতে সরকারের ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ হয়তো বাড়ে, তবে দেশের অগ্রযাত্রা ও মর্যাদা কমতে থাকে। বাংলাদেশ এখন এই পরিস্থিতির মুখোমুখি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এখন জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। এটা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, জাতীয় ঐক্য হলে বাংলাদেশকে কুরুক্ষেত্র বানানোর যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং তা কার্যকরের প্রক্রিয়া চলছে, তা মুহূর্তে উড়ে যাবে। জাতীয় ঐক্যের সামনে পৃথিবীর কোনো অপশক্তিই কোনোকালে কখনো টিকতে পারেনি। যার সর্বশেষ উদাহরণ তুরস্কে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন