শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

ঈদুল-ফিতর: ফাযায়েল ও মাসায়েল

মুফতী মোঃ আব্দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০২০, ১২:০৫ এএম

ঈদ: মাহে রামাদানের দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে যে ঈদ অনুষ্ঠিত হয় তাকে ঈদুল-ফিতর বলা হয়; আর যিলহাজ মাসের ১০ তারিখে যে ঈদ হয়ে থাকে সেটিকে ঈদুল-আযহা বলা হয়। ঈদ মানে খুশী। ইসলাম ধর্মের বিধানে দু’টি ঈদ নির্ধারিত হয়েছে।
তাৎপর্য: হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ্ (র) বলেন, প্রত্যেক জাতী, সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠির নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার, আনন্দ-উৎসব ও জাতীয় দিবস হয়ে থাকে যেমন প্রাক-ইসলামী যুগের ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ ইত্যাদি। রাসূল (স) যখন মদীনায় হিজরত করে গেলেন, সেখানে দেখতে পেলেন তারা শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, নারী-পুরুষ সবাই বছরে দু’দিন আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকে। সাহাবীদের মধ্যেও তেমন আবেগ-আগ্রহ পরিলক্ষিত হওয়ায় মহান আল্লাহ্র নির্দেশে মহানবী (স)ও বাৎসরিক দু’টি ঈদ তথা ঈদুল-ফিতর ও ঈদুল-আযহা পালনের ঘোষণা প্রদান করলেন (হুজ্জাতুল্লাহিল-বালিগা)।
রাসূল (স) ইরশাদ করেছেন: যে ব্যক্তি দু’ঈদের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাবে, যেদিন সব আত্মা- অন্তর (কিয়ামতের দিন) মারা যাবে সেদিন তার অন্তর মরবে না। অর্থাৎ কিয়মত দিবসের কঠিন বিপজ্জনক অবস্থা ও মহা-আতঙ্কের মধ্যে যখন সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত ও মৃতপ্রায় হয়ে পড়বে তখন এই ঈদের রাতে ইবাদতকারী বরং হাসি-খুশীর মধ্যে কাটাবে (তাবারানী)
ঈদুল-ফিতরের সুন্নাত: ঈদুল-ফিতরের দিন ১৩টি কাজ সুন্নাত। যথা: ১) শরীয়তের সীমার মধ্যে থেকে যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া এবং আনন্দ প্রকাশ করা। ২) গোসল করা। ৩) মিসওয়াক করা। ৪) সাধ্যমত উত্তম পোশাক পরিধান করা। ৫) সুগন্ধি-আতর ব্যবহার করা। ৬) অতি ভোরে ঘুম থেকে জাগা। ৭) ফজরের পরেই দ্রুত ঈদগাহে যাওয়া। ৮) ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টিদ্রব্য খেজুর, সেমাই, ক্ষীর ইত্যাদি কিছু আহার করা। ৯) ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই সাদকায়ে-ফিতর আদায় করে দেয়া। ১০) বৃষ্টি-বাদল না হলে ঈদগাহে ঈদের জামাত আদায় করা। ১১) ঈদগাহে এক রাস্তায় যাওয়া এবং অন্য রাস্তায় ফেরত আসা। ১২) পাঁয়ে হেটে ঈদগাহে যাওয়া। ১৩) ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়া-আসার পথে নিচুস্বরে তাকবীর বলতে থাকা -অর্থাৎ ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। পক্ষান্তরে ঈদুল আযহার ক্ষেত্রে কিছুটা উচ্চস্বরে পথিমধ্যে বা ঈদগাহে যাতায়াত কালীন তাকবীর বলা সুন্নাত।
ঈদ ও আল-হাদীস: ১) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, মহানবী (স) ঈদুল ফিতরের দিন দুই রাকাত নামায পড়লেন। কিন্তু এ দু’রাকাতের পূর্বে বা পরে অন্য কোন নামায পড়েননি (বুখারী ও মুসলিম/মিশকাত: পৃ-১২৬, মূল আরবী (১৩৪৬)
২) হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা মিনায় অবস্থানের দিনে হযরত আবু বকর (রা) তাঁর নিকট হাজির হলেন। তখন আয়েশার নিকট দু’টি বালিকা বসে দফ বাজিয়ে গান করছিল। অপর বর্ণনা মতে, বালিকাদ্বয় সেই গান গাচ্ছিল যা আনসারগণ বুয়াস যুদ্ধে প্রেরণা ও উত্তেজনার জন্য গেয়েছিল। তখন নবী (স) নিজ কাপড়ে মুখ আবৃত হয়ে শুয়েছিলেন। হযরত আবূ বকর (রা) বালিকাদ্বয়কে ধমক দিলেন। তখন নবী কারীম (স) নিজ মুখমন্ডল হতে কাপড় সরালেন এবং বললেন, হে আবূ বকর! এদেরকে ছেড়ে দাও! (অর্থাৎ করতে দাও) । কারণ, এটা ঈদের দিন। অপর এক বর্ণনায় এমনটি রয়েছে, “হে আবূ বকর! প্রত্যেক জাতির জন্য আনন্দ-উৎসব , এটা আমাদের আনন্দ উৎসবের দিন।”(বুখারী ও মুসলিম/মিশকাত: পৃ-১২৫-১২৭, নং-১৩৪৮)
৩) হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম (স) ঈদুল ফিতর বা ঈদুৈ আযহার দিনে ঈদগাহে যেতেন , তারপর প্রথম কাজ তিনি যা করতেন তা হল, নামায পড়াতেন। তারপর নামায শেষে মুসুল্লিদের মুখোমুখী দাঁড়াতেন এবং লোকজন নিজ নিজ স্থানে সারিবদ্ধভাবে বসা থাকতেন। তখন নবীজী (স) তাঁদের ওয়ায-উপদেশ দিতেন; নসীহত-ওসীয়ত করতেন এবং প্রয়োজনীয় আদেশ জারী করতেন। কোথাও যদি সৈন্য প্রেরণের ইচ্ছা করতেন, তাদের বাছাই করতেন অথবা যদি কাউকে বিশেষ কোন নির্দেশ দেবার হত সেই নির্দেশ প্রদান করতেন (আর এভাবেই ঈদের সালাত ও খোতবা শেষে) তারপর বাড়ি ফিরে যেতেন। (প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৩৪২)
৪) হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন উমর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স), আবূ বকর ও উমর সকলেই দু’ঈদের নামায খোতবাদানের পূর্বেই পড়তেন। (প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৩৪৪)
৫) হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স) ঈদুল ফিতরের দিন বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেয়ে ঈদগাহে বের হতেন। (প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৩৪৯)
৬) হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত। মহানবী (স) ঈদের দিনে রাস্তা পরিবর্তন করতেন। (প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৩৫০)
৭) হযরত উম্মে আতিয়া (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছিল, আমরা যেন ঋতুমতী মহিলাদের ও পর্দানশীন নারীদেরকে দুই ঈদের দিনেই ঈদগাহে বের করে সঙ্গে নেই; যাতে তারা মুসলমানদের জামাতে শরীক হতে পারে এবং দোয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে। (আরও নির্দেশ) ঋতুমতী মহিলাগণ যেন নামাযের স্থান থেকে একপাশে সরে বসে। তখন একজন মহিলা আরজ করলো, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমাদের কারো কারো যে বড় চাদর নেই! (তো পর্দা করে কিভাবে সবাই আসবে?) রাসূল (স) বললেন, তার সহচরী বা সাথী নিজ চাদর (ধার হিসাবে) তাকে পরিয়ে দেবে। (প্রাগুক্ত, হাদীস নং-১৩৪৭)
৮) হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স) যখন মদীনায় তাশরীফ আনলেন তখন সেখানে দেখতে পেলেন , তারা দু’দিন এমন রয়েছে যাতে আনন্দ-উল্লাস, খেলাধুলা করে থাকে। তাই নবী কারীম (স) জানতে চাইলেন, এ দু’দিনে কী হয়? এর জবাবে তারা বললো, ‘আমরা জাহিলিয়্যা যুগ থেকেই এ দু’দিনে খেলাধুলা ও (জাতীয়ভাবে) আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকি।’ তখন মহানবী (স) বললেন, ‘মহান আল্লাহ্ তার পরিবর্তে তার চেয়েও আরও দু’টি অধিক উত্তম দিবস ‘ঈদুল ফিতর’ ও ‘ঈদুল আযহা’ দ্বারা তা পরিবর্তন করে দিয়েছেন।(আবূ দাউদ/মিশকাত: মূল আরবী: পৃ-১২৬, তা. বি. কাসেমিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা)
৯) হযরত বুরাইদা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (স) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু না খেয়ে বের হতেন না এবং ঈদুল আযহা’র দিন ঈদের নামায না পড়ে কিছু খেতেন না।(তিরমিযী, ইবনে মাজা ও দারেমী/ মিশকাত প্রাগুক্ত: পৃ-১২৬)
১০) হযরত সাঈদ ইবনুল ‘আস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবূ মূসা ও হুযাইফা (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, মহানবী (স) ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের সালাতে কিভাবে (কত?) তাকবীর বলতেন? আবূ মূসা বললেন, তিনি (স) জানাযা’র সালাতের অনুরূপ (প্রতি রাকাতে) চার তাকবীর (প্রথম রাকাতে তাহরীমার তাকবীরসহ মোট ৪; এবং দ্বিতীয় রাকাতে রুকুর তাকবীরসহ মোট ৪) দ্বারা পড়াতেন। হযরত হুযাইফা (রা) তা সমর্থন করে বললেন, সঠিক বলেছেন। (আবূ দাউদ/মিশকাত: মূল আরবী: পৃ-১২৬, তা. বি. কাসেমিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা)
১১) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, একবার ঈদের দিন সবাইকে বৃষ্টিতে পেয়ে বসলে, মহানবী (স) সকলকে নিয়ে মসজিদে ঈদের সালাত আদায় করলেন। (আবূ দাউদ ও ইবনে মাজা : প্রাগুক্ত)
১২) হযরত আবুল হুয়াইরিছ থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (স) আমর ইবন হাযামকে -তিনি নাজরানে থাকাবস্থায়- লিখে পাঠালেন, ‘তুমি ঈদুল আযহা’র সালাত দ্রুত এবং ঈদুল ফিতরের সালাত (কিছুটা) বিলম্বে পড়ার ব্যবস্থা করবে’ ; আর লোকজনকে ওয়ায-উপদেশ প্রদান করবে। (ইমাম শাফেঈ র. বর্ণিত হাদীস/ মিশকাত : পৃ-১২৭: প্রাগুক্ত)
প্রিয় পাঠক! লক্ষ করে দেখুন, উপরে আলোচিত ফিকহ্র মাসায়েলগুলো এবং হাদীসগুলোর মধ্যে কত সুন্দর সামঞ্জস্য বিদ্যমান । এভাবে যারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে হাদীস ও ফিকহ্-ফাতাওয়ার গ্রন্থাদি পাঠ করবেন তাঁদের কাছে ফকীহ ইমামগণের মর্যাদা ও মাহাত্ম দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।
ঈদের সালাত: এই উভয় ঈদের দিনে মহাসমারোহে একত্রিত হয়ে শোকর আদায়কল্পে দু’রাকাত সালাত আদায় করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়েছে। জুমু‘আর নামাযের জন্য যেসব শর্ত দু’ঈদের নামাযের জন্যও সেসব শর্ত জরুরী। তবে জুমু‘আর নামাযের জন্য খোতবা ফরয আর দু’ঈদের জন্য খোতবা সুন্নাত। অবশ্য জুমু‘আর অনুরূপ ঈদের খোতবা শোনাও ওয়াজিব।
ঈদের নামাযের নিয়ম : প্রথমে মুখে বা মনে মনে নিয়ত করে নেবে, ঈদুল-ফিতর এর দু’রাকাত ওয়াজিব নামায অতিরিক্ত ছয় তাকবীরসহ ইমামের সঙ্গে পড়ছি। তাপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে হাত বেঁধে নেবে এবং সানা পড়বে। তারপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তাকবীরে কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে ছেড়ে দেবে এবং চতুর্থ তাকবীরে হাত উঠিয়ে বেঁধে নেবে। তারপর স্বাভাবিক নিয়মে প্রথম রাকাত শেষ করবে। দ্বিতীয় রাকাতে ফাতিহা ও সূরা পাঠ শেষে ইমাম যখন তাকবীর বলবেন, তাঁর সঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তাকবীরে হাত কান পর্যন্ত উঠাতে হবে এবং ছেড়ে দিতে হবে। আর চতুর্থবার তাকবীর বলে হাত না উঠিয়ে সোজা রুকুতে চলে যেতে হবে। বাকীটুকু যথা নিয়মে শেষ করে খোৎবা শুনে, দু‘আ-মুনাজাত করে বাসা-বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। মহান আল্লাহ্ উক্তসব আমল-ইবাদতে আমাদের অংশগ্রহণের এবং সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো মেনে চলার তাওফীক দিন , আমীন!

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন