শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

রোজা ও চিকিৎসা প্রসঙ্গ

মুফতী মোঃ আব্দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১৫ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

শরীয়তের ব্যবহারিক বিধি-বিধান মূলত কুরআন ও সুন্নাহ্র দলীল-প্রমাণনির্ভর প্রামাণ্য হতে হয়; কেবল যুক্তিনির্ভর হলেই চলে না। আবার এই কুরআন-সুন্নাহ্রই ভাষ্য থেকে আরও দু’টি বিষয় অর্থাৎ ‘ইজমা’ ও ‘কিয়াস’ বিধি-বিধানের উৎস হিসাবে পাওয়া যায়। আর এই শেষোক্ত ‘কিয়াস’ বিষয়টির ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় ‘ইজতিহাদ’ তথা গবেষণা-অনুসন্ধান কর্মের; যার অনিবার্য অন্যতম অনুসঙ্গ হচ্ছে পারস্পরিক তুলনা ও যৌক্তিক বিবেচনা। সুতরাং এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, শরীয়তের বিধান খুঁজে বের করার ভিত্তি যে উৎস চতুষ্টয়ের ওপর তাতে ‘যুক্তি’ এর ক্রম অনুপস্থিত; তবে চতুর্থ নম্বরে যে উৎসটি রয়েছে সেই ‘কিয়াস’ বা ‘ইজতিহাদ’ এর ক্ষেত্রে যুক্তি বিষয়টি কাজে লাগে তথা সহায়ক হয়ে থাকে অবশ্যই; কিন্তু এই যুক্তির ওপর ভিত্তি করেই কেবল শরীয়তের বিধান নির্ণিত বা চিহ্ণিত বা স্থিরীকৃত হয় না। সুতরাং রোযা অবস্থায় অ্যাজমা বা হাঁপানী রোগের প্রকোপ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ‘ইনহেলার ব্যবহারের বৈধতা’র প্রশ্নে কোনো কোনো দৈনিক পত্রিকার মাসায়েল আলোচনায় কেবল এমন যুক্তি যে, “এতে খাদ্যের অভাব পূরণ হয় না; পানির অভাব পূরণ হয় না। এটি পাকস্থলীতে যায় না; ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে। এটি গ্যাস বা বাতাস মাত্র” -যথেষ্ট নয়। তার কারণ, এমন যুক্তিতে বা এটুকু যুক্তিতে যদি এক্ষেত্রে রোযা না ভাঙ্গে তা হলে ধুমপানে এবং অনুরূপ আরও বিভিন্নক্ষেত্রেও রোযা ভাঙ্গবে না। কেননা তা দ্বারাও খাদ্যের অভাব পূরণ হয় না; তা বেশি পৌঁছলে, ফুসফুস পর্যন্তই পৌঁছে এবং তা-ও গ্যাস বা বাতাস মাত্র। অথচ মুফতিদের কাছে প্রামান্য হিসাবে ধর্তব্য এমন অনেক গ্রন্থেই যুগ যুগ ধরে লিখিত হয়ে আসছে যে, “ইনহেলার ব্যবহারে (অক্সিজেন-বাতাসের কারণে নয়, তার মধ্যে ঔষধ/গ্যাস থাকার কারণে এবং ইচ্ছার সংযোগ থাকার কারণে) রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং তা সুবিধা মত সময়ে কাযা করতে হবে।” (জাদীদ ফিকহি মাসাইল, আহসানুল ফাতাওয়া, ফাতাওয়া মাহমূদিয়া, ইমদাদুল ফাতাওয়া, ফাতাওয়া ও মাসাইল-ইফা ইত্যাদি দেখা যেতে পারে)
রোযা ভঙ্গ হওয়া প্রশ্নে সাধারণ ও ব্যাপক হারে আকরগ্রন্থগুলোতে (‘আ -ম্মা’, ‘জায়েফা’ ও মূল ‘মানফায’) মস্তিষ্কে ও পাকস্থলিতে স্বাভাবিক পথে ও সরাসরি মুখের মাধ্যমে পৌঁছার কথা যেমন বলা হয়েছে; ঠিক তেমনি অস্বাভাবিক পথে যেমন কান, নাকের মাধ্যমেও যদি কোন ঔষধ, তেল ইত্যাদি মস্তিষ্কে পৌঁছে বা গলা অতিক্রম করে বা পাকস্থলিতে পৌঁছে- তাতেও রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে। সুতরাং এমন যুক্তি বা সীমীতকরন যে, পানাহারের কাজ না দিলে, তাতে রোযা ভাঙ্গবে না; কিংবা ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করলে; কিংবা পানাহারের স্বাভাবিক পথে (মুখে) না হলে রোযা ভাঙ্গবে না -এমন কোনো ‘শেষকথা’ বা ‘যুক্তি’ বাস্তবে বা সর্বক্ষেত্রে সঠিক নয়। বরং সঠিক হল, সেসব নীতি, মূলনীতি ও সুনির্দিষ্ট সমাধান যা সার্বিক বিবেচনান্তে গৃহীত হয়ে হাজার বছর ধরে বর্ণিত হয়ে আসছে এবং তাতে ‘ইজমা’-ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। যেমন:
(১) “অ্যাজমা ও হাঁপানী রোগীদের অক্সিজেন বা ইনহেলার ব্যবহারের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সমস্যা ......তার সঙ্গে যদি ওষুধের সংমিশ্রণ থাকে, তা হলে সেক্ষেত্রে আবার তাতে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে” (জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)।
(২) “ইউনানী ও আয়ূর্বেদিক বিভিন্ন ওষুধ মুখ দিয়েও খেতে হয় না; কেবল জাল দেয়া বা গরমকৃত ভাঁপ বা বাষ্প নাক দ্বারা নিতে হয়; যা তাৎক্ষণিক নাক দিয়ে গলা অতিক্রম করে বক্ষদেশ (ফুসফুস) পর্যন্ত পৌঁছে থাকে; তাতেও রোযা ভেঙ্গে যাবে” (জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)। -অথচ উক্ত আলোচিত লেখকের যুক্তি মতে তো এক্ষেত্রেও রোযা না ভাঙ্গার কথা (?) যেহেতেু পানাহারের কাজও দিচ্ছে না; আবার পাকস্থলিতেও যাচ্ছে না?
(৩) “নারীর লজ্জাস্থানে কোনো কিছু (ওষুধ ইত্যাদি) রাখলে বা ব্যবহার করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে” (প্রাগুক্ত: পৃ-১৮১)। -এক্ষেত্রেও তো উক্ত লেখকের যুক্তি মতে, রোযা ভঙ্গ হওয়ার কথা নয় (?) কারণ, এতেও পানাহারের কল্যাণ বা পাকস্থলিতে সরাসরি দেয়া হচ্ছে না ?
(৪) “নাক , কান ও মলদ্বারের পথে পাকস্থলীতে বা মস্তিষ্কে পৌছতে পারে -এমন ওষুধ এ সব স্থানে ব্যবহারেও রোযা ভঙ্গ হয়ে যায়” (প্রাগুক্ত)। -অথচ উক্ত লেখকের বক্তব্য মতে, যেহেতু সরাসরি পাকস্থলিতে দেয়া বা নেয়া হচ্ছে না, তাই রোযা ভাঙ্গার কথা নয়?
(৫) “পায়খানা বন্ধ হওয়া অবস্থায় ‘অনিমা’ (বা ‘সাপোজিটর’) নেয়া হয় সেক্ষেত্রে ওষুধস্বরূপ তা আভ্যন্তর ভাগে লাগানো হয় । এতে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং তার ওপর কাযা করা ওয়াজিব হবে” (মাসায়েলে রোযা : রফয়ত কাসেমী, পৃ-১৩২, দেওবন্দ)। -অথচ উক্ত লেখকের বক্তব্য মতে, এক্ষেত্রেও রোযা ভঙ্গ হবে না? কেননা তা তো পাকস্থলিতে নেয়া হয়নি?
(৬) “হোমিও প্যাথিক ওষুধ যা কেবল ঘ্রাণ নিলেই মুখদ্বারা সেবনের অনুরূপ ফলদায়ক, উপকারী হয়” +“ইনজেকশন দ্বারা রোযা ভঙ্গ হয় না; কিন্তু তার মাধ্যমে যদি পাকস্থলিতে ওষুধ পৌঁছানো হয় তা হলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে” (ফাতাওয়া মাহমূদিয়া: খ-১৭, পৃ-১৬৬-১৬৭)। -অথচ উক্ত লেখকের বক্তব্য মতে, রোযা ভঙ্গ হবে না? কেননা, তা তো পাকস্থলিতে নেয়া হয়নি (?)
(৭) “ডুশ ব্যবহার বা হাঁপানীর প্রকোপ নিরসনে গ্যাস জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের দ্বারা রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে” (ফাতাওয়া ও মাসাইল: খ-৪, পৃ-৪১,ইফা)। -অথচ উক্ত লেখকের বক্তব্য মতে, ডুশ-গ্যাস এ সবে রোযা ভাঙ্গে না!
(৮) “নাকে ওষুধ দিলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। কেননা নাকের দিক থেকে গলা’র দিকে স্বাভাবিক পথ বিদ্যমান”(খানিয়া + হিন্দিয়া: ১/২১০) -অথচ উক্ত লেখকের মতে, তাতে রোযা ভঙ্গ হবে না । তার কারণ, তা তো পাকস্থলিতে নেয়া হয়নি এবং পানাহারের কাজও তা দ্বারা পূর্ণ হয়নি!
মোটকথা, সহীহ বিধানটি হল, ‘ইনহেলার ব্যবহারে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তবে রোযা অবস্থায় অসহনীয় মাত্রায় হাঁপানীর প্রকোপ দেখা দিলে ইনহেলার অবশ্যই ব্যবহার করতে পারবেন; কিন্তু ওই রোযাটি পরবর্তিতে সুবিধা মতে কাযা করে নিতে হবে।’
কোন্ কোন্ চিকিৎসায় রোযা ভাঙ্গবে না:
“শুধু অক্সিজেন গ্রহণের কারণে রোযা নষ্ট হবে না; কারণ তা সাধারণ বাতাস গ্রহণেরই নামান্তর। কিন্তু তার সঙ্গে ঔষুধ থাকলে রোযা নষ্ট হবে” (জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)।
“ঔষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে মহিলাদের মাসিক স্রাব বন্ধ রেখে ত্রিশ রোযা পূর্ণ করে নেয়া বৈধ। এতে কোন পাপ হবে না। তবে মাসিকের সাধারণ গতি বন্ধ রাখায় স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হলে, সেটা ভিন্ন ব্যাপার; যা বিজ্ঞ চিকিৎসকগণই ভালো বলতে পারেন।”(জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)।
“রোযা রেখে শরীরে থেকে রক্ত দিলে বা শরীরে রক্ত নিলে রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, বিধি মোতাবেক যেসব পথে (মানফায) কোনো কিছু প্রবেশ করালে রোযা ভঙ্গ হয়; সেসব পথে রক্ত প্রবেশ বা বের করা হয় না”(জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)। “একইভাবে চিকিৎসাস্বরূপ স্যালাইন গ্রহণেও রোযা নষ্ট হয় না। কারণ, তা সেই সুনির্দিষ্ট পথ বা ছিদ্রের বাইরে রগের মাধ্যমে বা গোশতে গ্রহণ করা হয়।”(জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)। “ রোযা অবস্থায় ডায়াবেটিস রোগির ইনসুলিন ব্যবহারেও রোযা নষ্ট হয় না। কারণ, তা-ও সেই ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্ত গ্রহণের অনুরূপ। তবে এই ইনসুলিনই যদি মুখে সেবনযোগ্য ঔষুধ/টেবলেট আকারে (তেমনটি আবিস্কৃত হলে) মুখ দ্বারা গ্রহণ করা হয়; সেক্ষেত্রে আবার রোযা ভেঙ্গে যাবে।(জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)। “রোযা অবস্থায় চোখে ঔষুধ বা ড্রপ সুরমা বা মলম ব্যবহারে রোযা নষ্ট হবে না। যদিও এসবের স্বাদ গলায় অনুভ‚ত হয়। কারণ, এসব ক্ষেত্রে রোযা না ভাঙ্গার বিষয়টি সরাসরি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত”।(জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)। “রোযা অবস্থায় দিনের বেলায় তাজা ডাল বা শিকড় দ্বারা মিসওয়াক করাতে, রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। যদিও ওই ডাল বা শিকড়ের স্বাদ মুখে বা গলায় বোঝা যায়”। এটিও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)। “রোযা অবস্থায় দিনের বেলায় স্বপ্নদোষ হওয়াতেও রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। তবে যথাসাধ্য ফরয গোসল করে পবিত্র হয়ে যাওয়া উত্তম।(জাদীদ ফিকহি মাসাইল: ১/১৮৮)।
“রোযা অবস্থায় টিভি, নাটক, সিনেমা ও নাচ-গান দেখা পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। তার কারণ, রমযানের উদ্দেশ্য হল তাকওয়া অর্জন ও আত্মশুদ্ধি; অথচ ২/১টি ব্যতিক্রম ব্যতীত এগুলোর অধিকাংশই রোযার উদ্দেশ্য ও শিক্ষা পরিপন্থী। এ সব দ্বারা সিয়াম সাধনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণের পরিবর্তে বরং সরাসরি তা ব্যহত হয়। তারপরও তেমন অবৈধ ও অশালীন গান-বাজনা, সিনেমা, নাটক ও টিভি ইত্যাদি দেখা বা শোনার কারণে রোযা নষ্ট হবে না; যদিও শক্ত গোনাহ হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন