এমএম খালেদ সাইফুল্লা
প্রাথমিক স্তরের ১১ কোটি ৫৭ লাখ বইয়ের বেশিরভাগই এবছর ছাপা হবে ভারত, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। আন্তর্জাতিক টেন্ডারের ৯৮টি লটের ৪৮টিতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ায় তারা একাই প্রায় অর্ধেক বই ছাপার কাজ পাচ্ছে। চীন ৯টি লট এবং দক্ষিণ কোরিয়া ৭টি লটে সর্বনিম্ন টেন্ডারদাতা হওয়ায় ৯৮টি লটের ৬৩টির কাজ চলে যাবে দেশের বাইরে। বাংলাদেশের ছাপাখানায় ছাপা হবে এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি অর্থাৎ ৩৫ লটের বই।
প্রাথমিকসহ স্কুল পর্যায়ের বই ছাপার কাজ দেশের ছাপাখানাগুলোর সাংবাৎসরিক আয়ের অন্যতম উৎস। প্রাথমিক শিক্ষার বই ছাপার কাজ প্রতি বছর আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমেই বিতরণ করা হয়। গত বছর টেন্ডারের পুরো কাজ পান বাংলাদেশের ছাপাখানার মালিকরা। দেশীয় ছাপাখানাগুলো গত বছর প্রতি ফর্মা বই ছাপার জন্য খরচ ধরেছিল ১ টাকা ৫৫ পয়সা। এ বছর ২ টাকা ২৭ পয়সা ধার্য করায় বেশিরভাগ কাজ ভারতসহ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়েছে।
স্মর্তব্য, শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক দরপত্রের তীব্র বিরোধিতা করে আসছেন দেশীয় মুদ্রণ শিল্প মালিকরা। কিন্তু তাদের যুক্তিসঙ্গত দাবি উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে দেশের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের কাজ। দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে প্রতি বছর ভারতে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ তুলে দেয়ায় হতাশ দেশের প্রেস মালিকরা। দেশের বিকাশমান মুদ্রণশিল্প রক্ষায় প্রেস মালিকরা বিদেশে পাঠ্যবই ছাপার অবসান দাবি করে আসছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রীর কাছে লিখিত চিঠিতে তারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কম মূল্যে দরপত্র দাখিল করলেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হবে এমন ধারণা ঠিক নয়। দরপত্রদাতাদের আনুষঙ্গিক যোগ্যতাও যাচাই করা হবে। আমরা আশা করব, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। এক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা অপসারণেরও উদ্যোগ নেয়া হবে।
বাংলাদেশের মুদ্রণ শিল্প সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চোখে পড়ার মতো বিকাশ লাভ করেছে। দেশীয় বই ছাপার পাশাপাশি তারা বিদেশের বই ছাপানোরও কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। তারপরও দেশের মুদ্রণ শিল্পের মুদ্রণ ক্ষমতার এক বড় অংশ অব্যবহৃত থাকছে। কাজের অভাবে দেশের মুদ্রণ শিল্পে হতাশা বিরাজ করলেও এর আগে ২০১৪ সালে ভারত থেকে তিন কোটি প্রাথমিক পাঠ্যবই ছাপানো হয়েছে। দেশে মানসম্মত কাগজ উৎপাদন হলেও বাংলাদেশের শিশুদের জন্য ছাপানো ওই তিন কোটি বইয়ে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের ভারতীয় কাগজ। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ভাষ্য, মাধ্যমিক পর্যায়ের সব বই দেশীয় মুদ্রণশিল্পে ছাপা হয়। প্রাথমিক বইয়ের ক্ষেত্রে সরকারের হাত-পা বাঁধা। বিশ্বব্যাংক এ বই ছাপানোর কাজে অর্থ সাহায্য দেয়। তাই তাদের সুপারিশ অনুযায়ী বই ছাপানোর কাজে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়।
জানা গেছে, বাংলাদেশের আইন অমান্য করে ভারত থেকে ছাপানো হয়েছে প্রাথমিকের প্রায় ১০ কোটি বই। এতে প্রায় ৬০ কোটি টাকা লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে সরকার। ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ভারতীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকের ৯ কোটি ৬৪ লাখ বই ছাপিয়েছে। প্রতিবারই দেশের আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। দেশীয় প্রকাশকরা প্রতিবাদ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার।
২০১০ সাল থেকে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে বই ছাপানোর কাজ দেয়া হচ্ছে। ওই বছর প্রাথমিকের মোট ১০ কোটি ৪৮ লাখ ৬ হাজার ৪৭৫ কপি বই ছাপানো হয়। এর মধ্যে ভারত থেকে ছাপানো হয় ৩ কোটি ৩১ লাখ। বাকি বই ছাপা হয় দেশীয় প্রতিষ্ঠানে। সব মিলে ব্যয় হয় ২৫৪ কোটি ৪৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৯৩ টাকা। ২০১১ সালে ৮ কোটি ৯ লাখ ১৩ হাজার ৯২৩ কপি বই ছাপানো হয়। এর মধ্যে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ছাপানো হয় ১ কোটি ৪৬ লাখ। বাকি বই দেশীয় প্রতিষ্ঠানে ছাপানো হয়। সব মিলে ব্যয় হয় ৩০০ কোটি ৮১ লাখ ৭৭ হাজার ২৪৪ টাকা। ২০১২ সালে ছাপা হয় ১০ কোটি ৭১ লাখ ৫৮ হাজার ২৬৭ কপি বই। এর মধ্যে ভারত থেকে ছাপা হয় ৩ কোটি ৩১ লাখ বই। বাকি বই দেশীয় প্রতিষ্ঠানে ছাপানো হয়। সব মিলে ব্যয় হয় প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে ছাপা হয় ১১ কোটি ৫৯ লাখ বই। এর মধ্যে ভারত থেকে ছাপানো হয় ১ কোটি ৫৬ লাখ বই। বাকি বই দেশীয় প্রতিষ্ঠানে ছাপানো হয়। সব মিলে ব্যয় হয় ৩৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, ঘুরেফিরে কয়েকটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বই ছাপার কাজ পাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণা ট্রেডার্স, ভিকে উদ্যোগ, গফসন, পৃতম্বরা বুকস, সুদর্শন বোর্ড অ্যান্ড পেপার মিলস। ৪ বছরে সরকার প্রাথমিকের ৪০ কোটি ৮৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬৬৫ কপি বই ছাপিয়েছে। তাতে ব্যয় হয়েছে ১২২৫ কোটি ৮১ লাখ ৪৭ হাজার ১৩৭ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ছাপিয়েছে ৯ কোটি ৬৪ লাখ কপি বই।
বাংলাদেশী প্রকাশকরা যে দামে বই ছাপিয়েছে একই দামে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বই ছাপালে তারা ৪ বছরে ২৮৯ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার ৬৯১ টাকা ২৮ পয়সা বই ছাপানো বাবদ পেয়েছে। এ টাকার উপর ২০.৪৩ ভাগ আমদানি শুল্ক বাবদ সরকার পরিশোধ করেছে ৫৯ কোটি ৫৮ লাখ ৪ হাজার ৪৫২ টাকা ২৩ পয়সা।
মুদ্রণ শিল্পের মালিকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক দরপত্রের মূল্যায়নে বিদেশি কোম্পানির ক্ষেত্রে ধরা হচ্ছে কর দেয়ার আগের দাম আর দেশীয় কোম্পানির ক্ষেত্রে কর দেয়ার পরের দাম। ফলে বাংলাদেশী দরপত্রদাতাদের বদলে বিদেশি দরপত্রদাতারা লাভবান হচ্ছেন। তাদের দরপত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে মানসম্মত কাগজ উৎপাদন হচ্ছে। এ কাগজ বহু দেশে রপ্তানিও হচ্ছে। দেশের মুদ্রণ শিল্পও এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে কেন বিদেশিদের প্রতি আনুকূল্য দেখানো হচ্ছে তা একটি রহস্যপূর্ণ বিষয়।
ষ লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, কেন্দ্রীয় কমিটি ও সভাপতি ঢাকা মহানগর, এলডিপি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন