জামালউদ্দিন বারী
দেশ আজ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের আতঙ্কে প্রকম্পিত। সরকার ও বিরোধী দলে চলছে জঙ্গিবাদকেন্দ্রিক রাজনীতি। জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসের ব্লেইম গেমের পাল উড়িয়ে একপক্ষ গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বাভাবিক শর্তসমূহ পাশ কাটিয়ে নিজেদের শাসন ক্ষমতাকে আরো সংহত ও দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছে বলে মনে করছে সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীরা। আবার সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করে, সরকারের ভিতকে নড়বড়ে করে দিয়ে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় যেতে চাইছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে প্রকারান্তরে দাবি করা হচ্ছে। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি-হামলার নেপথ্যে বিরোধী দলের লোকদের সম্পৃক্ত থাকার একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে শিগগিরই এ বিষয়ক গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে বলে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন। হ্যাঁ গোয়েন্দা রিপোর্ট, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রিপোর্ট সরাসরি জনসম্মুখে না এলেও চমক লাগানো এসব রিপোর্টের অন্তরালে যে অনেক রাজনীতি থাকে তা নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। ইরাক যুদ্ধের আগে সাদ্দাম হোসেনের হাতে রাসায়নিক অস্ত্রসহ ব্যাপক গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের মজুদ থাকার গোয়েন্দা রিপোর্টটি যে ভুয়া ছিল, তা এ সংক্রান্ত বৃটেনের চিলকট তদন্ত রিপোর্টে সম্প্রতি আবারো প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে ভুল গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে এবং অধিক যাচাই-বাছাইসহ বিকল্প পন্থাগুলোকে পাশ কাটিয়ে বুশের তড়িঘড়ি ওয়ার অন টেরোরিজমে বৃটিশদের নিঃশর্ত সমর্থন এবং ইরাকের বিরুদ্ধে সমারাভিযানে সক্রিয় অংশগ্রহণ যে বড় ধরনের ভুল ছিল তা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। সারা বিশ্বে নিñিদ্র গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক এবং অত্যধুনিক প্রযুক্তিগত নজরদারির পরও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের গোয়েন্দা রিপোর্টে ভুল হয়। এই ভুল স্বেচ্ছাকৃত কিনা সেটাই এখন মূল বিবেচ্য বিষয়। গোয়েন্দা রিপোর্টে বিভ্রাটের কারণ যা-ই হোক, এক যুগেরও বেশি সময়ের ন্যাটো হামলায় সমৃদ্ধ ইরাক ধ্বংস ও মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। এখনো সেই বিভীষিকা থেকে ইরাকিরা বেরিয়ে আসতে পারছে না। পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসন ও প্রক্সি মার্সেনারি গৃহযুদ্ধের কারণে প্রায় প্রতিদিনই সেখানে গাড়িবোমাসহ আত্মঘাতী হামলায় অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। ওরা বলছে, যুদ্ধের আগের গোয়েন্দা রিপোর্টে ভুল তো ছিলই, তদুপরি যুদ্ধের পরবর্তী ইরাক পরিস্থিতি কী হতে পারে এবং তা সামাল দিয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে নেয়ার সামগ্রিক কর্মপন্থায়ও বড় ধরনের ঘাটতি ছিল বলেই সাদ্দামকে হত্যা করার পর এক দশক পেরিয়ে এসেও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে তালেবান পরবর্তী আফগানিস্তান, গাদ্দাফির পতন পরবর্তী লিবিয়াতেও। লিবিয়ার মতো একই কায়দায় সিরিয়াতে এতদিনে বাশারের পতন ঘটিয়ে সেখানে বিদ্রোহীদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটত এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে মুসলিম বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে একটি দুর্লভ ব্যতিক্রমী ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তিউনিসিয়ার ‘ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্ট্রটে’ নামের নাগরিক সমাজের একটি উদ্যোগ। আরব বষন্তের কেন্দ্রস্থল তিউনিসিয়ায় গণঅভ্যুত্থানে দুই যুগের স্বৈরশাসক বেন আলীর পতনের পর সেখানে গৃহযুদ্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। এরই মধ্যে একের পর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাসহ গুপ্তহত্যা ও টার্গেট কিলিং শুরু হওয়ার প্রেক্ষাপটে সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, অনাস্থা ও হানাহানি বেড়েই চলেছিল। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখে তিউনিসিয়ার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি এবং আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত চতুর্ভুজ সংগঠনটির চাপে রাজনৈতিক দলগুলো একটি জাতীয় সংলাপে বসতে বাধ্য হয়। র্যাডিকেল ইসলামিস্ট এবং সেক্যুলার রাজনীতিকদের জাতীয় স্বার্থে একটেবিলে বসানোর দুরূহ কাজটি করেছিল ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্ট্রেট। এভাবেই তিউনিসিয়ার ব্যবসায়ী, শ্রমিক ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজ তাদের দেশকে একটি অবধারিত গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়। এই সুবাদে তিউনিসিয়ার সেই ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্ট্রেট ২০১৫ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভের মধ্য দিয়ে এক নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয়।
বাংলাদেশ এখনো কোনো বহুজাতিক সামরিক আগ্রাসনের শিকার হয়নি। সাম্প্রতিককালে কোনো সামরিক বা গণঅভ্যুত্থানও ঘটেনি। জাতিগত বিরোধও এ দেশে কোনকালেই সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি। অথবা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের দায়িত্ব পালনের বাইরে কোনো প্রতিবেশী বা অন্য কোনো দেশের ওপর কখনো সামরিক আগ্রাসন বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করেনি। এ ধরনের ভূমিকা পালনের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বা সামর্থ্যও বাংলাদেশের নেই। তাহলে বাংলাদেশ কেন জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের টার্গেট হচ্ছে? এটা কি আদৌ জঙ্গিবাদী টার্গেট নাকি আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদের কুশীলবদের কোনো সাজানো নাটক বা ফলস ফ্লাগ? এখনো কিছুই স্পষ্ট নয়। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বাংলাদেশের বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতাকে কখনো কখনো একটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে বলে উল্লেখ করছে। এর বিপরীতে আমাদের বন্ধুপ্রতিম বড় প্রতিবেশী দেশ ভারতের আসাম রাজ্যের বিধান সভার এক বিধায়ক বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ এনে বাংলাদেশকে শিক্ষা দিতে দিল্লির প্রতি প্রকারান্তরে যুদ্ধ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন বলে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। যে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ভারতের কাক্সিক্ষত সবকিছু না চাইতেই দিয়ে দিয়েছে, সেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পিত অভিযোগে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসাম বিধানসভার বিধায়কের প্রস্তাব উত্থাপন একটি অশুভ আলামত। এমন সময় এ প্রস্তাব উত্থাপিত হলো যখন সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের এক অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। গত দেড় বছরে সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত ঘাতক ও জঙ্গিদের হাতে অন্তত ২০ জন বিদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। গত বছর ইতালীয় ও জাপানি নাগরিক তাভেল্লা সিজার এবং হোসি কোনিও সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়ার পর এবার ঈদের আগে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলায় ৯ জন ইতালীয় এবং ৭ জন জাপানি নাগরিক নিহত হয়েছেন। এরপরও জাপান এবং ইতালি সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। সেসব দেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তোলেনি। বিগত প্রায় সাত দশক ধরে প্রতিবছর ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শত শত মানুষ নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই মুসলমান। মুসলমান নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে আজ পর্যন্ত কোনো মুসলমান রাষ্ট্রের কোনো নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তি ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলেছে বলে কোনো নজির নেই। বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে বাংলাদেশের প্রতিবেশী একটি ভারতীয় রাজ্যের রাজ্যসভায় হিন্দু নির্যাতনের কাল্পনিক অভিযোগ এনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব উত্থাপন একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা তা সংশ্লিষ্ট সবাইকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।
গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় সন্ত্রাসী জঙ্গি হামলার সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও এসব জঙ্গিবাদী তৎপরতাকে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের অংশ বলেই মনে করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের বেশ কয়েকটি শহরে সন্ত্রাসী হামলার ধরন এবং দায় স্বীকারে অভিন্ন (আইএস) জঙ্গিবাদী গ্রুপের নাম এসেছে। সম্প্রতি আইসিএইচ ব্লগে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল, ‘ফল্স ফ্লাগ ইন মাসপ্রোডাকশন’। পশ্চিমা অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক পিটার কুয়েনিগের লেখা নিবন্ধটির শুরুতেই লিখেছেন-
Another false flag in Wurzburg, Bavaria, Germany. A young man attacks four passengers in a train and later a passerby in the street. The scenes repeat themselves now in rapid cadence. Paris, Brussels, Nice, Bangladesh… Same patterns, same motives – and same group of terrorists claiming credit. The lies and propaganda are becoming more flagrant, and, We, the People, just swallow it. No questions asked. For how long? Until it is too late – when we are all militarized and can’t make a move without being watched– or killed for disobedience?
অর্থাৎ, ‘জামার্নির বেভারিয়া, উর্জবার্গে আরেকটি ফল্স ফ্লাগ আক্রমণ হলো। একজন তরুণ ট্রেনে চারজনকে ধারালো অস্ত্রে আক্রমণ করার পর রাস্তায় আরেকজনকে আক্রমণ করল। দ্রুততম সময়ে সামান্য বিরতিতে একই ছন্দে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে। প্যারিস, ব্রাসেলস, নিস, বাংলাদেশ... একই পন্থা একই ধরনের লক্ষ্য এবং একই সন্ত্রাসী গ্রুপের দায় স্বীকার। মিথ্যা প্রচারণা এবং প্রপাগান্ডা ক্রমেই জাজ্বল্যমান হয়ে উঠছেÑ আর আমরা জনগণ এসব হজম করে চলেছি। কেউ কোনো প্রশ্ন করছি না। এভাবে আর কতদিন? আমরা সকলে সশস্ত্র হলে অথবা সরকারি নজরদারির আওতার বাইরে চলাচলের সুযোগ রহিত হলে অথবা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে হত্যার শিকার হওয়া পর্যন্ত কি এ থেকে আমাদের মুক্তি নেই? ’ কোয়েনিগ নিজেই এসব প্রশ্নের সাথে আরো প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন এবং সম্ভাব্য বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। পল ক্রেইগ রবার্টসর লেখা উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, এটা হচ্ছে সিআইএ পরিচালিত নতুন ‘গ্লাডিও’। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের স্বাধীন চিন্তাকে নির্মূল করা, ভয় ও আতঙ্ক ছড়ানো, নাগরিক সমাজকে বাধ্য করতে এই তৎপরতা চালানো হচ্ছে। গ্লাডিও হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশেষত ইতালি ও ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করতে সিআইএর একটি গোপন অপারেশনের ‘কোডনেম’। এই প্রকল্পের আওতায় নিজেরাই নানা অপকর্মের ফল্স ফ্লাগ অপারেশন চালিয়ে কমিউনিস্টদের ওপর দায় চাপানোর পাশাপাশি এসব অপকর্মের নেপথ্যে সোভিয়েত মদদ প্রমাণ করে ঠা-া লড়াই জমিয়ে রাখার অপকৌশল মাত্র। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন নিরপেক্ষ তদন্ত রিপোর্টে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে উইকিলিক্স’র ফাঁস করা গোয়েন্দা তথ্যেও এসব বিষয় উঠে এসেছে।
সেসব ছিল কোল্ড ওয়ার ও বৈশ্বিক সা¤্রাজ্যবাদের গোপন এজেন্ডা। একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখা ও শক্তিশালী করা, অন্যদিকে সোভিয়েত পারমাণবিক হুমকি ও কমিউনিজমের হুমকি সামনে রেখে পশ্চিমা সমাজকে ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্রে সশস্ত্র করার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বাণিজ্যসহ বিশ্বঅর্থনীতিকে নিজেদের করায়ত্ব রাখাই এই এজেন্ডার প্রধান লক্ষ্য। দুই প্রধান পরাশক্তির ঠা-া লড়াই থেমে যাওয়ার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মিসর, ইয়েমেন, সুদান এবং সিরিয়ায় সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বলছে। ফিলিস্তিনের মুসলমানরা ৬৮ বছর ধরেই ইসরাইলি বন্দুকের নলের মুখে আছে। বছরের পর বছর ধরে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ রাখার পরও যখন তখন পাখির মতো গুলি করে ইসরাইলি শিশু-নারী ও পুরুষদের হত্যা করা হচ্ছে। একইভাবে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মুসলমানরাও প্রায় ৭০ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। গত ৮ জুলাই কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী নেতা বুরহান ওয়ানি পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর উত্তাল কাশ্মীরিদের দমাতে ভারত যে পন্থা অবলম্বন করছে মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক গবেষক নোয়াম চমস্কি তাকে ইসরাইলের হাতে ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রিত ও নির্যাতিত হওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি বর্বরতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম জিহাদি তৈরি হচ্ছে বলে সম্প্রতি বৃটিশ হাউস অব লর্ডস সদস্য ব্যারোনেস টঙ্গ মন্তব্য করেছেন। ইতিপূর্বে বৃটিশ এবং মার্কিন রাজনীতিকদের অনেকেই আইএস সৃষ্টির জন্য মার্কিনিদের ভুল নীতি এবং ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে দায়ী করেছেন। মোটকথা মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিবাদ সৃষ্টির জন্য পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ ও তার সুফলভোগী ইসরাইল প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দায়ী। কাশ্মীর এবং বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদের সেই একই ফর্মুলা ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত মসজিদের ইমাম ও খতিবদের এক সমাবেশে ইমামদের প্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ নেতারা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী হামলাকে ইসরাইলি ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন। একের পর এক জঙ্গি হামলার কারণে একদিকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশের নির্বাচনীব্যবস্থাসহ রাজনৈতিক সংস্কার, জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার সম্ভাবনা, আইনের শাসন, জননিরাপত্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক ভাইরাল হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যখন জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়া হচ্ছে, ঠিক তখন নি¤œ আদালতে খালাস পাওয়া মামলায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সাত বছরের জেল দিয়ে রাজনীতি ও নির্বাচন থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দেশে যখন রাজনৈতিক সমঝোতা ও জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন তখন দেশের কোটি কোটি মানুষের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতাদের জেল দিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলার অর্থ হচ্ছে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের জন্য আরো উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় ঢাকার ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করা ধনী পরিবারের সন্তানদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে রোহান ইমতিয়াজ নিহত ছয়জন জঙ্গির একজন। এর মানে কি এই যে এই হামলার পেছনে আওয়ামী লীগ জড়িত? ব্লেইম গেমের রাজনীতিতে বিরোধী দল এমন দাবী করতেই পারে। বিপরীত চিত্রে জঙ্গিবাদে উসকানি ও মদদদাতা হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের কোনো কোনো নেতার সংশ্লিষ্টতার গোয়েন্দা তথ্যও বেরিয়ে আসতে পারে? এসব তথ্য এবং দোষারোপ ও দমন-পীড়নের রাজনীতি জঙ্গিবাদ দমনে বিশ্বের কোথাও কাজে আসেনি। সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশের কোনো কোনো জেলায় হত্যাকা-ের চেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা চার-পাঁচগুণ বেশি। সম্প্রতি এসএসএফের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দেয়া এক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের তরুণদের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে অভিভাবকদের পরিবারে আরো সময় দিয়ে সন্তানদের কথা শোনার পরামর্শ দিয়েছেন। মানুষের মধ্যে জমে ওঠা ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ, অসন্তোষ ও হতাশা মানুষকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলতে পারে। সামাজিক অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে নীরব মৃত্যুর পথ বেছে নেয়। এসব হতাশ তরুণকে বিভ্রান্ত করে জঙ্গিবাদের সুইসাইডাল স্কোয়াডে নিয়োজিত করার কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক ও কাশ্মীরের মুসলমান তরুণরা জঙ্গিবাদের সেই ফাঁদেই পা দিচ্ছে। এখন বাংলাদেশও তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক বিভেদ এবং বিরোধী দল নির্মূলের রাজনৈতিক এজেন্ডা সেই পথকেই সহজ করে দিচ্ছে। একজন অতি সাধারণ মানুষও বোঝেন- দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও বিরোধী মতের স্পেস না থাকা, পুলিশি নির্যাতন, নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ যুব সমাজকে বিক্ষুব্ধ করে তোলছে। ধনী পরিবারের সন্তানরাও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার পেছনে এসব বিষয়কে দায়ী করছেন দেশের অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এসব বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ও আন্তরিক রাজনৈতিক উদ্যোগ ছাড়া সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের হুমকি মোকাবেলা অসম্ভব। সা¤্রাজ্যবাদের নতুন গ্লাডিও এবং ইসলামোফোবিয়ার বৈশ্বিক অপরাজনীতির কুশীলবদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে জাতিকে বিভক্ত করা এবং সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের বিপজ্জনক খেলা বন্ধ না হলে এ থেকে মুক্তির আপাতত কোনো পথ খোলা নেই। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে জাতিকে মুক্ত করতে তিউনিসিয়ার ডায়ালগ কোয়ার্ট্রেেটর মতো রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগের পথ হয়তো এখনো খোলা আছে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন