বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

চতুর্মুখী বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে ভারত

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ২৪ জুন, ২০২০, ১২:০১ এএম

চীন ও ভারতের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্কের ঘটনা নতুন কোনো খবর নয়। এশিয়ার এই দুই পারমাণবিক শক্তিধরের মধ্যকার বৈরিতা ও উত্তেজনা দীর্ঘ দিনের। বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের নতুন অন্তরঙ্গতা, চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা লড়াই, বাণিজ্যযুদ্ধ ও উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ভারত-চীন বৈরিতা এক নব মাত্রায় উন্নীত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি লাদাখের গলওয়ান উপত্যকায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষে ১ জন কর্নেলসহ ২০ ভারতীয় জওয়ান নিহত হয়। গলওয়ানের ওই এলাকাকে চীন তাদের ভূখন্ড বলে দাবি করেছে। চীন বলছে, গলওয়ানের সার্বভৌমত্ব চীনের। ভারতীয় বাহিনী তা লঙ্ঘন করেছে। চীনা ভূখন্ডেই সংঘর্ষ হয়েছে। সে জন্য চীনকে দোষ দেয়া যাবে না। চীন ও ভারতের মানুষ যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পর্যুদস্ত, তখন সীমান্ত বিরোধ সঙ্কটকে আরো তীব্র করবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্কীর্ণ মানসিকতা থেকে জাতিগত বিরোধের জন্ম হচ্ছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। এ অঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠীর স্বার্থে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার হিংসাত্মক মনোভাব থেকে নেতাদের সরে আসা উচিত।

লাদাখ সংঘর্ষ ভারত-চীন সম্পর্কের জন্য একটি বড় ধাক্কা। হাতাহাতি ও মুখোমুখি সংঘর্ষে এতজনের মৃত্যু এর আগে দেখা যায়নি। ভারতের চলমান রাজনীতিতেও এই ঘটনা প্রভাব ফেলেছে। গত ৬ বছরে এই প্রথম সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। লাদাখ নিয়ে কংগ্রেস বেশ কিছুদিন ধরে সরব। সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী বারবার টুইট করে প্রকৃত অবস্থা জানতে চেয়েছেন। চীন কী করে ভারতের জমি কবজা করল, সেই প্রশ্ন রেখেছেন। মোদি গুরুত্ব দেননি। সংঘর্ষ ও প্রাণহানির পর রাহুল প্রধানমন্ত্রীর নীরবতাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। টুইট করে জানতে চান, ‘প্রধানমন্ত্রী নীরব কেন, কেন তিনি মুখ লুকোচ্ছেন?’ সমালোচনায় মুখর হন অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও। সম্মিলিত এই চাপের মুখে শুধু বিবৃতিই নয়, সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতেও বাধ্য হলেন মোদি।

লাদাখে গত মে মাস থেকে চলছে উত্তেজনা। দারবুক থেকে দৌলত বেগ ওল্ডি বিমান বাহিনী (বায়ুসেনা) ঘাঁটি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণরেখার সমান্তরালে ভারত ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ যে রাস্তা তৈরি করছে, মূলত তা নিয়েই আপত্তি চীনের। কারাকোরাম পাসের কাছে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত এই রাস্তা গেছে গলওয়ান উপত্যকা হয়ে। ভারত-চীন সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার। দীর্ঘ এই সীমান্তে কাশ্মিরের লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশের কিছু এলাকা সময় সময় উত্তপ্ত হয়। লাদাখের গলওয়ান এমনই এক বিতর্কিত অঞ্চল। গত কয়েক বছর ধরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত বিভিন্ন ধরনের সামরিক অবকাঠামো তৈরি করে আসছে। লাদাখের রাজধানী লেহ্ থেকে দৌলত বেগ ওলডি বায়ুসেনাঘাঁটি পর্যন্ত ২৫৫ কিলোমিটার রাস্তা চীনের চক্ষুশূলের কারণ।

১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর এটি পরমাণু শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষ। ১৯৬২ সালে লাদাখ সীমান্তে সংঘটিত যুদ্ধটি ভারতের শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল। এরপর ১৯৭৫ সালে বিতর্কিত সীমান্ত সংঘাতে কয়েকজন ভারতীয় সেনা হতাহত হওয়ার পর গত ১৫ জুন প্রথম বড় ধরনের সংঘাত ও হতাহতের ঘটনা ঘটল। শক্তি ও কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে ভারতের চেয়ে চীন সব সময়ই এগিয়ে। তবে এবারে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হচ্ছে, আকস্মিক এক ঝড় আসবে; যা দুই দেশের ওপরই প্রভাব ফেলবে। ১৯৬২ সালের ওই যুদ্ধের পর দুই দেশের সীমান্তের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) ঠিক হয়। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে এর ওপর কোনো সম্মতি ছিল না, ছিল না কোনো নিয়ন্ত্রণ। তবে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছিল যে তারা সীমান্তে আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া টহল দেবে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের সংঘর্ষের ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে দিয়েছে, এমন সংঘর্ষের ঘটনা আরও ঘটতে পারে সম্প্রতি গলওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনা প্রশমনে দুই দেশের সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে বলে দাবি করা হলেও দেখা যাচ্ছে, উভয় দেশের মধ্যে বিরোধ ও বিদ্বেষ আরো বেড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষের জন্য চীনের পক্ষ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে উস্কানি দেয়ার জন্য ভারতীয় সেনাদের দায়ী করা হয়। তাদের আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়। চীনা গণমাধ্যমকে চীনের সরকারি মুখপাত্র জানান, ভারতের বোঝা উচিত- ‘চীনের সংবরণ দুর্বলতা নয়’। চীনা কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতীয় বাহিনীর যেকোনো ধরনের বাড়াবাড়িকে তারা কঠিনভাবে মোকাবেলা করবে। তার মানে ভবিষ্যতে কেউ কাউকে ছেড়ে দেবে, এমন বার্তা নেই। তবে জনসংখ্যায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দু’দেশের মধ্যে এভাবে সীমান্ত উত্তেজনা বেড়ে চললে এ অঞ্চলের বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনে তা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ, এ অঞ্চলে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের বসবাস। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও দুর্বল। মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও শান্তি সর্বাগ্রে প্রয়োজন। কিন্তু সীমান্ত রক্ষার নামে রাষ্ট্রগুলো যে নীতি গ্রহণ করছে তা কোনোভাবেই জনগণের উপকারে আসছে না। বিরোধ বাড়তে থাকলে তা ভয়াবহ যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে। সেটি ধ্বংস ছাড়া কারো উপকারে আসবে না।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত কোনো প্রতিবেশীর সাথে আস্থাপূর্ণ সম্পর্কে গড়ে তুলতে বা ধরে রাখার ইচ্ছা করেনি। ‘ফেলানীকে মেরে কাঁটা তারের উপর ঝুলিয়ে রেখেছিলো বিএসএফ। ফেলানির লাশটা এখনো চোখের সামনে ভেসে উঠছে।’ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং ছোট প্রতিবেশীদের সাথে বড়ভাইসুলভ আচরণ ভারতকে একপ্রকার বন্ধুহীন করে তুলেছে। প্রতিবেশিদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নরেন্দ্র মোদি তার অভিষেক শুরু করলেও গত ৭ বছরে তিনি হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতা, সংঘাত হানাহানি ও বিভাজন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেননি। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভারতকে তিনি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ঠেলে দিয়েছেন। চীন ও পাকিস্তানের কথা বাদ দিলেও যেখানে মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ পর্যন্ত নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ও নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতের সাথে আপসহীন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ভারতের অগ্রহণযোগ্য আচরণসহ অনেক খারাপ দিক রয়েছে, যা সারাবিশ্ব দেখে আসছে। মোদি-অমিত সাহাদের উগ্রবাদী আগ্রাসী আচরণ ভারতের ভূখন্ডকে আরেক দফা খন্ড-বিখন্ড করে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে।

সাংবিধানিকভাবে বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র এবং ট্রাডিশনালভাবে ভারতের উপর নির্ভরশীল নেপালও এখন বিতর্কিত অঞ্চলকে নিজেদের মানচিত্রভুক্ত করে নিয়েছে। কেবল তাই নয়, ইতিমধ্যে ইন্দো-নেপাল সীমান্তে নেপালি পুলিশের গুলিতে ভারতীয় নাগরিক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। শ্রীলঙ্কা, ভুটান এমনকি মালদ্বীপ পর্যন্ত ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণের কারণে আস্থাহীন হয়ে চীনের প্রভাব বলয়ে ঢুকে গেছে। ভারতের যেমন প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ভাব নেই, চীনেরও নেই। ভারত-চীনের কাছে বাণিজ্যিক স্বার্থটাই বড়। তাদের যতো আধিপাত্যের প্রয়াশঃ কেবলই বাণিজ্য স্বার্থ রক্ষায়। ওদের অর্থনীতি, আর রাজনীতি, সবটাই এখন আর্থিক স্বার্থ রক্ষার্থে, বন্ধুত্ব কেবলই মোড়ক বা আড়াল। ভারত-চীন কেউই বাংলাদেশের পরমবন্ধু রাষ্ট্র নয়। রোহিঙ্গ্যা ইস্যুই তার প্রমাণ। সীমান্ত নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের কোনো বিরোধ না থাকলেও, ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিনা কারণে বাংলাদেশীদের হত্যা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে দেশটি বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেয়ে নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শনকে প্রাধান্য দেয়। এমন আচরণ অন্য কোনো সীমান্তে ভারত করতে পারে না।

চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলেও নেপাল সীমান্ত এখনো ভারতের গলার কাঁটা হয়ে রয়েছে। নেপালের সংসদ দেশের নতুন ম্যাপ চূড়ান্ত অনুমোদনের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করেছে। সংসদের নিম্নকক্ষে বিপুল ভোটে নতুন ম্যাপসংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব পাস হয়েছে। ভারতকে নেপালের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা ভারতের ব্যাপারে তাদের অবস্থান মোটাদাগে পরিবর্তন করেছে। অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দেশটি কিছু বিরোধপূর্ণ অঞ্চলকে নিজেদের দেখিয়ে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে। উত্তরাখন্ডে ভারত, চীন ও নেপাল সীমান্তবর্তী কালাপানি, লিপুলেখ ও লিম্পিয়াধুরার ৩৩৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা নেপাল তার নতুন ম্যাপের অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই নিয়ে ভারত অস্বস্তিতে। যদিও ভারতের নীতিনির্ধারকদের একাংশের ধারণা, নেপালকে আগ্রাসী করে তুলতে চীন মদদ দিচ্ছে।

চীন ও ভারত উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ। দুই দেশের সংঘাতে নিজেদের ক্ষতি ছাড়াও প্রতিবেশী দেশগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এই সংঘর্ষ সামরিক শক্তি দিয়ে নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। চীন ও ভারত নিজেদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে জনগণের কল্যাণে মনোযোগী হবে এটাই প্রত্যাশা। অন্যদিকে, প্রতিবেশী দেশের প্রতি ভারতের নমনীয় নীতি গ্রহণ করা জরুরি, যাতে প্রত্যেকটি দেশ পারস্পারিক ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে থাকতে পারে। তা নাহলে চতুর্মুখী বিরোধে জড়িয়ে ভারত ভালো কিছু অর্জন করতে পারবে না।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন