দুবাই-ভিত্তিক সউদী মালিকানাধীন মধ্যপ্রাচ্য সম্প্রচার কেন্দ্র (এমবিসি) কোন প্রকার ব্যাখ্যা না দিয়ে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মিডিয়ামাধ্যমে ঘোষণা করে যে, দেশটি তুর্কি নাটক সিরিজ নিষিদ্ধ করতে চলেছে। আরব বিশ্বে এসময় ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল তুর্কি সোপ অপেরা। তুর্কি কর্মকর্তারা একে একটি ‘রাজনৈতিক পদক্ষেপ’ বলে নিন্দা করেছিলেন। কারণ পুরো উপসাগরীয় অঞ্চলে আরব দেশগুলোর অবরোধের সময় কাতারকে সমর্থন করে তুরস্ক। মিসর সমস্ত তুর্কি প্রোগ্রামের বিষয়বস্তু নিষিদ্ধ করে মামলা করে; দেশটির দার আল-ইফতা ‘নিজের প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্র তৈরি করার চেষ্টা করছে’ বলে তুরস্কের বিরুদ্ধে একটি ফতোয়া প্রকাশ করে। বিবৃতিতে ‘মধ্যপ্রাচ্যে অটোমান সাম্রাজ্য এবং এককালে অটোমান শাসনের অধীনে থাকা আরব দেশগুলোর ওপর সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করার জন্য দিলিলিস এরতুগ্রুল সিরিজকে টার্গেট করা হয়’।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কুয়ালালামপুর (কেএল) শীর্ষ সম্মেলনের অল্প সময় আগেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান মালয়েশিয়া যাওয়ার পূর্বক্ষণে সউদী আরব সফর শেষে আকস্মিক তার নির্ধারিত উপস্থিতি বাতিল করেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান বলেন, সউদী আরব পাকিস্তানকে মুসলিম নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে অংশ না নিতে চাপ দিয়েছিল, এমন সংবাদে তিনি ‘অবাক নন’। এরদোগান যোগ করেন, ‘ইসলামাবাদকে রিয়াদের হুমকি দেয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়’।
সম্ভবত তিনি যে ঘটনার কথা উল্লেখ করছিলেন তার মধ্যে তুর্কি অনুষ্ঠানমালা বিশেষত দিলিলিস এরতুগ্রুলকে রাষ্ট্রীয় পাকিস্তান টেলিভিশন কর্পোরেশন (পিটিভি)তে প্রচার করার সম্ভাবনা নিয়ে সউদী অসন্তুষ্টির অভিযোগ রয়েছে, যা ডিসেম্বরের প্রথম দিকে খান নিজেই আদেশ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নাটক সিরিজ ডাবিং দলের অংশ, কর্পোরেশনের কর্মচারীরা কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে দাবি করেন, তাদের বলা হয়েছে, প্রকল্পটি তাকে তোলা হচ্ছে।
পাকিস্তানের মাধ্যমে মালয়েশিয়াতে পণ্য পাঠাচ্ছে সউদী আরব। ধারণা করা হয়, ২০১৮ সালের শেষ দিকে কঠিন আর্থিক সঙ্কটে পড়া পাকিস্তানকে এভাবেই সহযোগিতা করছে সউদী, যাতে তারা পণ্য পরিবহণের মাধ্যমে কিছু নগদ অর্থ আয় করতে পারে।
তা সত্তে¡ও পিটিভি অবশেষে এ বছরের এপ্রিলে দিলিলিস এরতুগ্রুল প্রচার করে এবং ইমরান খান আবারও নাটক সিরিজটিকে সমর্থনের পুনরাবৃত্তি করে দাবি করেন যে, এতে ‘মূল্যবোধসহ জীবন’ চিত্রিত হয়েছে এবং এটি ইসলামী সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। এর স¤প্রচারের সময়টি ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের পাকিস্তান সফরের সাথে সংযুক্ত বলে মনে হয়। এ সময় তিনি পাকিস্তানের সংসদে চতুর্থবারের মতো ভাষণ দেন। এ ভাষণ অন্য যে কোনও আন্তর্জাতিক নেতার চেয়ে বেশির রেকর্ড।
তুর্কি পররাষ্ট্রনীতি আরও সঙ্কুুচিত বলে মনে হচ্ছে, কারণ এর লক্ষ্য বৃহত্তর স¤প্রীতি এবং দীর্ঘমেয়াদী সহযোগিতা সক্ষম করার জন্য জনগণের আকাক্সক্ষার সাথে সামঞ্জস্য করা। এটি সউদী পররাষ্ট্রনীতির তীব্র বিপরীত, যা কাতারের অবরোধ তদারককারী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের অধীনে আরও বেপরোয়া, স্বল্পদৃষ্টিতে এবং আপাতদৃষ্টিতে কঠোর হতে দেখা গেছে; মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে কানাডার সাথে কূটনৈতিক সীমা; সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকান্ড; তৎকালীন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হরিরিকে গৃহবন্দিকরণ এবং ইয়েমেনের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের নামকরণ, সা¤প্রতিক অতীতের কয়েকটি উদাহরণ। সম্ভবত পাকিস্তানের প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সউদী আরব অধিকৃত কাশ্মীরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য ভারতের নিন্দা জানায়নি। অন্যদিকে তুরস্ক, কাশ্মীরিদের মানবাধিকারের প্রতি অসম্মানজনক অবজ্ঞার জন্য ভারতীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে আওয়াজ তোলা কয়েকটি দেশের একটি।
বিশ্বজুড়ে হৃদয় ও মন জয় করার ক্ষেত্রে তুরস্কের বিনোদন মিডিয়া এবং তুরস্কের নরম শক্তি কীভাবে এবং কেন প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবে এটি তার পূর্বাভাস দিতে পারে। এমনকি সউদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত-নির্মিত ৪০ মিলিয়ন ডলারের ১৪ পর্বের সিরিজ মামালিক এল-নার (কিংডম অফ ফায়ার)-এর সফল হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। ‘তুর্কিদের হাতে আরবদের কথিত শোষণকে চিত্রিত করে’ উসমানীয় রাষ্ট্রের পেছনের ভয়াবহ ইতিহাস প্রকাশই এর উদ্দেশ্য।
যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত উপসাগরীয় অঞ্চলে নরম শক্তির পথিকৃৎ ছিল, যদিও বেশ কয়েকটি সউদী সরকারী সংস্থা বিশ্বব্যাপী ইসলামী দাওয়াতের কাজে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে, নিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্রে থাকা উভয় দেশই দৃঢ়ভাবে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করছে বলে মনে হয়। এগুলির একটি উদাহরণ ২০১১ সালের আরব বসন্ত, যখন গণতন্ত্রের জন্য আশা এবং আকাক্সক্ষা এবং একটি নতুন সামাজিক চুক্তি প্রথম প্রভাবিত হয়েছিল।
তবে, ক্রমবর্ধমান তুর্কি নরম শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর চেষ্টা করলেও তারা সফল বলে মনে হয় না। সউদী আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তুর্কি প্রোগ্রাম নিষিদ্ধ করলে অঞ্চলজুড়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা তাদের হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি মিসরের সর্বোচ্চ ইসলামী কর্তৃপক্ষ মুসলমানদের তুর্কি নাটক এবং এ জাতীয় জিনিস দেখার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করার পরও আরব পর্যটকরা ইস্তাম্বুলে আসেন এবং দীর্ঘ অপেক্ষার পরও পাকিস্তানীরা জনপ্রিয়তার রেকর্ড ভেঙে দিলিরিস এরতুগ্রæলকে তাদের নিজস্ব ভাষায় দেখতে পেয়ে রোমাঞ্চিত হয়।
এটিই মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের সাফল্যের আসল কারণ হতে পারে: এর মিডিয়া আউটপুট গণতন্ত্র এবং মর্যাদার জন্য জনগণের আশা- আকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি। তুরস্কের নরম শক্তি কেবল তার ফিল্ম এবং টেলিভিশন শিল্পের মাধ্যমেই বিকাশ লাভ করছে, তা নয়, তুর্কি প্রোগ্রামের বিষয়বস্তু আদেশ নয়, হৃদয় ও মনকে অনুপ্রাণিত করা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন