আবদুল আউয়াল ঠাকুর
জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব রাজনীতিতে তুরস্ক এক ব্যতিক্রমী ইতিবাচক মডেল স্থাপন করেছে। এর প্রকৃতি-প্রক্রিয়া নিয়ে নানামাত্রিক আলোচনা, হচ্ছে। আরো বহুদিন এ আলোচনা চলমান থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ যাবৎকাল বিশ্বব্যাপী ধারণা ছিল, সেনাবাহিনীর কোনো কোনো অংশ কখনো কখনো জনগণকে বোকা বানাতে এক ধরনের মুখরোচক শব্দাবলী ব্যবহার করে আসছে কার্যত যার মাধ্যমে জনগণকেই প্রতারণা করা হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক বন্ধু ও শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার জোরে জনগণকে তাত্ত্বিকভাবে পরাজিত করার এতদিনের কৌশল দারুণভাবে মার খেয়েছে তুরস্কে। ফলে ক্ষমতার উৎস কে তা নির্ণয় করা সহজ হয়েছে। রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্রসহ অনিয়মতান্ত্রিক বহু শাসন উচ্ছেদের ইতিহাস এ যুগে রয়েছে। এই প্রথম সামরিক ক্যুতে অভ্যস্ত অভিজ্ঞ সেনাদের গণবিরোধী প্রবণতা নস্যাৎ করার ইতিহাস তৈরি হয়েছে। আগামী বহুদিন এ থেকে শিক্ষা নেয়ার বিষয় রয়েছে। সেই সাথে ভাবার রয়েছে, এমনটা কেন হতে পেরেছে এবং সেই ইতিহাস তুরস্কেই বা কেন। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, রাতে শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন জেনারেলসহ সেনাবাহিনীর বিপুল সদস্য রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল তুরস্কে। জনতার প্রতিরোধে তা ব্যর্থ হয়। অগণিত মানুষ রাজপথে নেমে ট্যাংকের সামনে অবস্থান নিয়ে অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ জানায়। তাদের কেউ কেউ জীবন বাজি রেখে ট্যাংকের সামনে অবস্থান নিয়ে অভ্যুত্থানের প্রতিবাদ করে। কেউ কেউ নিজের জীবন বাজি রেখে ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়েন। সেই জন¯্রােতকে উপেক্ষা করে সেনাবাহিনী আর অগ্রসর হতে পারেনি। অভ্যুত্থানকারীরা একে একে সরকারি, সামরিক ও বেসামরিক ভবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। যখন তারা নিশ্চিত হয়ে যায় অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে তখন হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করে। আর এ ঐতিহাসিক বিজয় সম্পন্ন হয় তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোগানের বেসরকারি গণমাধ্যমে আহ্বানের মধ্য দিয়ে, যেখানে তিনি জনগণকে মাঠে নামতে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তুরস্কের জনগণের এই ঐতিহাসিক ঐক্যের ভিত্তি খুঁজতে হলে অবশ্যই একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। সেই সাথে অভ্যুত্থানকারীদের মোটিভও পর্যালোচনা করতে হবে। প্রথমত, অভ্যুত্থানকারীরা তুরস্কে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কথা বলেছিল। জনতা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের সিক ম্যান বলে কথিত তুরস্ককে সবল করতে সে সময়কার জাতীয়তাবাদী নেতা কামাল পাশা যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে তুরস্ককে ডিমুসলিমাইজ করতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন সেটি সে সময়ের সাধারণ নাগরিক বিশেষ করে গ্রামের মানুষেরা মেনে নেয়নি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আরবি ভাষায় আজান পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যত উন্নয়ন, অগ্রগতি, প্রগতি বা সুশীল সমাজের কথাই বলা হোক না কেন, তুরস্কের মূল চেতনা ও ঐতিহ্যে বিশ্বাসী সাধারণ মানুষ কামাল পাশার ধারণাকে গ্রহণ করেনি। সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ক্যুও মূলত সেই পরিত্যক্ত ধারণার অংশ ছিল। সেদিক থেকে বলা যায়, তুর্কি প্রেসিডেন্টের আহ্বান মূলত সেখানে জনগণের মধ্যে গড়ে ওঠা ঐক্যেরই প্রতিধ্বনি ছিল। ঐক্য ছিল, তিনি তাকে কেবলমাত্র মনে করিয়ে দিয়েছেন। অবশ্যই তার প্রতি তুর্কি জনগণের অবিচল আস্থার বিষয়টিও এখানে অনন্য উদাহরণ। সেনাবাহিনীর ডাকে সাড়া না দিয়ে তার ডাকে সাড়া দেয়ার মধ্য তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত তার নেতৃত্ব প্রথিত রয়েছে বলেই প্রমাণিত হয়েছে। এখানে তার যোগ্যতা এবং নেতৃত্বের বলিষ্ঠতার যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি রয়েছে সে কথা গার্ডিয়ানও বলেছে। গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, শুধু নিজের স্মার্টফোনে ধারণ করা একটা ভিডিও বার্তার মাধ্যমেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের যে বিদ্রোহ দমন করেছেন, অত্যন্ত জনপ্রিয় না হলে এটা সম্ভব নয়। এই বিশ্লেষণে এরদোগানের জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে তাকে জনগণের একজন এবং ধর্মীয় ইস্যুকে মনে করা হয়েছে। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ১৯২০ সালে মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক আধুনিক তুরস্কের গোড়াপত্তন করার পর থেকেই দেশটির সমাজব্যবস্থায় ধর্ম গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। ধর্মীয় রক্ষণশীল একে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর আবারও সমাজের মূলধারায় ফিরেছে ইসলাম। এই যে সমাজের মূলধারায় ইসলাম ফিরে আসার ব্যাপারটি, এ নিয়ে অনেক দিন থেকেই নানা আলোচনা চলছে। তবে এবার ঐক্যের প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে যে এই মূলধারা কাজ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একটু ফিরে দেখা দরকার, এ ধরনের ঘটনার বিপরীতে কী হয়েছে, গত কয়েক বছরে আলজেরিয়া, আলবেনিয়া, মিসর, তুরস্কে রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হলেও সব জায়গায় তা বহাল নেই। আলজেরিয়াতে সাধারণ মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে সেখানকার সেনাবাহিনী। মিসরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে তারই মনোনীত সেনাপ্রধান। মনে করা হয়, ইহুদি স্বার্থ দেখতেই মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। তুরস্কের আলোচ্য ক্যুয়ের সাথেও ইহুদি কানেশনের কথা উঠেছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরও বেসামরিক নেতৃত্ব থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ। বর্তমান আমলে সেখানে অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করা হয়। সেনাবাহিনীর কাজ মূলত দেশ রক্ষা হলেও দেশে দেশে সেনাবাহিনীর কোনো কোনো অংশ গণমানুষের বিপক্ষে সা¤্রাজ্যবাদের হয়ে গণবিরোধী ভূমিকার প্রমাণ রেখেছে। এমনকি বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তুরস্কের এই জাতীয় ঐক্যের সাথে অনেকটা মিল রয়েছে নভেম্বরে সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের। জনতা ও সিপাহি সম্মিলিতভাবে বন্দি সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে তার প্রতি আস্থা স্থাপন করেছিল। ইতিহাস বলে, দেশের জনপ্রিয় এই প্রেসিডেন্টকে হত্যার পর নাটকীয়তার মধ্যদিয়ে এদেশে জারি করা হয়েছিল সামরিক শাসন। জনতার প্রতিরোধে তা চূরমার হয়ে গিয়েছিল। তবে তারা শান্ত হয়েছিল সে কথা বলা যাবে না। ২০০৭ সালের পর আবার তারাই ছদ্মনামে দেশকে বিরাজনীতিকরণের আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠেছিল। জনতার প্রতিরোধে সে অবস্থার অবসান হলেও রাজনীতিতে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে কথা বলা যাবে না। এতদিন পর্যন্ত জাতীয় ঐক্যের যে কথা বলা হয়ে আসছে এবং যে ধরনের রূপরেখা ভাবা হতো বোধকরি তুরস্কের ঘটনা তা থেকে আলাদা ধারণার জন্ম দিয়েছে। প্রথাগত ধারণার বাইরে নতুন ধারণার জন্ম হয়েছে। দেশ, বোধ-বিশ্বাসই জাতীয় ঐক্যের প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
তুরস্কের জাতীয় ঐক্য নিয়ে বাংলাদেশেও নানামাত্রিক আলোচনা শুরু হয়েছে। নানা ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে। একে ক্ষমতাসীনরা একরকম, আবার সাধারণ জনগণ অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করছে। তুরস্কের ঐক্যের ভিত্তি যদি সে দেশের সাধারণ জনগণের ঐকমত্য হয় তাহলে ইরানের কথাও এখানে আনা প্রয়োজন। শাহ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি। তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লব সম্পন্ন করে তিনি ও তার সমর্থকরা সে সময়ে নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী এ ঐক্যর ভিত্তিও ছিল ইরানের জনগণ। অর্থাৎ পরিবর্তনে জনগণকেই প্রধানশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা এখন জরুরি হয়ে উঠেছে। এটাই সত্যি যে, নিরস্ত্র জনতার সম্মিলিত অস্ত্র সশস্ত্রদের পরাজিত করছে। আজ বাংলাদেশেও জাতীয় ঐক্যের প্রয়েজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ২০১৪ সালের অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পর থেকে দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসনে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এই ঐক্যের আহ্বান আরো জোরদার হয়েছে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন ২০-দলীয় জোটের শীর্ষনেতা বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানানোর পর প্রথমদিকে সরকারের দু-একজন যাই বলে থাকুন না কেন, এখন শীর্ষপর্যায় থেকে জাতীয় ঐক্যের কথা প্রকারান্তরে অস্বীকার করা হয়েছে। সরকারের দিক থেকে যাই বলা হোক বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা। সরকারের বিভিন্ন মহল জনগণকে আশার বাণী শুনালেও বাস্তবে জনমনে ভীতিই ছড়িয়ে পড়ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব শুধু দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বা সাধারণ ক্ষেত্রেই নয় বরং দেশের বাইরেও পড়ছে। এ নিয়ে প্রকাশিত খবরাদিতে দেখা যাচ্ছে, ভাষা ও শব্দ বদলালেও প্রতিদিন খবরের শিরোনাম হচ্ছে সন্ত্রাস, জঙ্গি গ্রেফতার, আস্তানার খোঁজ ইত্যাদি। পরিস্থিতি এমন যে, শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীদের ওপর জঙ্গিরা যে কোনো সময়ে হামলা চালাতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তাদের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এ বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন। বার্তায় সালাম জানিয়ে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, যে কোনো সময়ে যে কোনো মন্ত্রীর ওপর জঙ্গি গোষ্ঠী হামলা চালাতে পারে। এ ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছি। অনুগ্রহ করে সতর্ক থাকবেন এবং আপনার গানম্যান ও নিরাপত্তা দলকে বিষয়টি অবহিত করবেন। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা হতে পারে, এমন তথ্য দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া এ প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভার সব সদস্য ছাড়াও সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সতর্কভাবে চলাফেরার জন্য বলা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত গানম্যান ও হাউস গার্ডকে সতর্কাবস্থায় থাকার জন্য ব্রিফিং করা হয়েছে। এর আগে ১১ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল যথার্থই বলেছেন, জনগণকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। তিনি মনে করেন, পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, রাষ্ট্র বলে এক অদ্ভূত বিষয়কে চিন্তা করা হচ্ছে। যেখানে শুধু যারা ক্ষমতায় থাকবে তারাই মালিক। এর বাইরে যারা আছে সবাই অরাষ্ট্রীয়। ফলে সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। কখনো কেউ রাষ্ট্রবিরোধী বা রাষ্ট্রদ্রোহী। বাস্তবত অবস্থা এই যে, ছেলের জন্য পিতামাতার, বাবার জন্য সন্তানের, স্বামীর জন্য স্ত্রীর উদ্বেগ প্রতি মুহূর্তেই বাড়ছে। যে সন্তানটি শিক্ষায়তনে যায় সে ফিরে না আসা পর্যন্ত অভিভাবকের যে উৎকণ্ঠা, শংকা তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আগেও ছিল তবে এখন যে অবস্থা তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ এমনিতেই মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। শিক্ষা, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে যতটুকু অগ্রগতি হচ্ছিল তাও রুদ্ধ হতে বাধ্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশটা এমনতর ছিল না, হয়েছে। এর প্রতিবিধানেই জাতীয় ঐক্য। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠেছে, জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি কি বা কেমন হতে পারে ?
এক আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, দেশে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত ছিল। জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে জামায়াতের অবস্থান এবং এ বিষয়টি ২০-দলীয় জোটের জন্য কোনো বিষয় কিনা এমন প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইলে তাদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়তে আপত্তি থাকার কথা নয়। অনেকে বলেছেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যেভাবে আলাদা আলাদা প্লাটফর্ম গড়ে তোলা হয়েছিল সেভাবেও হতে পারে। জাতীয় ঐক্যের ভিত্তির ব্যাখ্যা যে যেভাবেই করুক না কেন, ভাবনার মূল বিষয় হচ্ছে ঐক্যের বিষয় জাতীয় কিনা। অর্থাৎ জাতীয় সংকট যদি মোকাবিলা করতে হয় তাহলে সেখানে জাতির সবাইকেই অংশ নিতে হবে। এসব বলতে আসলে যা বুঝতে হবে তাহলো সংকটের গভীরতা। আজ এ কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, হামলাই জাতির একমাত্র সমস্যা নয় বরং সামগ্রিকভাবে দেশ আজ আক্রান্ত। দেশের সীমান্তসহ সবকিছু প্রকারান্তরে অরক্ষিত। ১/১১-এর সরকারই এদেশে সবচেয়ে নাস্তিক্যবাদী সরকার হিসেবে পরিচিত। ওই সরকারে ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়েছে। সম্প্রতি সরকারি উদ্যোগে জুমার খুতবা বিলি করার পর কোনো কোনো ইমাম বলেছেন, উপমহাদেশের ৮০০ বছরের ইতিহাসে এর কোনো নজির নেই। অনেক মুসল্লি মনে করছেন, এর ফলে তাদের আকাক্সক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে মনে করেন, প্রতিটি মসজিদেই কমিটি রয়েছে। যখন কোনো ইমাম নিয়োগ দেয়া হয় তখন তারা তাদের মতো করে বয়ান শুনেই নিজেদের পছন্দমতো ইমাম নিয়োগ দেন। এভাবে জুমার খুতবা নির্ধারিত করে দেয়া প্রকৃত বিবেচনায় বাক স্বাধীনতায় বড় ধরনের হস্তক্ষেপ। এটি আশঙ্কারও বটে। ধর্মীয় ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের হস্তক্ষেপ বলেও অনেকে মনে করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, খেলাফতের আমলে খলিফা প্রধান মসজিদে খুতবা দিতেন। এমনই একজন ছিলেন আমিরুল মুমেনিন হযরত ওমর (রা.)। একদিন খুতবা দেয়ার আগে জনৈক মুসল্লি তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আমিরুল মুমেনিন আমাদের পরনে একটি কাপড়, আপনার দুটি কেন? প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মিম্বরে উঠবেন না। সঠিক জবাব দিয়েই মুসল্লিকে সন্তুষ্ট করার পরই হযরত ওমর (রা.) খুতবা দিয়েছেন। সরকার নির্ধারিত খুতবায় ইসলামের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানের কথা স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে। ইসলাম যে সব ধরনের বৈষম্যবিরোধী সে কথা খুতবায় বলা হয়নি। ইসলাম কেবলমাত্র জনসাধারণের জন্য নয় বরং শাসক শ্রেণির জন্যও। এযাবৎকাল ইসলামের ছায়াতলে যারা আশ্রয় নিয়েছেন তা তো কেবলমাত্র ইসলামের সাম্যবাদিতার কারণেই।
যেভাইে ব্যাখ্যা করা যাক না কেন এটাই সত্যি যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজ দিশাহারা। সরকারের থেকে যে ঐক্যের কথা বলা হয়েছে তার অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র থেকে জনগণকে বিচ্ছিন্ন করা। আর গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষ থেকে যে আহ্বান জানানো হয়েছে তার অর্থ রাষ্ট্র ও জনগণকে সুসংহত করা। তুরস্কের জনগণ প্রমাণ করেছে দেশে ধর্ম সবকিছুর ঊর্ধে। বাংলাদেশ আজ সত্যিই বিপন্ন দশায় উপনীত। জাতীয় স্বাধীনতা, বোধ-বিশ্বাস, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বক্ষেত্রে সংকটের আলামত স্পষ্ট। তুরস্কের ঘটনা প্রমাণ করেছে জাতীয় ঐক্যের কাছে ট্যাংক কামান কোনো বিষয় নয়। এই বার্তাকে বিবেচনায় নিয়ে এখন জনগণের ঐক্যই প্রয়োজন।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন