আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
আশার কথা, বিলম্বে হলেও ইসলামি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা জাতীয়ভাবে আলোচিত হচ্ছে। কিছু বিপথগামী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ধর্মীয় আচ্ছাদন বা ধার্মিকতার আশ্রয়ের কারণে বাংলাদেশের নিরিহ-নির্বিবাদী আলিম, মাদরাসা শিক্ষার্থী এবং মসজিদ-মাদরাসার ওপর অহেতুক মিথ্যা কলঙ্ক লেপন করা হয়। সাম্প্রতিক কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় ওই অপবাদের কালো ছায়া কিছুটা হলেও কেটেছে। এ যেন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ধেয়ে আসা ঝড় ‘উড়িষ্যা উপকূল’ অতিক্রম করে চলে যাওয়া। এ যেন ধর্মীয় অঙ্গনে মহান আল্লাহ্র রহমতের বারিধারা। আধুনিক অভিজাত পরিবারের সন্তানও এখন দেখা যাচ্ছে নিরাপত্তা বিঘœকারী তৎপরতায় জড়িত। তবে অপরাধী অপরাধীই। সে কি মাদরাসা না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তা বিবেচ্য নয়। অন্যদিকে এটাও সত্য দেশের নতুন প্রজন্মকে সুস্থ-স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক আবহে গড়ে তোলবার ক্ষেত্রে ইসলামি শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
দুঃখজনক সত্য, মহাকালের ¯্রােতধারায় আমরা আমাদের চিরায়ত ধর্মীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বিস্মৃত হয়েছি। এখন আর কাকডাকা ভোরে, ঘরে ঘরে পবিত্র কুরআনের মধুর আওয়াজ শোনা যায় না। মসজিদ আঙ্গিনা বা মক্তবে শিশুদের কলকাকলি মুখরিত অবস্থা দেখা যায় না। অনেক মায়েরা ‘স্টার জলসা’য় মদমত্ত। দাসী-বাদী বা বুয়ারা, অর্ধজাগ্রত শিশুকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে জ্ঞান রাজ্যের স্বর্ণালি দুয়ারে। সে কী বাহারী আয়োজন; ওয়ার্ড বুক, ওয়ার্ক বুক, টিফিন বক্স, ওয়াটার ব্যাগÑ যেন শিশুটি নীল আর্মস্ট্রংয়ের মতো চাঁদের দেশে যাচ্ছে। ওই বিশাল বোঝাটিও শিশুটি বহনে অক্ষম। এভাবেই গড়ে ওঠছে প্রাণহীন ও শৈশব বঞ্চিত প্রজন্ম। বরং প্রয়োজন ছিল এমন এক পরিবেশ যাতে ‘আল কুরআনের সতর্কবাণী অবলোকন ও অনুধাবণ করলে সুকঠিন মানবাত্মাও প্রকম্পিত না হয়ে পারে না। তেমন আশ্বাসবাণী অনুধাবন করে অন্ধ মনের বন্ধ দুয়ার খুলে যায়, রুদ্ধ কর্ণকুহর প্রত্যাশার পদধ্বনী শুনতে পায়। আর মৃত অন্তরাত্মা ইসলামের অমীয় সুধা পানের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। এসব মিলে হৃদয়রূপ বেতারযন্ত্রে বেজে উঠে ঐশীপ্রেমের মন মাতানো রাগ-রাগীনীর সুমধুর সুরলহরী’ (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১ম খন্ড: ই ফা বা)।
মানবতার ধর্ম ইসলাম, উদার ও সহজপন্থায় বিশ্বাসী। প্রিয়নবী (স.) বলেন “সহজ কর, কঠিন করো না; সুসংবাদ জানিয়ে আহ্বান কর ভীতি প্রদর্শন করে তাড়িয়ে দিও না” (বুখারি)। কাজেই, আমাদেরকে ইসলামের প্রকৃত সত্য ও সৌন্দর্য খুঁজে পেতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় নিবেদন:
‘মোরা বুঝিব সত্য, পূজিব সত্য, খুঁজিব সত্যধন।
জয় জয় সত্যের জয়।
যদি দুঃখ দহিতে হয় তবু মিথ্যাচিন্তা নয়।
যদি দৈন্য বহিতে হয় তবু মিথ্যাকর্ম নয়।
যদি দ- সহিতে হয় তবু মিথ্যাবাক্য নয়।
জয় জয় সত্যের জয়।’
বর্তমানে আতঙ্ক ও আলোচনার বিষয় সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ। এগুলো রোধে ইসলামি শিক্ষার বিকল্প নেই। অথচ অজ্ঞাত কারণে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ‘ইসলাম শিক্ষা’ অযতœ অবহেলার শিকার। স্কুলে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ বইটি ‘ইসলাম ধর্ম শিক্ষা’ নামে প্রচলন করা গেলে হয়তো শিশু কিশোর মননে ‘ধর্মচিন্তা’ স্পষ্টতর হতো। স্কুলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লাস্ট পিরিয়ডে ‘ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা’ ক্লাস থাকে। শুধু এ কারণেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় এ প্লাস না পেয়ে ‘গোল্ডেন’ থেকে বঞ্চিত হয়। এমন অবহেলায় নতুন প্রজন্মের কাছে অপরিচিত থেকে যায় ধর্মীয় চেতনাবোধ।
রক্ত¯œাতপথে স্বাধীনতার পর ইসলামি শিক্ষা প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ এবং ‘মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড’ গঠন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘অ্যারাবিক এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ’ থেকে আলাদা হলো ‘ইসলামিক স্টাডিজ’। কিন্তু বর্তমানে কলেজ পর্যায়ে ইসলাম শিক্ষার অবস্থা ভালো নেই। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বিষয় বিন্নাসের জন্য শঙ্কায় আছিÑইসলাম শিক্ষা আস্তে আস্তে কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে? নীতিমালা অনুযায়ী ‘ইসলাম শিক্ষা’ শ্রেফ ঐচ্ছিক। এতে আশঙ্কাজনক হারে সব কলেজেই ইসলাম শিক্ষায় ছাত্রসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে! বোর্ডগুলোতে ২০১৩ বা ২০১৪ এবং ২০১৫ বা ২০১৬ এর পরীক্ষার্থী সংখ্যা দেখলেই বিষয়টি স্পস্ট হবে। এইচএসসিতে ২০১২- ২০১৩ শিক্ষাবর্ষেও বিষয়টি ৩য় বা ৪র্থ হিসেবে নেবার সুযোগ ছিল (‘ক’ ‘খ’ গুচ্ছ বিন্ন্যাস অনুসারে)। আমি অধ্যাপনার ২৪ বছরে দেখেছি, আগে সব গ্রুপের সবাই বিষয়টি নিতে পারতো। ১৯৯৮ বা আরো আগে বিষয়টি আবশ্যিকের গুরুত্ব রাখতো। শুধু তাই নয়, ডিগ্রি পর্যায়েও নানান নিয়মের প্রতিবন্ধকতা ও সুযোগ সঙ্কুচিত হবার ফলে ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ নিতে পারে না। অনুরূভাবে সমাজবিজ্ঞান শাখায় অনার্সের শিক্ষার্থীদের ‘ননমেজর’ বিষয় হিসেবে ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ নেবার সুযোগ নেই।
ধর্মের অপব্যাখ্যা ও ব্যবহারের মাধ্যমে জনজীবনে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে তার অন্যতম কারণ, পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি বিদ্বেষ, দেশি-বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা, অবৈধ অর্থ-অস্ত্রের জোগান, বেকারত্ব, ব্যক্তিগত হতাশা, শিথিল পারিবারিক বন্ধন, অতি ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, মিথ্যা প্রলোভন, মাদকাশক্তি, অপশিক্ষা, অর্ধশিক্ষার বিরূপ প্রভাব ইত্যাদি। অথচ সত্য কথা হলো, একপাক্ষিক হটকারী ও গোপন কূটকৌশল ইসলামের দর্শন নয়। বরং ইতিহাস বলে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শান্তি ও সংলাপের পথে। আধ্যাত্মিকতা, ইবাদত, আখলাক, ইখলাস, দোয়া, দাওয়াৎ-ই-তাবলিগ, মানব সেবা, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি চেতনার কারণে ইসলামকে বলা হয় ‘শান্তির ধর্ম’। সারা দুনিয়াই যেন ইসলামের ইবাদতের জন্য বিস্তৃত গালিচা বিশেষ।
গায়ের জোরে অথবা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রিয়নবীর (স.) জীবনাদর্শ ছিল আত্ম সংযম ও আত্ম প্রশিক্ষণের। প্রতিপক্ষের আঘাতে তিনি (স.) বারবার হয়েছেন রক্তাক্ত। তবু তিনি (স.) ওদের অমঙ্গল কামনা না করে বরং কেঁদে কেঁদে ওদের হেদায়েত ও ইসলামের জন্য আল্লাহ্র সাহায্য কামনা করেছেন। তাইতো শান্তির পথ চলায় হিজরি ৬ষ্ঠ সালে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল যেখানে ১৪০০ জন, সেখানে হুদাইবিয়ার সন্ধির (যুদ্ধ নয় শান্তি চুক্তি) কারণে ৮ম হিজরিতে ‘মক্কা বিজয়ে’র সময় মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় দশ হাজার। আর দশম হিজরিতে ‘বিদায় হজ্জ্বে’র সময় খোদ আরাফাতের ময়দানেই উপস্থিত ছিলেন কয়েক লাখ মুসলমান। এগুলো সম্ভব হয়েছিল ইসলামের শান্তিময় কৌশলের সুবাদে।
পীর আওলিয়ার পূণ্যস্পর্শে ধন্য আমাদের প্রিয় স্বদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধ্যাত্মিকতা ও ঈমানী শক্তিতে। ইসলামের আদর্শ, কর্ম, সততা, সাধুতায় পরিপূর্ণ আমাদের দেশের মানুষ অত্যন্ত শান্তি প্রিয়। পবিত্র ও পূণ্যময় কাজের কোনো কিছুই একজন মুসলমান বাদ দিতে পারেন নাÑ এ বাস্তবতায় ইসলাম বাংলাদেশের মানুষের পরম জীবন ঘনিষ্ট দর্শন। বাংলাদেশে ইসলামের প্রভাব জীবনের সবখানে এবং সবসময়। তাই ‘ঈমান ও ইসলামে’র প্রকৃত স্বরূপ প্রসঙ্গে আমাদের জাতীয় কবির নিবেদনÑ ‘আল্লাহ্তে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান....।’
পরিশেষে বলতেই হয়, ইসলামি শিক্ষার বিকাশে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক অথচ ‘ইসলাম শিক্ষা’ বিষয়টি অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে গেছে! কিন্তু ইসলামি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই এবং তা বাধ্যতামূলক হওয়াই জরুরি ও সময়ের দাবিÑ ‘সর্বস্তর ও সব গ্রুপের সবার জন্য ইসলাম শিক্ষা উন্মুক্ত রাখা’। কেননা, এতেই ইসলাম ও মুসলমানের খেদমতের পথ সুগম হবে।
ষ লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন