শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লাইফস্টাইল

এ সময়ে লিচু খান

| প্রকাশের সময় : ১২ জুন, ২০২০, ১২:০২ এএম

ফলাফলাদির দেশ বাংলাদেশ। এক এক মৌসুমে নানা রকম ফল এদেশের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। মধুমাসে মধু ভরা বিভিন্ন মৌসুমে ফলে ভরপুর। মৌসুমে ফল মহান আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি এবং বিশেষ নিয়ামত। যা সবাই পছন্দ করে। মহান আল্লাহ তার বান্দাদের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রকৃতিতে অসংখ্য ফল সৃষ্টি করেছেন। যা ভক্ষন করে মানুষ দেহে রোগ প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলতে পারে। মনে রাখবেন শরীর সুস্থ রাখার জন্য ফলমূল সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টাটকা ফল দেহের রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। ফলে শরীরে কোন রোগ জীবাণু বাসা বাঁধে না।
পরিচিতি ঃ মৌসুমী ফলের মধ্যে লিচু অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল। পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু ফলের মধ্যে লিচু অন্যতম। এটি অত্যান্ত রসালো ফল। লিচু ফলের বাহিরের আবরণটি লালচে হলুদ আর ভিতরের রসালো সাদা অংশ খাদ্যাংশ তার ভিতরে কালচে কয়েরী রঙের বিচি থাকে। লিচুর আদিনিবাস চীনের দক্ষিণ অঞ্চল কাওয়াংতুং এবং ফুকিং প্রদেশ।
রাসায়নিক উপাদান ঃ তাজা ফলের রসালো শাঁসে থাকে অ্যামাইনো এসিড, এল-অ্যাসকরবিক এসিড, ফলিক এসিড এবং কনজুগেটস, চিনি, উদ্বায়ী যৌগ। ফলে আরো থাকে অ্যান্থোসায়ানিন, রঞ্জক, সায়ানিডিন-৩-গ্লুকোসাইড, সায়ানিডিন-৩-রুটিনোসাইড এবং মালভিডিন-৩-অ্যাসিটাইল গ্লুকোসাইড। বীজে থাকে স্যাপোনিন, লিউকোসায়ানিডিন এবং একটি হাইপোগ্লোসাইসেমিক পদার্থ আলফা গ্লাইসিন।
পুষ্টি উপাদান ঃ পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী টাটকা লিচুতে পুষ্টি উপাদান নিম্নরূপ ঃ খাদ্যশক্তি-৬৬ কিলোক্যালরি, শর্করা-১৭ গ্রাম, জলীয় অংশ ৮১.৭৫ গ্রাম, প্রোটিন- ১.১ গ্রাম, চর্বি ০.৪৪ গ্রাম, কার্বোহাইডেট- ১৬.৫৩ গ্রাম, আঁশ- ১.৩১ গ্রাম, চিনি- ১৫.২৩ গ্রাম, লোহা- ০.৩১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি- ৭২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি-১- ০.০২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২- ০.০০৭ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন- ০.৬ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ই- ০.০৭ মিলিগ্রাম, ভিটামিন কে- ০.৪২ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম- ১০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস- ৩১.১ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম- ১৭০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম- ১০ মিলিগ্রাম এবং অন্যান্য খাদ্য উপাদান সামান্য পরিমাণ রয়েছে।
উপকারিতা ঃ লিচুতে কোরেষ্টেরল নেই বললেই চলে। তাই শরীরকে সুস্থ ও সুন্দর রাখতে পরিমিত লিচু খাওয়া প্রয়োজন। ভিটামিন বি আমাদের দেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর অভাবে বেরি বেরি রোগ হয়, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, মানসিক অবসাদ, ক্লান্তি, খাওয়ায় অরুচি, মুখে জিভে ঘা, চামড়ায় লালচে দাগ পড়া, খসখসে হওয়া ও দেহের ওজন কমে যাওয়া এবং দেহে রক্তশূণ্যতা দেখা দেয়। ভিটামিন সি দেহে আয়রণ শোষণে সহায়তা করে। দাঁতের নানা সমস্যা দূর করে। মুখের ঘা, চুলের সমস্যা, চামড়ার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে ও চর্মরোগ প্রতিরোধ করে। লিচুতে বিভিন্ন খনিজ উপাদানের মধ্যে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস প্রচুর রয়েছে। পটাশিয়াম দেহের রক্ত প্রবাহ, হার্ট বিট নিয়ন্ত্রণ করে এবং উচ্চ রক্তচাপ বা হাই প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যালসিয়াম দাঁত, হাঁড় গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। লিচুতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে যা আমাদের দেহে টিটেনি নামক এক ধরনের জীবনঘাতি রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এ রোগে শরীরের মাংসের সংকোচন হয় এবং মাংস পেশীতে ব্যথা বেদনা অনুভূত হয়। ক্যালসিয়ামের অভাবে বৃদ্ধ বয়সে এবং মহিলাদের মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর (মেনোপজ) হাঁড়ের ক্ষয়জনিত রোগ অস্টিওপোরেসিস নামক রোগ হয়। এর সাথে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় অতি সহজে বা সামান্য আঘাতে দেহের হাঁড় ভেঙে যায়। লিচুর ক্যালসিয়াম তা প্রতিরোধ করে। লিচু শরীরের কোলেষ্টেরলের মাত্রা কমায়। খাদ্য হজমকারী আঁশ ভিটামনি এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট শরীরে জমা করে। প্রচন্ড গরমের সময়ে আমাদের শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি বের হয়ে যায়। এসময় লিচু খেলে পানির ঘাটতি পূরণ হয়। তাছাড়া লিচুতে রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা হৃদরোগের ঝুকি কমায়। দেহের রক্ত সঞ্চালন সুন্দর এবং সতেজ করে। লিচুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্স থাকে যা দেহের বিপাক ক্রিয়া বা মেটাবলিজম ক্রিয়া বৃদ্ধি করে। দেহে বিপাক ক্রিয়া কম হলেই মানুষের দেহে চর্বি জমা হয় এবং মোটা হয়, ওজন বাড়ে, সমস্যার সৃষ্টি হয়। লিচু দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে যথেষ্ঠ সাহায্য করে এবং হজম ক্রিয়া বৃদ্ধি করে। লিচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট মানুষের চামড়ায় বয়সের চাপ বা ত্বককে বুড়িয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। যৌবন ধরে রাখতে সাহায্য করে। উঠতি বয়সের মেয়েরা যারা মাসিক পরে শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয় তারা নিয়মিত লিচু খান। শরীরে রক্ত তৈরি হবে দুর্বলতা কমবে। লিচুতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি থাকায় ঘন ঘন সর্দি কাশি থেকে আমাদের রক্ষা করে।
ঔষধি গুণাগুন ঃ তাছাড়া লিচু খেলে আমাতের আরও যেসব উপকার সাধিত হয় তাহলো ঃ
* মস্তিষ্কে রক্ষক্ষরণ বা স্ট্রোক এবং হৃদ রোগের ঝুকি কমে। * যারা হাড়ের বিষ ব্যথা বা নানা সমস্যায় ভোগছেন লিচু খান উপকার পাবেন। * লিচুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটা ক্যারোটিন ও লিজোনল থাকে। যা হৃদরোগীদের জন্য বেশ উপকারী। * লিচু মানব দেহের ক্যান্সার কোষ সৃষ্টি করতে দেয় না এবং টিউমার সৃষ্টিতে বাঁধা দেয়। ফলে ক্যান্সার নামক ঘাতক রোগ থেকে দেহ বেঁচে থাকে। * বয়স্ক মহিলাদের লিচু খুবই উপকারী। * পোকা মাকড় বোলতা, বিছা কামড়ালে পাতার রস দিলে উপকার পাওয়া যায়। * মহিলাদের স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে লিচু। * সর্দি কাশি গলা ব্যথা জ্বর সারতে লিচু বেশ উপকার সাধন করে। * যারা শ্বাস নালী রোগে বা হাপানী (অ্যাজমা) রোগে ভোগছেন তারা লিচু খেলে উপকার পাবেন। * লিচু হজমের সমস্যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। * লিচু বয়সের চাপ ও চামড়ার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে। * যাদের মুখে ঘন ঘন ব্রুন হয় বা মুখে কালো দাগ পড়ে কপালে ভাজ পড়ে তারা পরিমিত লিচু খেলে উপকার পাবেন। * লিচুতে আছে আন-স্যাচুর্যটেড ফ্যাট যা দেহে অন্যান্য ভিটামিন শোষণে সাহায্য করে। * এটি শরীরে রক্ত জমাট বাঁধতে ও শরীরের বিষ ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। * কঁচি লিচু বসন্ত রোগের কাজ করে। * যাদের মুখে রুচি কম তারা নিয়মিত লিচু খান উপকার পাবেন। * অতি রোদ ও গরমের সময়ে ক্ষতিকর বেগুনি রশ্মি থেকে শরীরকে রক্ষা করে। * লিচুর ভিটামিন ই পুরুষের শুক্রাণু এবং মহিলাদের ডিম্বানুকে শক্তিশালী করে। ফলে শরীরের স্বাস্থ্য অটুট থাকে এবং প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে।
সতর্কতা ঃ লিচু একটি গরম ফল। মজা বেশী পেয়ে বেশি খাওয়া উচিত নয়। পরিমাণে বেশি খেলে অনেকেরই অ্যাসিডিটি বা গ্যাসের সমস্যা বা ডায়রিয়া হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে লিচু খেতে হবে। রক্তে শর্করা বেড়ে গেলে লিচু আর খাবেন না। কারণ লিচুর সুগার আপনার ডায়াবেটি বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া লিচু খাবেন না। আমরা ভেজালের রাজ্যে ডুবে আছি সুতরাং ভেজালমুক্ত মৌসুমী ফলমূল খান সুস্থ থাকুন।
মোঃ জহিরুল আলম শাহীন
শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখক
ফুলসাইন্দ দ্বি-পাক্ষিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ,
গোলাপগঞ্জ, সিলেট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন