মুনশী আবদুল মাননান
সন্ত্রাসবাদ বৈশ্বিক রূপ পরিগ্রহ করেছে, এ কথা অনেকেই বলছেন। স্বীকার করছেন, সন্ত্রাসবাদ এখন দেশ বা এলাকা বিশেষের সমস্যা নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, কীভাবে সন্ত্রাসমুক্ত বিশ্ব নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে মতামতের অভাব নেই। তবে দুটি অভিমতের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। এর একটি হলো, সন্ত্রাসবাদ উদ্ভবের মূল কারণ শনাক্ত করে তা উৎপাটনের পদক্ষেপ নেয়া। এ বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব লাভ করেনি বা করছে না। যতদিন মূল কারণ নির্ণয় করে তা দূর করার পদক্ষেপ নেয়া না হবে ততদিন সন্ত্রাসবাদের হুমকি ও ঝুঁকি থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, শক্তি প্রয়োগ বা সামরিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে এর সমাধান আদৌ সম্ভব নয়; বরং এতে তার আরো বিস্তৃতি ঘটতে পারে। এর নজির ইতোমধ্যেই যথেষ্ট স্পষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অনেক আগে। এ যুদ্ধ সে ও তার মিত্ররা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ পর্যন্ত এ যুদ্ধ কোনো সুফল আনতে পারেনি। উল্টো সন্ত্রাসবাদ আরো বিস্তৃত ও কঠোর হয়েছে। সুতরাং, এটি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার পথ নয়।
যে চেহারায় আমরা সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যক্ষ করছি, তার জন্য মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররাই দায়ী। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন ও দখল প্রতিষ্ঠা করে। এই আগ্রাসন ও দখলে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স প্রভৃতি রাষ্ট্র শামিল হয়। এই সম্মিলিত সামরিক হামলা ও আগ্রাসনের ফলে দুর্বল দেশটির কী অবস্থা হয়েছে, তা কারো অজানা নেই। দেশটি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ ও হানাহানি অব্যাহত রয়েছে। এরপর ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একজোট হয়ে ইরাকের ওপর সামরিক আগ্রাসন চালায় এই অজুহাতে যে, ইরাকে মানববিনাশী অস্ত্র আছে এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। এই আগ্রাসন ও যুদ্ধের ফলে ইরাকও কার্যত শেষ হয়ে গেছে। সংঘাতময়, বিশৃঙ্খলা ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এই দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের ওপর অন্যায় ও নির্বিচার হামলা ও আগ্রাসনের কারণে বিশ্ব পরিস্থিতিতে নানা উপসর্গের আবির্ভাব হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ তার একটি। পরবর্তীকালে আরব বসন্ত, জনউৎক্ষেপ ও রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন ইত্যাদির পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ঘনিষ্ঠ সংশ্লিষ্টতার কথা কারো অজানা নেই। এখানে উল্লেখ করা দরকার, টুইন টাওয়ার হামলায় যেমন আফগানিস্তানের দায় প্রমাণিত হয়নি, তেমনি ইরাকে মানববিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক হামলা চালানো হয় বলে যুক্তরাজ্যের চিলকট কমিটির প্রতিবেদনে স্পষ্টই উল্লেখ করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের প্ররোচনায় এই যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার যুক্তরাজ্যকে যুক্ত করেছিলেন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। অন্যদিকে আরব বসন্তের সুবাদে মিসর, তিউনিশিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে ভিন্ন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তাতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স প্রভৃতি রাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়ে মৎস্য শিকারে নেমে পড়ে যা ওই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে এনেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এই সা¤্রাজ্যবাদী তৎপরতা ও হস্তক্ষেপ যে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তার প্রেক্ষাপটে আইএসসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের উদ্ভব হয়েছে। এখন ওইসব সন্ত্রাসী সংগঠন মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যেমন তেমনি রাশিয়া ও তার মিত্ররাও একজোট হয়েছে। নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছে এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগের পথই বেছে নিয়েছে।
এই পথ যে ভ্রান্ত, তা বোঝা যায় সন্ত্রাসবাদের বিশ্বায়ন থেকে। এখন সন্ত্রাসবাদের হুমকি থেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া এমন কি বাংলাদেশও নিরাপদ নয়। আগ্রাসী ও সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোর হয়তো ধারণা ছিল, সন্ত্রাসবাদ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া প্রভৃতি মুসলিম দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তাদের এই ধারণা কতটা ভ্রান্ত ছিল সেটা বোঝা যায় ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, বেলজিয়াম, ইতালি প্রভৃতি রাষ্ট্রে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা থেকে। বিশেষজ্ঞরা একমত, আগ্রাসন, দমন-পীড়ন, অত্যাচার, নির্যাতন, বঞ্চনা ও বৈষম্য সন্ত্রাসবাদে উজ্জীবিত হতে প্ররোচনা দেয়। সন্ত্রাসবাদের বৈশ্বিক রূপান্তরের পেছনে এসবের ভূমিকা যে নিয়ামক, তাতে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। প্রশ্ন উঠে, এই কার্যকারণসূত্র সবার কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হওয়ার পরও কি সা¤্রাজ্যবাদী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, শান্তিবিনাশী ও মানবতাবিরোধী চক্রের বোধোদয় হবে? বাস্তবতাদৃষ্টে এখানো সেটা মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে, শক্তি প্রয়োগের ভ্রান্ত ও অকার্যকর পথ অনুসরণকেই তারা এখনো প্রাধান্য দিচ্ছে।
সম্প্রতি ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নিসে যে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তাতে গোটা ইউরোপে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ফ্রান্স নয়, অন্যান্য দেশও সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় আতঙ্কবোধ করছে। ফ্রান্স হামলার আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরো ছয় মাস বৃদ্ধি করেছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরো জোরদার করেছে। অন্যান্য দেশও নিরাপত্তা জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়েছে। নিসে সন্ত্রাসী হামলা ছিল নজিরবিহীন। একজন ট্রাকচালক ফ্রান্সের জাতীয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ট্রাক নিয়ে হামলা চালান। জনতার ওপর দুই মাইলের বেশি ট্রাক চালিয়ে ৮৪ জনকে হত্যা ও শতাধিক লোককে আহত করেন। পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যু হয়। জানা গেছে, ঘাতক ট্রাকচালক তিউনিসিয়ার বংশোদ্ভূত ফ্রান্সের নাগরিক। তার নাম মোহাম্মদ লাউইজ বুলেল। প্রথম দিকে হামলার দায় কেউ স্বীকার না করলেও পরে আইএস দায় স্বীকার করেছে। বুলেল আইএসের সদস্য ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। ফ্রান্সের পাবলিক প্রসিকিউটর ফ্রাঁসোয়া মলিয়ে জানিয়েছেন, আইএসের সঙ্গে তার সরাসরি সম্পর্কের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ইদানীং তার মধ্যে ইসলামের কট্টরপন্থি ধারার দিকে ঝোঁক লক্ষ করা গিয়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে, বুলেল যেখানে বসবাস করতেন সেই ‘আবতোরিস’ আবাসিক এলাকা থেকে নিসের দরিদ্র এলাকা আরিআনের অবস্থান কয়েক কিলোমিটার দূরে। আরিআনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মুসলমান বসবাস করে এবং তারাও অত্যন্ত দরিদ্র। বুলেল সম্পর্কে স্বজন, বন্ধু ও পরিচিতরা জানিয়েছেন, তিনি তেমন ধর্মকর্ম করতেন না। রোজা রাখতেন না। তার মদ-গাঁজায় আসক্তি ছিল। নারীর প্রতি আসক্তি ছিল। এসব ধার্মিক মুসলমানের জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খায় না। তার এই পরিচয় পাওয়ার পর অনেকেরই ধারণা, এই একক সন্ত্রাসের ঘটনার ভিন্ন কারণও থাকতে পারে। সেটা খুঁজে দেখা জরুরি হলেও ফ্রান্স সরকার যেন ধরেই নিয়েছে, আইএসের কাজ। সে মোতাবেক প্রেসিডেন্ট ওঁলাদ সিরিয়ায় আরো বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। নিজ দেশে সন্ত্রাস বন্ধের জন্য সাধারণ মানুষ হত্যায় যে বিশেষ কোনো লাভ হবে না এবং এটা ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত নয় তা বুঝতে চাননি ফরাসি প্রেসিডেন্ট।
সন্ত্রাসী হামলা যেন ফ্রান্সের পিছু ছাড়ছে না। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠেছে, বার বার ফ্রান্স কেন সন্ত্রাসী হামলার শিকার হচ্ছে? গত বছরের নভেম্বরে রাজধানী প্যারিসে স্মরণকালের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। প্রায় একই সময়ে শহরের অন্তত ছয়টি জায়গায় হামলার ঘটনা ঘটে। এই সিরিজ হামলায় দেড় শতাধিক মানুষ নিহত ও প্রায় দু’শ মানুষ আহত হয়। প্যারিসের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বাটাক্লঁ কনসার্ট হলে সবচেয়ে বড় হামলাটি হয়। কনসার্ট চলার সময় পরিচালিত এ হামলায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়। একটি হামলা হয় এক স্টেডিয়ামের বাইরে, যে স্টেডিয়ামে ফ্রান্স-জার্মানি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ চলছিল। একই সময়ে যুগপৎ হামলায় প্যারিসে একটা ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর আগে জানুয়ারিতে প্যারিসেই শার্লি এবদো নামের একটি ম্যাগাজিনের অফিসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ২০ জন নিহত হয়। আরও উল্লেখ করা যেতে পারে, বিভিন্ন সময়ে নরওয়ে, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। ফ্রান্সে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের প্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয়, সন্ত্রাসী হামলার একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্গেটে পরিণত হয়েছে ফ্রান্স। কেন হয়েছে, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের অভিমত বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। তাদের মতে, ফ্রান্সের বিদেশ ও অভ্যন্তরীণ নীতিই এর জন্য দায়ী। লক্ষ্যণীয়, সিরিয়ার ঘটনা প্রবাহে শুরু থেকেই ফ্রান্সের অংশগ্রহণ রয়েছে। আসাদবিরোধী কথিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সংগঠন, প্রশিক্ষণ অর্থায়ন ও অর্থায়নে বড় ভূমিকা রেখেছে ফ্রান্স। একইভাবে আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হয়ে সে তৎপর রয়েছে। আইএস দমনে ফ্রান্স তার সবচেয়ে বড় নিউক্লিয়ার চালিত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ‘দ্য গল’ ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন করেছে। এর আগে আফগানিস্তান ও ইরাক আগ্রাসনে ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একট্টা হয়ে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করে। লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতনেও তার ভূমিকা ছিল। এখন আইএসকেই সে তার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করেছে। এহেন আগ্রাসী বিদেশ নীতির কারণেই আইএস, আল কায়দা প্রভৃতি সংগঠন ফ্রান্সকে তাদের হামলার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যে পরিণত করেছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সসহ ইউরোপকে প্রথম সারির ক্রুসেডার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে সন্ত্রাসী হামলা ও নাগরিক হত্যার ডাক দিয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে ফ্রান্স কট্টর ক্যাথলিক খ্রীষ্টবাদী দেশ। মাঝখানে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা হলেও এখন আবার সে খ্রীষ্টবাদী নীতিতে ফিরে যেতে চাইছে। সেখানকার দক্ষিণপন্থীরা মনে করে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ক্যাথলিসিজম বাদ দিয়ে ফ্রান্স ধর্মহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তারা ফ্রান্সকে ফের কট্টর ক্যাথলিক খ্রীষ্টবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক কারণে এই দক্ষিণপন্থীরা ইসলাম ও মুসলিম বিরোধিতায় সোচ্চার। ইতিহাসবিদদের অজানা নেই, ক্রুসেডের সময় থেকেই ফ্রান্স ক্রুসেডার দেশ হিসেবে চিহ্নিত। মুসলমান ও খ্রীষ্টদের মধ্যকার ওই দীর্ঘ যুদ্ধে ফ্রান্সের ভূমিকা ও অংশগ্রহণ ছিল অনেক খ্রীষ্টবাদী দেশের থেকেও বেশী। প্রথম দিকের কয়েকটি ক্রুসেডে খ্রীষ্টান বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে জর্ডান, সিরিয়া, তুরস্ক ও ফিলিস্তিনে ব্যাপক মুসলিম গণহত্যা চালায়। এই হত্যা ও রক্তপাতের ইতিহাস কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
একদা ফ্রান্স ছিল ঔপনিবেশিক শক্তি। উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকার প্রায় সব মুসলিম দেশ ছিল তার উপনিবেশ। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে ফ্রান্স ওইসব দেশকে শুধু নির্বিচারে শোষণই করে নি, জনগণের ওপর সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতনই চালায় নি, ধর্ম, ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতির ওপর পরিকল্পিত আঘাত হেনেছে। সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ভাষার ওপর। স্থানীয় ভাষার বদলে ফরাসী ভাষা চাপিয়ে দেয়া হয়। ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের জের এখনো বহন করছে আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, মালি, সেনেগাল, আইভরিকোস্ট প্রভৃতি দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করলেও সেই স্বাধীনতা সহজে আসেনি। এর জন্য বছরের পর বছর দেশগুলোকে যুদ্ধও করতে হয়েছে। এ যুদ্ধও ছিল প্রাণঘাতী এবং এর প্রতিক্রিয়া ওই সব দেশে এখনও বিদ্যমান রয়েছে। কোনো কোনো দেশে এখনো ফ্রান্সের খবরদারী বহাল রয়েছে। আইভরিকোস্টসহ কতিপয় দেশে এখনো ফ্রান্সের সামরিক উপস্থিতি রয়েছে। সামরিক হস্তক্ষেপের নজিরও বিরল নয়। মালিতে আল কায়েদা দমনে ফ্রান্সের সামরিক অভিযানের কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে ফ্রান্সের মুসলিম বিদ্বেষ ক্রমাগত বাড়ছে। বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে আসা মুসলমানেরা সেখানে ব্যাপক বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। এখন ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার অন্তত ১০ শতাংশ মুসলিম। তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত। বৃহত্তর সমাজ তাদের গ্রহণ করেনি। দূরে সরিয়ে রেখেছে। এতে মুসলমানদের মধ্যে বিছিন্নতার বোধ সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই সঙ্গে যখন কোনো সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে, তখনই মুসলমানরা নানাভাবে পাল্টা হামলার শিকার হচ্ছে। তারা এবং তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হচ্ছে। এতে মুসলমানদের মধ্যে অসহায়ত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। হতাশা সম্প্রসারিত হচ্ছে। বৃহত্তর ফরাসী সমাজে বিভেদ-বিরোধ ও টানাপোড়েন স্পষ্ট। এমতাবস্থায়, সন্ত্রাসী হামলা ও হামলার আশংকা অস্বাভাবিক নয়। ট্রাক চালক সন্ত্রাসী ট্রাক চালিয়ে যে এত মানুষ হতাহত করলো, তার পেছনে আইএস’র প্ররোচনা কতটা দায়ী আর কতটা দায়ী তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ-বঞ্চনা ও হতাশা, সেটা নির্ণয় করা মুশকিল। মতাদর্শ দিয়ে মতাদর্শ মোকাবিলা করা যায় এবং সেটাই প্রকৃষ্ট পন্থা। কিন্তু ব্যক্তিমনকে কোনো কিছু দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ব্যক্তি যদি কোনো কারণে ক্ষুব্ধ হয়, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় এবং সন্ত্রাসীকর্মে লিপ্ত হয়, তবে তা মোকাবিলা করা অসম্ভব।
ফ্রান্সকে যদি সত্যি সত্যিই সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করতে হয় তাহলে তার আগ্রাসী বিদেশ নীতি এবং বিষম অভ্যন্তরীণ নীতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। শক্তিপ্রয়োগ ও দমনপীড়নের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়, এই সত্য অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের আগ্রাসী নীতি, দখলদারী মনোভাব, সম্পদ লুণ্ঠন, অর্থনৈতিক লিপ্সা এবং ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ পরিহার করতে হবে। এই সঙ্গে সব দেশে জনগণের অধিকার, ক্ষমতা ও নিরাপত্তা এবং আইনের শাসন, সুবিচার, মানবাধিকার ইত্যাদি নিশ্চিত হলে আপনা আপনিই সন্ত্রাসবাদের উৎসাদন হয়ে যাবে। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ নির্মূলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মূল থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। সেটা করা গেলে দ্রুতই এই উপসর্গ থেকে বিশ্বকে মুক্ত করা সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন